শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কিভাবে বাঁচে মেরু নেকড়ে?

শেখ আনোয়ার

১১:৩২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১১:৩৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

১৩৮৭

কিভাবে বাঁচে মেরু নেকড়ে?

নেকড়েদের অনেকগুলো প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু নেকড়ে হচ্ছে মেরু নেকড়ে বা আর্কটিক উল্ফ। প্রাণিজগতে এরা মেরুদন্ডী পর্বের স্তন্যপায়ী শ্রেণীর কার্নিভোরা বর্গের ক্যানিডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বৈজ্ঞানিক নাম-ক্যানিস লুপাস আর্কটর। থাকে মেরু অঞ্চলে। যেখানে সারা বছরই তুষারাবৃত থাকে। বছরের পাঁচ মাস সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। এমন মেরু অঞ্চলে বছরের অধিকাংশ সময়ই তাপমাত্রা থাকে শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

প্রচন্ড ঠান্ডা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন এ পরিবেশেও মেরু নেকড়ে সপ্তাহের পর পর সপ্তাহ কোন খাবার না খেয়ে শত প্রতিক‚লতার মধ্যেও কিভাবে ওরা বেঁচে থাকে? এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষক, প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন বিষয়টি আজও রহস্যাবৃত। তবে ওখানে ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষের আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পূর্ণ বয়স্ক একটি মেরু নেকড়ের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য তিন থেকে পাঁচ ফুট, উচ্চতা দু’ থেকে তিন ফুট আর ওজন প্রায় পৌঁনে দু’শ পাউন্ড হয়। তবে স্ত্রী নেকড়ে ওজনে কিছুটা কম হয়ে থাকে।

মেরু নেকড়েরা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলে বাস করে। এপ্রিল মাসে বাতাসের তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রী সেলসিয়াসের চেয়ে তেমন একটা বাড়ে না। মাটি থাকে সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা। ভীষণ প্রতিক‚ল এ আবহাওয়া হাতে গোনা যে অল্প ক’টি স্তন্যপায়ী প্রাণিরা সহ্য করতে পারে তাদের মধ্যে মেরু নেকড়ে অন্যতম। ত্রিশটি পর্যন্ত নেকড়ে দলবদ্ধভাবে একসঙ্গে থাকে। তবে সাধারণত একটি দলে সাত থেকে দশটি নেকড়ে দেখা যায়। একটি নেকড়ে ডেকে উঠলে শেয়ালের মতো দলের অন্য সদস্যরাও অনবরত ডাকতে থাকে। বয়স্ক সদস্যরাই দলের নেতৃত্ব দেয়। দলপতি কোন কারণে কোন সদস্যের ওপর ক্ষেপে গেলে তার দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে জোরে জোরে গর্জন করতে থাকে মেরু নেকড়ে। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আনুগত্য স্বীকার করলে তবেই দলপতি তাকে ছেড়ে দেয়।

মেরু নেকড়েরা দীর্ঘদিন ধরে প্রায়ই আনাহারে থাকে। তবে যথেষ্ট খাবারের সরবরাহ থাকলে ওরা একবারেই প্রায় এক’শ পাউন্ড মাংস খেয়ে ফেলে! মেরু অঞ্চলের খাবার যোগাড় করা খুবই কঠিন। তাই শিকারের পর কোন কিছুই অপচয় করে না মেরু নেকড়েরা। মেরু খরগোশের চামড়া, লোম ও হাড়গোড় সবকিছুই খেয়ে সাবাড় করে ওরা। মেরু নেকড়েরা লেমিং আর মেরু খরগোশ ধরে খায়। তবে ওদের সবচেয়ে সহজ শিকার হলো ক্যারিবু আর কস্তুরি ষাঁড়। খাবারের স্বল্পতার কারণে এসব প্রাণী অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত চড়ে বেড়ায়। কাজেই যথেষ্ট পরিমাণে খাবার পেতে হলে নেকড়ের দলকেও অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শিকার ধরতে হয়। মাঝে মধ্যে ওরা শিকারের খোঁজে প্রায় আট’শ বর্গমাইল এলাকাও চষে ফেলে। মেরু নেকড়েদের গড় আয়ু প্রায় সাত বছর। 

পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী একটি ক্যারিবু কিংবা কস্তুরি ষাঁড়কে একাকী আক্রমণ করে ঘায়েল করা একটি মেরু নেকড়ের পক্ষে বেশ কঠিন। বড় বড় প্রাণিদের শিকার করার সময় মেরু নেকড়েরা তাই দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করে। উন্মুক্ত তুন্দ্রা অঞ্চলে কোথাও লুকিয়ে থেকে ঝটিকা আক্রমণ করার কোন সুযোগ নেই। নেকড়ের পালকে দূর থেকে অগ্রসর হতে দেখেই শিকারেরা আগে থেকে সতর্ক হয়ে আক্রমণ ঠেকাতে তৈরি হয়ে থাকে। কস্তুরি ষাঁড়ের পাল নেকড়ের পালকে দূর থেকে দেখেই বাছুরগুলোকে মাঝখানে রেখে আক্রমণ প্রতিরক্ষা করতে নিজেরা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে যায়। নেকড়েরা ষাঁড়গুলোকে ছত্রভঙ্গ করতে এদিক-ওদিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নেকড়েরাও বৃত্তাকারে ষাঁড়গুলোকে ঘিরে ধরে নানাভাবে বিরক্ত করতে থাকে যাতে ওদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। নেকড়ের তীব্র আক্রমণে প্রায়ই ষাঁড়ের পাল দিশেহারা হয়ে পড়ে। এসময় নেকড়ের পাল ষাঁড়গুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল কিংবা কমবয়সী সদস্যটিকে আক্রমণ করে। ওকে তাড়া করে ওরা অন্যদিকে নিয়ে যায়। তারপর সবাই মিলে ওটাকে কামড়ে ধরে মেরে ফেলে। একটি ষাঁড় মারতে পারলে অনায়াসেই পুরো একটি দলের কয়েকদিনের খাবার জুটে যায়। মা নেকড়ে শিকারে বের হলে দলের অল্প বয়স্ক সদস্যরা সবাই মিলে বাচ্চাদের দেখাশোনা করে থাকে।

মেরু নেকড়েরা ছোট ছোট দল বা গোত্রে বিভক্ত হয়ে বাস করে। এক একটি দলে পুরুষ ও একটি স্ত্রী নেকড়ে ছাড়াও কয়েকটি বাচ্চা নেকড়ে এবং কয়েকটি অপ্রাপ্তবয়স্ক নেকড়ে থাকে। দলে কর্তৃত্বকারী পুরুষ নেকড়েকে আলফা পুরুষ এবং স্ত্রী নেকড়েকে আলফা স্ত্রী নেকড়ে বলে। দলের সব সদস্যই তাদের নির্দেশ হুকুম মেনে চলে। বাচ্চা নেকড়েদের যতœ নেয়া ও খাওয়ানোর কাজে দলের সবাই সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে দল থেকে পূর্ণাঙ্গ নেকড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য নতুন কোন স্থান বেছে নেয়। নিজের দেহের বিশেষ গন্ধ দিয়ে ওরা সীমানা চিহ্নিত করে। অন্য কোন দল থেকে বেরিয়ে আসা পছন্দসই নেকড়ের সঙ্গে জোড়া বাঁধে সে। এভাবে ওরা নতুন আরেকটি দল গঠন করে।

পুরো বসন্ত আর শীতকাল নেকড়েরা বাইরে শিকার ধরে কাটায়। মার্চ মাসে মা নেকড়ে নিরিবিলি কোন জায়গাতে মাটির নিচে কোন গর্ত খুঁজে নেয়। মাঝে মাঝে ওরা নিজেরাই নতুন কোন গর্ত খুঁড়ে নেয়। কিন্তু প্রতিক‚ল পরিবেশে প্রচন্ড তুষারপাতের সময় পুরনো কোন গর্ত বেছে নেয়। এ গর্তেই মা নেকড়ে চার থেকে পাঁচটি বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাগুলো প্রথমে অন্ধ থাকে। এ সময় ওরা কানে শুনতে পায় না এবং চোখেও কোন কিছু দেখতে পায় না বলে সম্পূর্ণ অসহায় থাকে। এ সময় ওরা মায়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকে। বাবা নেকড়ে মা নেকড়েকে খাবার যোগাড় করে এনে দিয়ে সাহায্য করে। প্রায় এক মাস পর থেকে বাচ্চারা মাংস খেতে শুরু করে। এ সময় থেকে দলের সবাই শিকার করার পর আধাহজমকৃত মাংস মুখ থেকে উগড়িয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়। এক বছর পর বাচ্চারা দলের অন্যদের সঙ্গে শিকারে অংশ নিতে পারে। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank