শুক্রবার   ১০ মে ২০২৪ || ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কী এই ডিজিটাল দাঁত ফোন!

শেখ আনোয়ার

১৫:৫৮, ১৭ জুন ২০২১

আপডেট: ১৬:০০, ১৭ জুন ২০২১

৯২০

কী এই ডিজিটাল দাঁত ফোন!

করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ডিজিটাল বাংলাদেশে মোবাইল ফোনেই চলছে ঘরে বসে অনলাইন পড়াশোনা, নোট আদান-প্রদান, বাজার সদাই, অফিস, বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের সবকিছু। এসবই ডিজিটাল যুগের চাহিদা। আধুনিক অর্থনীতিতে ডিজিটাল তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণ মানুষকে তথ্যের অধিকার দিয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের কল্যাণে অদক্ষ শ্রমিক কাজের খবর পাচ্ছে। কৃষক ফসলের ক্ষেতে, মৎস্যজীবীরা পানিতে থাকতেই খবর পাচ্ছেন- কোন বাজারে পৌঁছালে বেশি দাম মিলবে? অসহায় মানুষ এই করোনায় শেখ হাসিনা সরকারের সাহায্যের টাকা পাচ্ছে মোবাইল ফোনে। মোবাইল ফোনে আসা করোনারোগীর মেসেজ তাকে চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। অসুস্থ্য ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত সহজে যোগাযোগ করতে পারছে চিকিৎসকের সঙ্গে। ডিজিটাল বাংলাদেশের আগের জীবন কেমন ছিলো? অনেকেই হয়তো আজ আর স্মরণ করতেও পারবেন না।

ডিজিটাল বিশ্বের জয়-জয়কার এমন দিনে বিজ্ঞানীরা বলছেন অন্যকথা। ‘প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। গোয়েন্দা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোনের ক্যালকুলেটর থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গুগলের নানান অ্যাপস।’ এসবের মাধ্যমে ওয়ান টু ওয়ান যোগাযোগ করা যায়। যা মনিটরিং চালানোর প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই দেশে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে সরকারী গোপনীয় স্থানে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে মোবাইল ফোন! দক্ষিণ কোরিয়ায় সাংবাদিক ও বেসরকারী ঠিকাদারদের গোপনীয় তথ্য সংগ্রহের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় তথ্য ফাঁস ঠেকাতে সম্প্রতি দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা স্থাপনার বিভিন্ন তথ্য ও নকশা উল্লেখযোগ্য হারে চুরি যাওয়া নিয়ন্ত্রণে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সিউল। দেশটিতে মোবাইল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ আইন পরীক্ষামূলকভাবে প্রণয়ন করা হলেও অচিরেই এটি স্থায়ী রূপ দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। 

মোবাইল ফোনের নানান কৃত্রিম বুদ্ধির মজায় অভ্যস্থ মানুষ কি মোবাইল ছাড়া চলতে পারে? জী না। এ জন্যে বেরুলো ডিজিটাল দাঁত। যেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ, সেখানে অতি গোপন ওয়ান টু-ওয়ান যোগাযোগের নতুন উপায় ডিজিটাল দাঁত বা দাঁত ফোন। এটি দাঁতে বসানো একটি ফিচার ফোন ও অডিও টুথ ইমপ্ল্যান্ট। অত্যাধুনিক তারবিহীন এই প্রযুক্তির পুরোটাই মাইক্রো গ্রাহক ও প্রেরক যন্ত্র। এতে রয়েছে ক্ষুদ্রতম অডিও ইনপুট, আউটপুট, রিসিভার, ট্রান্সমিটার ডিভাইস। এটি ডিজিটাল সংকেত গ্রহণ ও প্রেরণ করতে পারে। দাঁত ফোন দিয়ে আপনি ইচ্ছে মতো ফোন কল করতে পারবেন। ড্রাইভিং, গলফ, বা ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে খেলতে নিজের পছন্দ মাফিক যে কোন গান শুনতে পারবেন, রেডিও শুনতে পারবেন এমনকি স্টক মার্কেটের সর্বশেষ আপডেট তথ্যও জানতে পারবেন। এখন ক’টা বাজে? জানতে চেয়ে আপনার সঙ্গীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বিরক্ত করতে হবে না। এই এই ডিজিটাল দাঁত ঠিকঠাক ঘড়ির অডিও এলার্মে আপনাকে সময় জানিয়ে দেবে। যা কেবলই আপনি আপন মনে শুনতে পাবেন। অন্য কেউ নয়। এতে রক্ষা হবে নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা।

ডিজিটাল দাঁত যন্ত্রটা ক্ষুদে হলে কী হবে। মাইক্রো প্রযুক্তিটি তারবিহীন। মুখমন্ডলের পেছনে অবস্থিত পেষণ দাঁতের ফাঁকে সংযুক্ত থাকে এই দাঁত ফোনের পূর্ণাঙ্গ সেট। দাঁত ফোনের অ্যান্টেনা হিসেবে কাজ করে মুখ মন্ডলের চোয়াল। রিসিভার কাজ করে মাথার সঙ্গে। ফোন এলে মুদু কম্পনের মাধ্যমে জানান দেয়। মাইক্রো ভাইব্রেশন হয়। দাঁত থেকে শব্দ সঞ্চারিত হয়ে অন্তকর্নে প্রবেশ করে মুখের চোয়ালের হাড়ের মাধ্যমে ডিজিটাল সিগন্যল পরিবাহিত হয় এবং অডিও হিসেবে কনভার্ট হয়ে যায়। এক কথায় অন্যপ্রান্তের শব্দ দাঁত থেকে স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্ক হয়ে পুনরায় অন্তকর্ণে গিয়ে পৌঁছায়। আর ফোন করবেন? নম্বর বোতামে চাপ দেওয়ার কোন দরকার নেই। যাকে আপনি ফোন করতে চান, মুখে শুধু তার নাম উচ্চারণ করলেই হলো। আর সুইচ বন্ধ ও অন করার সব কাজ জিহবা দিয়েই করা যায়। সাধারণ মোবাইল ফোন মডিফাই করে ক্ষুদ্র আকারে বানানো হলেও এটি অনেক শক্তিশালী কার্যক্ষমতা সম্পন্ন। দূরের নেটওয়ার্ক সিগন্যাল গ্রহণ ও প্রেরণে সক্ষম। ভাইব্রেশন হয় মলিকিউল্যার লেভেলে। যে কারণে ব্যবহারকারী একদম পিউর সারাউন্ড স্টেরিও সাউন্ড উপভোগ করে থাকেন। 

‘এমআইটি মিডিয়া ল্যাব ইউরোপ’ এর গবেষণা এসোসিয়েটস- জিমি লাজিও এবং জেমস অগার নামে দু’জন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উদ্ভাবন করেছেন এই দাঁত ফোন। লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামে গেলো শুক্রবার এটি প্রদর্শন করা হয়। সায়েন্স মিউজিয়াম এবং রয়েল কলেজ অব আর্টস এর উদ্যোগে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিলো- বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, ডিজিটাল প্রযুক্তিকে সর্ব সাধারণের বোধগম্য করে তোলা এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্ভাবনী মেধা খুঁজে বের করা। আয়োজিত প্রদর্শনীতে দাঁত ফোন সহ প্রদর্শন করা হয় আগামী দিনের সম্ভাব্য নানান প্রযুক্তি প্রোডাক্টস সম্ভার। ‘ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর সায়েন্স টেকনোলজি এন্ড আর্টস’ (নেসতা) মুখপাত্র জো মিনি বলেন- ‘দাঁত ফোন ব্যাক্তিগত যোগাযোগে এক নতুন ধারণা বৈকি! জেম এবং জিমির ডিজাইন করা এই দাঁত ফোন কিছু বাস্তব বিষয় উম্মোচন করেছে। তা হলো মানুষ তার শরীরে বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে, গোপনীয়তা ভেঙ্গে আগামী দিনে কত কিছুই না করতে পারে? আগামী দিনে ডিজিটাল প্রযুক্তির কর্ম সম্ভাবনার কোন শেষ নেই। দাঁত ফোনের মাধ্যমে তারই একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে মাত্র।’ 

নিজ হাতে নিজের দাঁতে বসানো যায় এই দাঁত ফোন। এজন্য ডেন্টাল ক্যানাল সার্জারির দরকার পড়ে না। ইচ্ছে মতো যখন তখন নিজে নিজেই খুলে ফেলাও যায়। এছাড়া ব্যবহারকারী তার নিজের যে কোন ইচ্ছে অনুযায়ী শরীরের যে কোন স্থানে স্থাপন করে ব্যবহার করতে পারেন এই দাঁত ফোন। বিজ্ঞানী জেমস অগার জানান, ‘দাঁত ফোনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রচলিত মোবাইল ফোন থেকেও কম। সাধারণ ফোনে যে শব্দ তরঙ্গ আমরা কানে শুনতে পাই তাতে থাকে বাইরের বাতাসে ভেসে বেড়ানো অনাকাঙ্খিত নানান দূষিত শব্দ তরঙ্গ। বাইরের এই অবাঞ্চিত শব্দ প্রচলিত মোবাইল ফোনের রিসিভার ও স্পীকারের মাধ্যম হয়ে মানুষের কর্ন কুহরে ঢুকে যায়। যে কারণে সিজোফ্রেনিয়া নামক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অথচ এই দাঁত ফোনে সর্বোচ্চ শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রিত হয়। আর সাধারণ স্পীকারের মতো স্টেরিও সারাউন্ড সাউন্ড হলেও পরিবেশে কোন শব্দ দূষণ ঘটায় না।’

দাঁত ফোন দামেও খুব সস্তা। খুব শিগগিরই এই দাঁত ফোন মোবাইল ফোনের বাজার দখল করবে। যেখানে স্মার্টফোন বা অন্য কোন ডিভাইস প্রযুক্তি ব্যবহার ও বহন সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে দাঁত ফোন ব্যবহার করা দরকার হবে। এই দাঁত ফোন সরকারি গোয়েন্দা, গুপ্তচর ও সাংবাদিকদের জন্যে অত্যন্ত ফলপ্রসু হলেও দুস্কৃতিকারী, জঙ্গিরাও এটির অপব্যবহার করতে কসুর করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে সবার জন্য দাঁত ফোন ব্যবহার সুখকর নাও হতে পারে। কারণ যখন আপনার দাঁত আপনার সঙ্গে কথা বলবে, তখন পাশের জন কিছুই শুনবে না। বুঝবে না। শুধু আপনিই শুনবেন আর আপন মনে কথা বলে যাবেন। আপনার কাছে কোন মোবাইল ফোন না থাকায় অন্য মানুষ আপনাকে নিশ্চিত পাগল বলে ধরে নিতে পারে! ডিজিটাল দাঁত নামের এই মোবাইল ফোনের প্রস্তুতকারক কোম্পানির নাম জেমস আগার এন্ড জিমি লাজিও। 

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
সাই-টেক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত