শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পথ থেকে পাওয়া

রাতের অন্যায়ে দিনের অস্বস্তি

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

২০:৫৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৩:৪০, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০

২০৭৩

পথ থেকে পাওয়া

রাতের অন্যায়ে দিনের অস্বস্তি

তখন রাতের আঁধার নেমেছে। খুব বেশি রাত নয়। তবে শীত আর কুয়াশায় মনে হচ্ছিল রাত গভীর। রাজধানীর বাংলামোটর থেকে ফুটপাত ধরে শাহবাগের দিকে এগুতে শীতের বাতাসে ঠাণ্ডার মেজাজ অনুভব করা গেলো। একটু পরপরই ছুটে যাওয়া মুড়ির টিন খ্যাত মিনিবাসগুলোর হেড লাইটে কুয়াশায় আলোর তরঙ্গ ছিলো উপভোগ করার মতো।  

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কিছুটা আগেই একটা ফুটওভার ব্রিজ দুই অভিজাত এলাকা, ওপারে পরীবাগ এপারে ইস্কাটন গার্ডেনকে সংযুক্ত করেছে। ব্রিজের নীচে পৌঁছাতে প্রশ্রাব ও বিষ্ঠার তীব্র নোংরা গন্ধ নাকে লাগলো। মুখের মাস্ক ভেদ করে আসা সে গন্ধ আপনাকে মাস্ক খুলে থুথু ফেলতে বাধ্য করবে। দীর্ঘক্ষণ ধরে পুষে রাখা চায়ের তেষ্টাটি নিমিষেই উবে গেলো।

তবে ফুটওভার ব্রিজের ঠিক সামনেই মিললো ফ্লাস্কে চা বিক্রি করা দুই ফেরিওয়ালার দেখা। জানা ছিলো, এখানে চা ভালোই বিক্রি হয়। কারণ ক্রেতা কম নয়। রাত যত গভীর হয় এখানে ক্রেতা বাড়ে। 

কারা এই ক্রেতা? দুর্গন্ধময় পরিবেশে কে বা কারা চা পান করে? সে প্রশ্ন মনে জাগায় অপেক্ষাকৃত তরুণ চা ওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, 'জানতে চাইলে অপেক্ষা করেন, দেখবেন কারা চা খায়।'

ফুটওভার ব্রিজ থেকে একটু দূরে সাদা পুরনো ফ্লাস্ক সামনে রেখে অপেক্ষাকৃত বয়ষ্ক চাওয়ালা চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে চায়ের তেষ্টাটা ফিরলো। সামনে যেতেই চাদরে ঢাকা মুখ অল্প বের করলেন। কাঁপা হাতে বোতাম চেপে রঙ ওঠা কাপে চা এগিয়ে দিলেন। তরুণ চাওয়ালার কথাটি মাথায় ঘুরছে। তাই চায়ে চুমুক দিয়ে পায়েহাঁটা মানুষের এপার ওপার হওয়ার অন্যতম অবলম্বন ইস্পাতে তৈরি লালরঙা ব্রিজটির দিকে চোখ গেলো। 

ব্রিজের নেই কোনো নিজস্ব আলো। রাতের সড়কে বাস-ট্রাকের হেডলাইটে আলোকিত। তবে এতটা দূর থেকে ভিতরের কিছুই চোখে পড়ে না। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে একটা বিশেষ ধরণের হাততালির শব্দ এলো কানে। কয়েকবার তালির শব্দ শুনে ধারণা করা গেলো এরা তৃতীয় লিঙ্গের ভাসমান মানুষ। 

চাওয়ালা এতক্ষণ একটি কথাও বলেন নি। এবার বললেন, "মামা এডা হিজড়াগো তালি, ঐদিকে তাকাইয়েননা, আরো বেশি তালি দেবার লাগবো।" 

চায়ের কাপে আরো কিছুটা সময় পার করে ফের ব্রিজের দিকে চোখ ফেলতে দেখা গেলো সেখানে লোকের আনাগোনা বেড়েছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ চাওয়ালা তখন সেখানে পসার জমিয়েছেন। বেশির ভাগই রিকশাচালক ও ভাসমান মানুষ। রিকশাওয়ালারা রিকশায় যাত্রীর আসনে বসে চাদরমুড়ি দিয়ে, দুই পা চালকের সিটে রেখে আয়েশে বিড়ি কিংবা সিগারেটও ফুঁকছেন। আরো দুই চারজন রিকশাওয়ালাদের পাশে দাঁড়িয়ে খোশগল্পে ব্যস্ত।

বুড়ো চাওয়ালাকে আরও এককাপ চা দিতে বললাম। সেই বিশেষ ধরণের তালির শব্দ কানে আসছিলো আবার । তবে ফুটওভার ব্রিজের দিকটি থেকে নয়, ইস্কাটন গার্ডেনের দিক থেকে। দেখা গেলো এক রিকশায় তিনজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তালি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছেন। 

এরা এসে নামলেন বুড়ো চা ওয়ালার সামনে। স্নিগ্ধা, চামেলি আর ছন্দা তাদের নাম, একে অপরের সঙ্গে কথপোকথনে জানা গেলো। বেশ উচ্চস্বরে শব্দ করে তারা কথা বলছিলেন। বয়স ৩০- ৪০ এর মধ্যে হবে। তিনজনই কড়া মেকাপ লাগিয়েছেন, উজ্জ্বল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা। কড়া, সস্তা পারফিউমের গন্ধ বিষ্ঠা-প্রস্রাবের গন্ধে একাকার হয়ে উদ্ভট গন্ধময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একজনের খোঁপায় গাঁদা ফুলও চোখে পড়লো। চাওয়ালার উপদেশ মতো তাদের দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে চা পানে ব্যস্ত থাকলাম।

কথাবার্তায় মনো হলো সবচেয়ে সিনিয়র চামেলি। তিনিই অপর দুইজনকে কিছু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। ছন্দা ও স্নিগ্ধা থেকে গেল, চামেলি রিকশায় উঠে ফুটওভার ব্রিজের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, 'হেগো রাইখা গেলাম, দেইখা রাহিস।'

ওপাশ থেকে তালির শব্দ ভেসে এলো।

চামেলিকে নিয়ে রিকশা চলে গেল রমনার দিকে। ছন্দা ও স্নিগ্ধা উঠে গেলেন ফুটওভার ব্রিজের উপরে। কৌতুহলী মনের কিছু প্রশ্নের প্রাথমিক উত্তর মিললো চা ওয়ালার কাছে। বললেন, 'মামা হেরা সারারাত থাকবো। ব্রিজের উপরে খারাপ কাজ করে। ওগো কিছু কওন যায়না, য্যামনে চিল্লাপাল্লা চ্যাচামেচি করে!'

রোজ রাতেই  কি তারা আসে? প্রশ্ন ছিলো চাওয়ালার কাছে। তার উত্তর, 'আমিতো তিনবছর এহানে ব্যবসা করি, কোন রাইতেই কামাই দেহি নাই।'

ব্রিজের নিচে জটলা বাড়ছে। আরও কিছু ভাসমান লোক এসে জড়ো হয়েছেন। রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সিএনজি ড্রাইভারও আছেন। কেউ কেউ ফুটওভার ব্রিজের ওপরে যাচ্ছেন। অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সময় পর, ফুটওভার ব্রিজ থেকে নেমে আসছেন।

একটু এগিয়ে গিয়ে ‌'এখানে আসলে কি হয়?' এমন একটি প্রশ্ন একজন রিকশাওয়ালার দিকে ছুড়ে দিতে তিনি একটু শ্লেষাত্মক কন্ঠেই বললেন, "রাইতে এখানে ভাল কোনো কাজ হয়না! খারাপ কাজ করার জন্য মানুষ আসে এখানে!" 

ফুটওভার ব্রিজটি দিয়ে রাতে সাধারণ পথচারীর পারাপার তেমন থাকেনা বললেই চলে। আর সেই সুযোগে এখানে বেশ কিছু অসামাজিক কাজ চলে অবাধে। তৃতীয় লিঙ্গের এরা ছাড়াও ভাসমান পতিতারাও আসেন। রাতভর চলে দেহব্যবসা, মাদক সেবন ও বেচা কেনার মতো অন্যায় সব কাজ। 

নীচ থেকে দেখা গেলো দু'একজন পথচারী এসে পড়লে তাদেরও আটকে দেওয়া হচ্ছে ব্রিজের গোড়ায়। কেবল খদ্দেররাই উঠছেন ব্রিজে আর কিচ্ছুক্ষণ পরে নেমে আসছেন।

চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালেন এক বেসরকারি চাকরিজীবী। খালেক বিশ্বাস। জানালেন, ওপাশ থেকেও রাতে ব্রিজ উঠতে গেলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে তিনি বেশ কিছুটা পথ ঘুরে এপাশটায় এসেছেন। 

খালেক বিশ্বাস জানালেন, তিনি এই পথে যাতায়াত করেন। তবে, রাতে এই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা যায়না। অন্ধকার থাকে । ভয় লাগে। তাছাড়া ভাসমান পতিতারা থাকে এখানে। 

"খদ্দের মনে করে ওরা কাছে আসে। ধাক্কাধাক্কি করে। মান সম্মান বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করিনা," বলেন এই যুবক। 

চায়ের বিল পরিশোধ করে, ফুটওভার ব্রিজের কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে গেলে, সাংবাদিক পরিচয়ে সকলের মধ্যে বিরক্তি ও অস্বস্তি চোখে পড়লো।

"যানগা মামা, আমাদের ব্যবসা নষ্ট কইরেন না। আপনারা থাকলে খদ্দের আইবোনা। করোনার লেইগা এমনেতেই কাম কম," একজনের সোজাসাপ্টা বক্তব্য। 

কিছু কথপোকথনে যেটুকু জানা গেলো, এখানে থেকে দেহ ব্যবসায়ীদের তুলেও নেওয়া হয়। ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে শুরু করে, হোটেল, মেস কিংবা বস্তিতেও যান এই পতিতারা। আয় রোজগারের ঝাপি খুললেন না কেউ তবে জানালেন ক্রেতা বুঝে দাম। ৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকাও দর হয়। 

"রিকশাওয়ালারা কি ৫০০ টাকা দিবে? ৫০ টাকাও নেই," বললেন একজন। 

এই কাজে কেন? এমন প্রশ্নে ফের শ্লেষাত্মক উক্তি শুনতে হলো, মিললো পাল্টা প্রশ্নও। "হিজড়াগো আপনে কাজ দিবেন? এক বেলা খাওয়াইবেন? ঘর থেইকা বাপ মা বাইর কইরা দিছে। কোন কাজ নাই, তো কি কইরা খাবো?"

বেশ কিছু খদ্দেরকেও ব্রিজের উপরে উঠতে দেখা গেলো। এরা আগেই জেনে গেছে সাংবাদিক আছে। তাই কেউ কাছে ঘেঁষছেন না। দুর থেকেই রাতের ঢাকা দেখার ভান করছেন তারা। বেশি সময় না কাটিয়ে নিচে নেমে এলাম। মনে মনে ঠিক করে নিলাম দিনের বেলায় এসে দেখতে হবে এখানটা কেমন থাকে।

পরদিন সকালে আবার গেলাম পরীবাগের সেই ফুটওভার ব্রিজে। রাতের পুরো বিপরীত চিত্র। ব্যস্ত ব্রিজ। মানুষ পার হচ্ছে। ত্রস্ত পায়ে হাঁটছে। ছুটছে বিভিন্ন দিকে ফুটওভার ব্রিজ থেকে নেমে। ব্রিজের দিনের চেহারা দেখে বোঝার উপায় নাই, রাতে এটি কেমন রূপে থাকে। কাদের দখলে থাকে এই ফুটওভার ব্রিজ! 

তবে কেউ কেউ হয়তো বুঝে ফেলেন। কারণ চোখ ফেললেই চোখে পড়বে কোথাও কোথাও পড়ে রয়েছে অনেক সিগারেটের গোড়া, ফেন্সিডিলের খালি বোতল। আরও রয়েছে ব্যবহৃত কনডম, কনডমের খালি প্যাকেট। 

সিটি করপোরেশন থেকে ফুটওভার ব্রিজের দুই পাশে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যে ফুলের টবগুলো দেয়া হয়েছে, দিনের আলোতে সেগুলোও চোখে পড়লো। গাছগুলো মরে গেছে, টবগুলো পড়ে আছে। মরাগাছের ডালেও ঝুলে আছে অবৈধ যৌনতায় ব্যবহৃত কনডম। যা দিনের আলোয় মানুষগুলোর চোখে পড়ছে আর তাতে অস্বস্তিই বাড়ছে। 

জুবায়ের আহমেদ, স্কুল শিক্ষক। ব্রিজ পার হচ্ছিলেন অন্যান্য দিনের মতোই। তিনিও নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন এই পথে। তবে দিনে। পথে থামিয়ে জানতে চাইলে বললেন, "প্রত্যেকদিনই এগুলো চোখে পড়ে। পরিবেশ নষ্ট। রাতে এই ব্রিজে প্রসাব করে যা দিনের বেলায়ও জমে থাকে। কেউ কেউ ব্রিজের গোড়ায় বিষ্ঠা ত্যাগ করে। খুব খারাপ লাগে এমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে।"

বললেন, শুধু এই ওভারব্রিজ না, এখান থেকে ফুটপাত হয়ে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত যান, আশে পাশে দেখবেন পড়ে রয়েছে এসব জন্ম নিরোধক সামগ্রী। ফুটওভার ব্রিজ মানেই প্রশ্রাব আর পায়খানার গন্ধ। 

কে দেখবে এসব? প্রশ্ন যুবক জুবায়েরের।   

শীতের সকালে কুয়াশা যতটুকু ছিলো তাও কাটিয়ে অনতিদূরে আধুনিক ইন্টারকন্টিনেটাল হোটেলের ভবনকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। তার এপাশে আরও একটি নবনির্মিত অত্যাধুনিক ভবন, ব্রিজের গোড়ার সুউচ্চ আবাসিক ও অফিস ভবন, টিএনটির কার্যালয়। ওদিকে পেট্রোল পাম্পের পেছনে সুন্দর ভবন, পাশেই প্রিয়প্রাঙ্গণ এইসব চোখে পড়লো। আবার তাকালাম ফুটওভারের পাটাতনে। সেখানে মানুষগুলো কেউ মাস্কের উপর দিয়েও মুখ চেপে চলছেন। আর কেউ কেউ সমাজে যা ট্যাবু সেগুলোই পড়ে থাকতে দেখে অস্বস্তির চোখ উপরে তুলে নিচ্ছেন। 

রাতের সব অন্যায় এখানে দিনের অস্বস্তির কারণ হয়ে ধরা দিয়েছে। 

দেখুন ভিডিও স্টোরি:

 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)

আরও পড়ুন

Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
বিশেষ সংবাদ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত