শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিশ্বের বিস্ময়কর সেই বিমানের গল্প

মুনতাসির সিয়াম

১৬:২১, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৫:৩২, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

৩৯৮৭

বিশ্বের বিস্ময়কর সেই বিমানের গল্প

ভিভিএ-১৪ বিমান
ভিভিএ-১৪ বিমান

দ্য বার্টিনি বেরিভ ভিভিএ-১৪ হলো রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) একটি উড়োজাহাজ। এর নামের পুরো অর্থ- ভার্টিকাল টেক অফ অ্যাম্ফিবিয়াস এয়ারক্র্যাফট। মানে উলম্বভাবে উড়তে পারে এমন উভচর বিমান এটি। আর এর ইঞ্জিনের সংখ্যা ১৪ হওয়ায়, নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংখ্যাটিও। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কোন প্রকার রানওয়ে ছাড়াই যে কোন জায়গা থেকে উড়ে যাওয়ার মত ক্ষমতা ছিল বিমানটির; এমনকি জলের পৃষ্ঠের ঠিক ওপর থেকেও উড়ে যাওয়ার মতই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল এতে। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বিমানটি ছিল ৮৫ ফুট ২ ইঞ্চি এবং উচ্চতায় ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। ঘন্টায় ৭৬০ কিলোমিটার গতিবেগে ছুটে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল এটির, আর একসঙ্গে এতে চড়তে পারতো সর্বোচ্চ ৩ জন। 

১৯৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সাবমেরিন হিসেবে কিছু পোলারিস ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র প্রদর্শন করেছিল, তার পাল্টা উত্তর দিতেই ষাটের দশকে এমন উভচর দানব বিমান তৈরি করতে শুরু করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

স্বপ্নবাজ রবার্ট বার্টিনি
রবার্ট বার্টিনির দেশ ইতালি। তবে ১৯২৩ সালে ফ্যাসিবাদের উত্থানের জের ধরে দেশ ছাড়েন তিনি, চলে আসেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। ভিভিএ-১৪ বিমান প্রকল্পটির ডিজাইনার আর কেউ নন, তিনিই। রবার্ট বার্টিনির স্বপ্ন ছিল এমন একটি বিমান তৈরি করার, যা কিনা ক্ষেপনাস্ত্র বহনকারী সাবমেরিন খুঁজে বের করে তা ধ্বংস করে দিতে পারবে খুব সহজেই। সেই সঙ্গে বিমানের বেশকিছু সংস্করণ কল্পনায় ছিল রবার্ট বার্টিনির। যারমধ্যে একটি হচ্ছে, জলের ওপর অবতরণ করতে পারবে এমন পন্টুন (খেয়া নৌকা); আরেকটি হচ্ছে, ভাঁজ করা যাবে বিমানের এমন ডানা, যা কিনা সমুদ্রের মাঝখানে কোন জাহাজ থেকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে পরিকল্পনা মাফিক সে স্বপ্ন পুরোপুরি পূরণ হয়নি তার। ডিজাইনের প্রস্তাব ছিল মূলত তিনটি প্রটোটাইপ তৈরির, যার মধ্যে বাস্তবে রূপ নিয়েছিল দুটি; আর আকাশে উড়তে পেরেছিল কেবল একটি।

১৯৭৪ সালে মৃত্যু ঘটে রবার্ট বার্টিনির, পরবর্তীতে দেখা গেল ডিজাইনারের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটেছিল পুরো প্রকল্পটিরও; দ্বিতীয় প্রটোটাইপটি সে সময় ভেঙে ফেলার পর যা আর বুঝতে বাকি ছিল না কারোরই। তবে রবার্ট বার্টিনির কাজ সোভিয়েত বিমান জগতে যে ছাপ রেখে গেছে, সত্যিই তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তার ব্যতিক্রমী চিন্তাধারা এতটাই ব্যক্তিক্রম ছিল যে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেগুলোর বাস্তব রূপ লাভের সুযোগ হয়েছে খুব সামান্যই।

ইতিহাসবিদ আনড্রেই সোভেনকো
সোভিয়েত বিমানের একজন ইতিহাসবিদ আনড্রেই সোভেনকো। তিনি বলেন, ভিভিএ-১৪ বিমানটি তৈরি করা হয়েছিল এমনভাবে যেন তা জল ও স্থাল উভয় জায়গা থেকেই উড়তে পারে উলম্বভাবে; তা ছাড়া যে কোন উচ্চতায় আর দশটা নিয়মিত বিমানের মত ওড়ার ক্ষমতা তো ছিলই এর।

ভিভিএ-১৪ ডিজাইনের কাজ চলাকালীন সময়ে রবার্ট বার্টিনির সহকারী ছিলেন নিকোলাই পোগোরেলভ। ২০০৫ সালে নিকোলাই পোগোরেলভের সঙ্গে দেখা হয় আনড্রেই সোভেনকোর। এ সাক্ষাৎকালীন সময়ে রবার্ট বার্টিনির স্মৃতিচারণ করেন নিকোলাই পোগোরেলভ। আনড্রেই সোভেনকো-কে তিনি বলেন, রবার্ট বার্টিনি ছিলেন এক কথায় স্বপ্নবাজ মানুষ, তার ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা সময়ের হিসেবে বেশ অস্বাভাবিক। আসলে রবার্ট বার্টিনির চিন্তাধারা ছিল তার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তাকে সে যুগের মানুষ ভাবাটা মুশকিলই বটে, তিনি যেন অন্য কোন এক সময়ের; এ জন্য অনেকে তাকে ডাকতেন এলিয়েন বলেও।

তিন মাথার ড্রাগন
বিমানের ডিজাইনারই যখন এলিয়েন, তখন তার বিমানটি ড্রাগনের মত দেখতে হলেও খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। জেমেই গোরিনিচ নামটা শুনেছেন কেউ? আমাদের জন্য একটু অপরিচিত হলেও, রাশিয়ায় এর চর্চা ব্যাপক। রাশিয়ান রূপকথা বা লোকগাঁথার তিন মাথাওয়ালা এক ড্রাগন চরিত্রের নাম জেমেই গোরিনিচ।
ঠিক যেন রাশিয়ার রূপকথা থেকে বাস্তবের মাটিতে নেমে এসেছে তিন মাথার ড্রাগন জেমেই গোরিনিচ- এমনটাই মনে হত ভিভিএ- ১৪ বিমানটি দেখে। মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, এর মাথাও ছিল তিনটি; আর দেহের দু’পাশে তুলনামূলক ছোট দুটো ডানা। 

এ বিমানের প্রথম প্রটোটাইপটি প্রথমবারের মত ওড়ানো হয় ১৯৭২ সালে। পরবর্তীতে এতে পন্টুন যুক্ত করে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল ভাসানোর জন্যও। ১৯৭৫ সাল অবদি সক্রিয় ছিল এটি। তিন বছরে সবমিলিয়ে ১০৩ ঘন্টায় ১০৭ বার আকাশে ওড়ে বিমানটি।

ইতিহাসবিদ আনড্রেই সোভেনকো বিমানটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন- এ বিমানের ছিল না কোন উদ্ধরণ ইঞ্জিন, মানে একটি উঁচু জায়গা বা স্তরে নিয়ে যাওয়ার মত কোন ইঞ্জিন ছিল না এতে; কিংবা সাবমেরিন খোঁজার জন্যও ছিল না তেমন কোন যন্ত্রপাতি। কেবলমাত্র অনুভূমিক বা সমতলভাবে ওড়া বিমানের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ এবং বিমানের পদ্ধতি বা গঠনতন্ত্র যাচাই করাই ছিল এটির লক্ষ্য।    
  
স্বল্প মেয়াদে ভিভিএ-১৪ এর দ্বিতীয় জীবন
দ্বিতীয় প্রটোটাইপটির কথা ছিল উলম্বভাবে ওড়ার। যারজন্য ইঞ্জিন যুক্ত করার প্রয়োজন ছিল এতে। কিন্তু প্রায় শেষ হয়ে আসা সে বিমানে কখনোই যুক্ত হয়নি ইঞ্জিন। হবেই বা কী করে! বিমানে যুক্ত হওয়ার মত উপযোগী করে তৈরি হয়নি তো কোন ইঞ্জিনই। ফলে ভেস্তে যায় দ্বিতীয় প্রকল্পটি। পরবর্তীতে ভেঙেও ফেলা হয় এটিকে।

সবার বোঝার সুবিধার্থে আগেই বলে রাখা ভালো যে- একরানোপ্ল্যান হচ্ছে গ্রাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করে পানির তলপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে খুব দ্রুত গতিতে ওড়ার ক্ষমতা রাখে এমন এক ধরনের হোভারক্র্যাফট বিমান। সে রকমই একরানোপ্ল্যান বিমানে পরিণত করার মধ্য দিয়ে ভিভিএ-১৪ কে নতুন জীবন দিতে চেয়েছিলেন রবার্ট বার্টিনি। তার মৃত্যুর পরও এ বিমানের নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। তবে সেসব পরীক্ষার ফলাফল ভিভিএ-১৪ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়নি, বরং ব্যবহার করা হয়েছিল একই সময়ে ও একই উদ্দেশ্যে তৈরি অন্যান্য বিমানগুলো উন্নতির লক্ষ্যে; যা কিনা ইউএসএসআর (দ্য ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকস) তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দিয়েছিল বিমান জগতের এক অবিসংবাদিত নেতৃত্ব। এতকিছুর পরেও ভিভিএ-১৪ প্রকল্পটি নিয়ে পরে আর মাথা ঘামায়নি কর্তৃপক্ষ। এ সম্পর্কেও কথা বলতে ভোলেননি আনড্রেই সোভেনকো। তিনি বলেছেন- সোভিয়েত সেনাবাহিনী আসলে খুব দ্রুতই বুঝে উঠেছিল যে অ্যান্টি সাবমেরিন হিসেবে খুব একটা কার্যকরী নয় ভিভিএ-১৪। খুব অল্প সংখ্যক ক্ষেপনাস্ত্র বহনের ক্ষমার ছিল এর। তা ছাড়া বিভিন্ন যান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে বিশাল আকৃতির হয়ে উঠেছিল এটি। কাজেই এ কাজের জন্য সাধারণত যে বিমানগুলো ব্যবহারের চল ছিল, সেগুলো ব্যবহার করাই ভালো মনে করেছে তারা। 

ভিভিএ-১৪ এর প্রকৃত প্রটোটাইপটি তৈরি ও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়েছিল দক্ষিণ রাশিয়ার টাগানরোগ এলাকায়। প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর রণতরী বা মালবাহী জাহাজের মাধ্যমে এটিকে স্থানান্তর করা হয় মস্কোর ছোট্ট এক শহর লাইটকারিনো-তে, সেখানে বিমানটি ছিল একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায়; স্বাভাবিক ভাবেই এটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৮৭ সালে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বিমানটির অবশিষ্ট অংশটুকু নিয়ে যাওয়া হয় পাশের শহর মোনিনো-তে, সেই থেকে তেত্রিশ বছর যাবত সেন্ট্রাল এয়ারফোর্স মিউজিয়ামে অনেকটা আবর্জনার মতই পড়ে আছে বিমানটি। 

বিমানের নিখোঁজ অংশগুলো  
প্রায় পুরোটাই খোলামেলা পরিবেশের সেন্ট্রাল এয়ারফোর্স মিউজিয়ামটি। সেখানে রাখা অন্য সব বিমানের মতই খোলামেলাভাবেই আছে ভিভিএ-১৪ বিমানটিও, মিউজিয়ামের কোন এক কোণায় পড়ে আছে আর কী; বিমানের কিছু অংশ এবং এয়ার ফ্রেমটি বিমানের পাশেই রাখা আছে এমনটা দেখা মেলে গুগুল ম্যাপে, যদিও রহস্যজনক ভাবে বিমানের ডানাগুলো নিখোঁজ।

মোনিনো-তে অবস্থিত সেন্ট্রাল এয়ারফোর্স মিউজিয়ামের বর্তমান পরিচালক আলেকজান্ডার যারুবেটস্কি। এক সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ভিভিএ-১৪ বিমানের অনেক অংশই নিখোঁজ। ২০১২ সালের দিকে বিমানটির হারিয়ে যাওয়া অংশগুলো খুঁজে বের করে মেরামত কাজে মিউজিয়ামের প্রতিনিধিদের সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন টাগানরোগ এয়ারক্র্যাফট প্ল্যান্ট (বিমানটি যে জায়গায় তৈরি হয়েছিল) কর্তৃপক্ষ। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে।     

আস্থা হারাননি আনড্রেই সোভেনকো
বিমানটি মেরামতের জন্য প্রয়োজন আনুমানিক ১.২ মিলিয়ন ডলার, সেই সঙ্গে বিমান প্রকৌশলীদের জন্য কাজটি বেশ সময়েরও ব্যাপার; তা প্রায় ১-২ বছর। বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সময় খরচ হলেও, বিমানের এ প্রকল্পটি থেকে এখনো আস্থা হারাননি ইতিহাসবিদ আনড্রেই সোভেনকো। তার ধারনা, বিমানটি সঠিকভাবে মেরামত করার পর পরীক্ষা করে দেখা হলে সত্যিকার অর্থেই এটি হবে অনন্য এক আকাশযান।

আনড্রেই সোভেনকোর ধারনা ভুল ভাবাটা-ও ভুল হবে বৈকি। সত্যিই তো, ঠিকঠাক হওয়ার পর একইসঙ্গে উলম্ব ও অনুভূমিক ভাবে উড়তে ও অবতরণ করতে পারবে এটি, জল বা স্থল যে কোন জায়গাতেই তা প্রযোজ্য। দীর্ঘ সময় বিমানটি-কে পানির ওপর জাহাজের মত করে যেমন দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব, তেমনই এর ব্যবহার সম্ভব ছিল অ্যান্টি সাবমেরিন যুদ্ধ পরিচালনা-তেও; আর পাঁচটা সাধারণ বিমানের মত এর ব্যবহারের কথা তো আর নতুন করে বলারই দরকার পড়ে না।
   

সবশেষে
ভিভিএ-১৪ বিমানের একটি অসাধারণ দিক এর বহুমুখীতা। কখনোই এটি নিজের সক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি ঠিকই, তবে এক সময় কিন্তু এটিই ছিল মার্কিন সাবমেরিন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপযুক্ত জবাব দেয়ার এক ভয়ঙ্কর হাতিয়ার কিংবা আশার প্রতীক।  

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank