শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

যে ছবি মনে ভাসে সে ছবি পর্দায় আসে 

শেখ আনোয়ার 

১১:৩১, ৪ জুন ২০২১

আপডেট: ১২:১৫, ৪ জুন ২০২১

৮৬১

যে ছবি মনে ভাসে সে ছবি পর্দায় আসে 

রাজধানীর রাস্তায় গাড়িতে বসা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মহোদয়ের হাত থেকে আইফোন কেড়ে নিয়ে পালিয়েছে এক ছিনতাইকারী। খবরে প্রকাশ, বিজয় সরণিতে গাড়িতে বসে মোবাইল ব্রাউজ করছিলেন তিনি। হুট করে কেউ একজন মোবাইল নিয়ে দৌড় দেয়। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে গানম্যান ওই ছিনতাইকারীর পিছু নিলেও তাকে আর ধরা যায়নি। মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে, মোবাইলটি উদ্ধারে তৎপর পুলিশ। 

অথবা ধরা যাক, আপনি নিজেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন। ছিনতাইকারী আপনার স্মার্টফোন, টাকা পয়সা, জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দিলো। সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরাও নেই। শুধু আপনি দেখছেন। কিছু করার নেই। ঘটনার পর বড়জোর পুলিশকে জানালেন। পুলিশকে ছিনতাইকারীর বর্ণনা দিলেন। পুলিশ চিত্রশিল্পী দিয়ে বর্ণনা মতো সম্ভাব্য ছিনতাইকারীর পোর্ট্রটে ছবি আঁকিয়ে নেয় কিংবা অনুমানের পিঠে ভর করে তদন্ত করে থাকে। কিন্তু এমন যদি হতো- আপনার চোখে ছিনতাইকারীর যে ছবিটা ভাসছে, সেটি তৎক্ষণাৎ পর্দায় তুলতে কিংবা প্রিন্ট করে পুলিশের সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন! তাহলে ছিনতাইকারীর খবর ছিলো। অথবা আপনার ভালোবাসার মেয়েটিকে যদি কল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গে তার ছবি পর্দায় দেখতে পেতেন? ভাবছেন, এটিও কি সম্ভব? এ তো সোনার পাথর বাটি! 

সোনার পাথর বাটি নয়
ডিজিটাল প্রযুক্তির আরেক ম্যাজিক এটি। কল্পনা থেকে ছিনতাইকারীর ছবি সত্যিই বাস্তবে দেখা যাবে। শুরু হচ্ছে মানুষের ব্রেইনের সঙ্গে কম্পিউটার সিস্টেমের নিবিড় সম্পর্কের এ গল্পগাঁথা বা  রূপকথা। ঠিক রূপকথা বললে ভুল হবে। শুনতে রুপকথার মতো মনে হলেও এটি এখন আর কোনো অবাস্তব কল্পনার তথ্য নয়। ছিনতাই নিয়ে নেই চিন্তা। ছিনতাই অপরাধী কোন ক্রমেই পার পাবে না। মনের কল্পনা প্রিন্টিং প্রযুক্তি শিগগিরই বাজারে আসছে। আজ যাকে কল্পনা বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন ক’দিনের মধ্যেই এসব বাস্তব হতে যাচ্ছে। আসছে সিথ্রি ভিশন। ব্রেইনের ভাষা বুঝবে কম্পিউটার। শধু বুঝবেই না, তাকে ডিজিটাল ইমেজ বা ছবি আকারে প্রকাশও করবে। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই ধরনের একটি সিস্টেম উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে অ্যাডভান্সড ডিফেন্স রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি- অ্যাডর্পা। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা কেন্দ্র এমন আদর্শ পদ্ধতির উদ্ভাবনে ও উন্নয়নে সব ধরনের গবেষণামূলক কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছে। অ্যাডর্পা এখন ছিনতাইকারী, অপরাধী, সন্ত্রাসীদের প্রাপ্ত তাৎক্ষণিক যে কোনো ছবি দ্রুত শনাক্ত করতে এই প্রযুক্তি সিস্টেম ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের গতির তালে তালে তথ্য আদান-প্রদান সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক বিন্যাসে কত দূর এগিয়ে গেছে, তা কল্পনা করাই যায় না। এই সিথ্রি  ভিশনের সঙ্গে ব্যবহৃত হবে ওয়্যারলেস প্রিন্টার বা পেরিফেরাল যন্ত্র। এটি মানুষের কল্পনা, বোধগম্য গ্রাফ, ছবি, শব্দ, লেখা সাধারণ প্রিন্টারের মতো কাগজে ছাপানোর কাজও করবে। আজকাল পিসি, ডিজিটাল অ্যান্ড্রয়েড গেজেট, স্মার্টফোন ইত্যাদি প্রযুক্তির সাহায্যে প্রিন্ট নেওয়া মামুলি ব্যাপার। সিথ্রি ভিশন প্রযুক্তিতে ভিকটিমের চোখে, মুখে বা শরীরের স্বাভাবিক স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পর্দায় ভেসে উঠবে এবং প্রিন্ট হয়ে যাবে ভিকটিমের মনের ভাবনায় থাকা সম্ভাব্য ছিনতাইকারী, অপরাধীর ছবিটি। 

কিভাবে মনের ছবি পর্দায় আসে?
বিজ্ঞানীরা জানান, মানুষ নানা সময় তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বিভিন্ন বাচন ভঙ্গির মাধ্যমে। শব্দটি যদি হয় আহা! তবে প্রথমে এ শব্দটি উচ্চারনের সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার সিস্টেম তাকে ইলেক্ট্রো এনসেফালোগ্রাম বা ইইজি ক্যাপে সংস্করণে এর কোড করে ফেলে। এরপর এই সাংকেতিক অবস্থাকে কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে সফটওয়্যার সিস্টেমে রূপান্তর করে একটি ফলাফল প্রকাশ করে। আগেও এই বিষয়ে বেশ চর্চা হয়েছে। তবে বর্তমানে শুধু অক্ষর শব্দ নয়। ইমেজ বা ছবিকে মানুষের ব্রেইন থেকে প্রিন্টারের ভাষায় প্রকাশ করার গবেষণা সফলতার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একে শুধু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে। অন্য কোনো কাজে নয়। মুলত ব্রেইন থেকে সাংকেতিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তাকে সফটওয়্যারের ভাষায় বিশ্লেষণ করে একটি ফলাফল প্রকাশ করা হবে যা হবে নির্ভূল ও বিশ্বাসযোগ্য একটি ফলাফল। 

মনের ছবি কতটা সত্যি হয়? 
অপরাধী শনাক্তকরণে এই প্রযুক্তিকে নির্ভুল বলা হলেও পদ্ধতিটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন কিছু বিজ্ঞানী। কম্পিউটার আর মানুষের ব্রেইনের সমন্বয়ের এই যোগসূত্রের কিছু ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন- ব্যবসন কলেজের প্রযুক্তি বিষয়ক অধ্যাপক ষ্টিভেন গর্ডন। তার যুক্তি: ‘মানুষের ব্রেইন ভীষণ অস্থির। সিথ্রি ভিশনকে কাজে লাগাতে হলে যে মানুষটি ছবি সংক্রান্ত তথ্যটি দেবে তার মানসিক অবস্থার পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নীরিক্ষা আগে সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে সাংকেতিক তথ্য নেওয়ার সময় তথ্যগুলো এলামেলো ভাবে সংগৃহিত হতে পারে। যার ফলাফল আসবে সম্পূর্ণ বিপরীত। যার সঙ্গে হয়তো বাস্তবতার কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং সিথ্রি ভিশন সিস্টেমটি সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হবে। অনেক ক্ষেত্রে তথ্য প্রদানকারী ইচ্ছা করে ভুল ছবি কল্পনা করতে পারে। তাতে তথ্যগত বা নির্ভরযোগ্যতায় জটিলতার আর্বিভাব হবে। যা সিস্টেমটির গ্রহনযোগ্যতা নষ্ট করবে।’ গর্ডনের মতে, ‘তাই শুধু প্রযুক্তি নির্ভর না হয়ে ইন্টেলিজেন্সি বিভাগকেও এক্ষেত্রে সমভাবে কাজ করতে হবে। দু’টো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে তথ্যগত বিভ্রান্তি হওয়ার আশংকা কম থাকবে।’
 
ছিনতাইকারীর পালানোর পথ নেই
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘এটি নতুন কোনো ধারণা নয়। বর্তমানে নানান জটিল চিকিৎসায় সিথ্রি ভিশন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে শুধু ক্ষেত্রটি হয়তো ইমেজ বা ছবি শনাক্তের কাজে ব্যবহৃত হবে। যা ব্রেইনের সঙ্গে কাজ করবে। মানুষের ব্রেইনের সঙ্গে কম্পিউটার সিস্টেমের এ সমন্বয়ে মানুষ যে ছবি মনে মনে ভেবে নেবে, কিংবা ব্রেইন দিয়ে চিন্তা করবে, কম্পিউটার সিস্টেম নিউরাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে ছবিকে বাস্তব রুপ দেবে।’ অ্যাডভান্সড ডিফেন্স রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি- অ্যাডর্পা সূত্রে প্রকাশ- আগামী ক’ মাসের মধ্যেই এ সিস্টেমকে বাস্তবিকভাবে কাজে লাগোনো সম্ভব হবে। এই নিয়ে  ইতোমধ্যে কলম্বিয়া টিম বেশ সফলতা অর্জন করেছে। অপেক্ষা আর মাত্র ক’দিন। ছিনতাইকারীর আর পালানোর পথ নেই।

পুলিশের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার
বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্য সবকিছু উন্নয়নের মতই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি ও ব্যবহার বেড়ে গেছে। এক সময় সোর্স বা তথ্যদাতার উপর পুলিশকে নির্ভরশীল থাকতে হতো। বিচার ব্যবস্থা আরও উন্নত আরও স্বচ্ছ ও সময় সাশ্রয়ী করতে অপরাধী শনাক্ত করণ ও সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহে পুলিশের তদন্ত কাজে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির নানান আধুনিক যন্ত্রপাতি। পুলিশ দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূত্রবিহীন ঘটনার তদন্ত করে ধরে ফেলছেন অপরাধী। অপরাধী অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত, তা প্রমাণ করতে পুলিশের সুদক্ষ বিশেষজ্ঞ অপরাধ বিজ্ঞানীরা ডিএনএ পরীক্ষা, রাসায়নিক পরীক্ষা, আঙ্গুলের ছাপ, পায়ের ছাপ, হাতের লেখা, মৃত ও জীবিত ব্যক্তি শনাক্তকরণ, ব্যক্তির বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করছে। 

পুলিশের প্রযুক্তি কেন দরকার? 
শুধু তাই নয়। পুলিশের দায়িত্ব পালনের অবসরের ফাঁকের সময়টুকু নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেনো দুর্বল হয়ে না পড়তে পরে সেজন্যে লাগানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্ঘটনা, ছিনতাই, চুরি, সন্ত্রাসী সহজে সনাক্ত করা যাচ্ছে। বর্তমানে বাসা, অফিস আদালত, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা, রাস্তা ঘাট, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা বাড়তি চোখ হিসেবে কাজ করছে। এই চোখ কখনও ঘুমায় না। ছোট এই সার্কিট ক্যামেরা সবসময় ভিডিও ক্যাপ্চার করে যায়। তার মেমোরিতে সংরক্ষন করে রাখে। তাই এখন কোথাও কোনো অপরাধ ঘটা মাত্রই ওই এলাকায় স্থাপিত সিসি ক্যামেরা, অপরাধীর ব্যবহৃত মুঠোফোনের কল ও এসএমএস আদানপ্রদানের প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পুলিশের সুদক্ষ টীম। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সহায়তায় বহু ক্ষেত্রে আদালতে সাজাও হয়। যা কীনা অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয়ে থাকে। কারণ এসবই হলো, বৈজ্ঞানিক তথ্য। বাংলাদেশে অপরাধী ধরার এসব বিজ্ঞান কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার জোরদার হওয়ায় অপরাধ সম্পর্কিত বিচার ব্যবস্থায় অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই সেখানে কি হবে? সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও ঘটনার সময় যদি বিদ্যুৎ না থাকে তখন কি হবে? কিংবা যখন সিসিটিভি ক্যামেরাটিই খুলে নেয় অপরাধী তখন কি হবে? কিংবা ভিকটিম যদি পুলিশকে অপরাধীর তথ্য দিতে অক্ষম বা বোবা কিংবা অন্ধ হয়ে থাকে তখন? এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। তখন কিভাবে অপরাধী শনাক্ত করবে পুলিশ? 

হ্যাঁ। তখনই দরকার নতুন ও সহজ এই সিথ্রি ভিশন প্রযুক্তি। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন ডিজিটাল বাংলাদেশেও আসবে অপরাধী শনাক্তকরণের নতুন এই প্রযুক্তি। যা মনে মনে কল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট করে দেবে ছিনতাইকারী, অপরাধীর ছবি। তখন ছিনতাইকারীর পালানোর পথ থাকবে না। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ছবি দেখে টপাটপ ছিনতাইকারী ধরতে পারবে পুলিশ।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank