বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

করোনায় কোথাও নেই কল রেডী

কায়সার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

০৯:৫৪, ২২ ডিসেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৪:৫৪, ২২ ডিসেম্বর ২০২০

২০৬৫

করোনায় কোথাও নেই কল রেডী

ডিজিটাল সময়ে হাত মুঠোতেই সাউন্ড সিস্টেম। সেতো নিজের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসব পার্বনে, সভা সমাবেশে, অনুষ্ঠানাদিতে শব্দ সুবিধা লাগেই। সময়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর ব্যবহারের মাত্রা ও রকমফের পাল্টেছে। ফলে পাল্টেছে ব্যবসার ধরনও। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মহামারিতে যখন সকল কিছুই বন্ধ তখন চোখের আড়ালে থেকে ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ব্যবসার খাতটিও।

এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অর্ধশত বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে একই ব্যবসা করে আসছে। সেই সব ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানও এখন বন্ধ হওয়ার জোগাড়। প্রিয় পাঠক, আমরা আপনাদের শোনাবো কল রেডী'র গল্প। যা ছিলো আমাদের ইতিহাসেরই অংশ।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে ভাষণই মূলত ছিল দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ডাক। সে দিনের সে লক্ষ লক্ষ জনতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রত্যেকের কানে পৌছে দিয়েছিলো কল রেডী।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ভাষণের ভিডিওটি এখন একটি রঙীন সংস্করণও করা হয়েছে। তারই সঙ্গে সাদাকালো যুগের সেদিনের কল রেডী আরও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয় দর্শকের চোখে। দেখা যায় যে মাইক্রোফেনে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখছেন তার সামনে, স্ট্যান্ডের সঙ্গে কালো একটি বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা রয়েছে কল রেডী। 

শুধু ৭ মার্চ কেনো, ৪৮ থেকে ৭১ এর সেই উত্তাল দিনগুলোর ঐতিহাসিক অনেক ভিডিও ছবিতে মাইকের সামনে কল রেডী লেখা চোখে পড়ে। চোখে পড়ে স্বাধীনতা উত্তর দেশেরও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ছবিতে।
 
সেই কল রেডী এখন কেমন আছে? 

পুরাণ ঢাকার পুরনো সব দর-দালান আর ছোট সরু গলি পথ পার হয়ে পৌঁছলাম লক্ষীবাজারের ঋষিকেশ দাশ লেনে। নাম বললে কে না চিনবে? ফলে ৩৬ নম্বর বাড়িটি খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে পৌছে গেলাম ইতিহাসের অংশ কল রেডীর অফিসে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বড় একটি কালো বোর্ডে বাংলায় লেখা কল রেডী, নিচে ইংরেজিতে লিখা we create history. 

অফিস খোলা, বাইরে থেকে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে ভিতরে কেউকে চোখে পড়লো না অনুমতি নিয়ে ঢোকার জন্য। বিনা অনুমতিতেই ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সেখানে তিনটা ঘর নিয়ে কল রেডীর অফিস। চারপাশে ছড়িয়ে আছে পুরনো মাইক, যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক তার, মাইক্রোফোন, পুরণো তার, সাউন্ড বক্স, মাইক স্ট্যান্ড ইত্যাদি। যা ভেবে এসেছিলাম- এতো বড় প্রতিষ্ঠানে ঢুকে দেখবো এলাহী কারবার, ঠিক তেমনটা পেলামনা। ম্লান হয়ে আছে। কোনো লোকজন নেই। নেই কোনো শব্দ। হ্যালো টেস্টিং, মাইক্রফোন টেস্টিং- ওয়ান-টু-থ্রি। 

এবার মধ্যবয়স্ক এক দোকান-কর্মীর দেখা মিললো। নাম সূর্য। জানালেন ৩০ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পরিচয় দিতেই বললেন, 'মালিককে খবর পাঠাচ্ছি, একটু অপেক্ষা করুন'। 

মাইকের যন্ত্রাংশ ছড়ানো ছিটানো তার মাঝে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার বসার জন্য এগিয়ে দিলেন। আর এটা ওটা করতে করতে কিছু কথা বললেন। সূর্য জানালেন, তার ভাল লাগে মাইকের কাজ করতে। বললেন, যখন মানুষ দেখে বা জানতে পারে, তিনি কল রেডীর মাইক অফিসে চাকরি করেন, তখন তার গর্ব হয়। কারণ, কল রেডীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক আছে। 

কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ত্রিনাথ ঘোষ সাগর। আগেই খবর পেয়েছিলেন। তিনি তার ঘরে নিয়ে গেলেন, প্রত্যেকটি ঘরের দরজায় লেখা কল রেডী। সূর্য এক ফাঁকে চা দিয়ে গেলেন। চা খেতে খেতে কথা শুরু হলো। 

ত্রিনাথ ঘোষ কল রেডীর প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ ঘোষের তৃতীয় পুত্র। বাবা হরিপদ ঘোষ মারা যাবার পর তারা তিনভাই মিলেই এই প্রতিষ্ঠানটির দেখাশোনা করেন। 

কল রেডীর বর্তমান অবস্থা এমন ম্লান কেন? সে প্রশ্নে ত্রিনাথ ঘোষ অপরাজেয় বাংলাকে বলেন, করোনার কারণে তারা খুব খারাপ সময় পার করছেন। করোনা শুরু হবার পর ১০ মাস ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসব-পার্বন সব কিছুই চলছে অতি সীমিত আকারে। ফলে ব্যবসা একেবারেই নেই। 

প্রতিষ্ঠানের ২৬ জন কর্মচারীর মধ্যে এক সূর্য ছাড়া কেউ আর চাকরিতে নেই। তাদের কেউ বাড়ি চলে গেছে, কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ সবজির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। 

স্টাফ নেই, ব্যবসা নেই, ফলে কল রেডী অফিস এখন ঝিমিয়ে থাকে।

ত্রিনাথ ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতায় মনে হলো বর্তমান ম্লান অবস্থার চেয়ে অতীতের উজ্জ্বল দিনগুলো নিয়েই যেনো কথা বলতে বেশি পছন্দ করছেন। জানালেন, ১৯৪৮ সালে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে এর যাত্রা শুরু হয় হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ এই দুই ভাইয়ের উদ্যোগে। আদি বাড়ি বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামে। সে বছরই ‘লাইট হাউস’ নামের একটি আলোকসজ্জার দোকানও চালু করেন দুই ভাই। এদিকে দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।  চাহিদা বাড়তে থাকায় পরে বিদেশ থেকে মাইকের ইউনিট কিনে আনেন। তাতেও চাহিদা মেটানো যাচ্ছিল না। হরিপদ ঘোষ মাইক তৈরি করতে জানতেন। পরে যন্ত্রপাতি কিনে নিজেই কয়েকটি মাইক তৈরি শুরু করেন। এভাবেই এগিয়ে চলে তাদের জমজমাট ব্যবসা।

১৯৬৯-৭০-৭১'র দিনগুলো ছিলো আরও উত্তাল। মাইকের অনেক চাহিদা। একাত্তরের মার্চ। একদিন বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসায় একদিন ডেকে পাঠান হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে। ৭ মার্চ জনসভার জন্য রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগানোর নির্দেশ দিলেন তাদের।  দুই ভাই ৭ মার্চের দুইদিন আগে থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে শুরু করলেন রাতের অন্ধকারে। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন তারা।

সাগর ঘোষ জানান, ২৬ জন কর্মী সে কাজে অংশ নিয়েছিলেন। বলেন, সেই সমাবেশের জন্য তার বাবা নিজের হাতে মাইক তৈরিও করেছিলেন। 

সাগর ঘোষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখে পড়ে আশে পাশের দেয়ালে। পুরণো ছবি সাটানো আছে দেয়ালগুলোতে। একটা ছবিতে দেখা গেলো, হাসপাতাল শয্যায় অসুস্থ হরিপদ ঘোষের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাগর ঘোষ জানালেন, বঙ্গবন্ধু তাদের পরিবারটিকে খুব ভালবাসতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বাবা যখন অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালে গেছেন দেখা করার জন্য। দুই দফা তার চিকিৎসার জন্য অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। 

সাগর বলেন, দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষ কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, শেখ হাসিনা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ আরো অনেকে আছেন এই তালিকায়। 

বিদেশি নেতাদের মধ্যে আছেন ইন্দিরা গান্ধী,  ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বিল ক্লিনটন, প্রণব মুখার্জি, অটল বিহারি বাজপেয়ী।  

বঙ্গবন্ধু যে মাইকগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন, সেগুলো কি এখনো আছে? এমন প্রশ্নে সাগর ঘোষ অপরাজেয় বাংলাকে জানালেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ  হবার পর, তারা অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী তাদের দোকান লুটপাট করেছে। সেসময় অনেক কিছু খোঁয়া গেছে। 

তবে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত কিছু উপকরণ, কিছু মাইক এখনো রয়েছে, তারা সেসব প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে চান, জানালেন ত্রিনাথ ঘোষ সাগর।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ফেরার পথে আবারও চোখে পড়লো কালো বোর্ডে সাদা কলিতে লেখা কল রেডী। মাঠে ময়দানে, সভা-সমাবেশে, অনুষ্ঠান আসরে মাইক্রফোনের সামনে অনেক চোখে পড়েছে এই লেখাটি। এখন আর কোথাও নেই কল রেডী। কল রেডীর দীর্ঘদিনের কর্মী সূর্যকে দেখা গেলো রাস্তার ওপারে। এক মুখ ভর্তি পান ও পিক নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, 'করোনাতে ভাল নেই ভাই, ব্যবসা নাই, করোনায় ক্লান্ত আমরা।'

দেখুন ভিডিও স্টোরি:

 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)

আরও পড়ুন

Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
বিশেষ সংবাদ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত