শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সবারই একটা হিসাব আছে

মোহাম্মদ শাহ আলম

১৪:১৫, ১ মে ২০২১

আপডেট: ১৫:২৩, ১ মে ২০২১

৮১৮

সবারই একটা হিসাব আছে

বারান্দায় খুব একটা বসা হয় না। সেদিন কেন জানি একটু বসলাম। সম্ভবত প্রচন্ড গরমে একটু স্বস্তির আশায়। বসেই চোখ আটকে গেল একটা ট্রাকের দিকে। ট্রাকটা মাত্রই এসে থেমেছে আমার বারান্দার সামনের রাস্তায়। ট্রাকে তিনজন মানুষ। ড্রাইভার আর দুজন শ্রমিক। আজ মে দিবসে শ্রমিকদের নিয়ে একটু আলাপ মন্দ হবে না বোধ করি। তাও আবার তরতাজা ঘটনা।

তো ট্রাকখানা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। ট্রাকটা থামার সাথে সাথেই দুই শ্রমিক ব্যস্ত হয়ে গেল ত্রিপল সরাতে। এমনভাবে কাজটা করছে যেন খুব দ্রুত কাজটা সারতে হবে। তাদের তড়িঘড়ি দেখে আমি আরো মনযোগী হলাম। কী আছে ট্রাকে? দ্রুতই উত্তর মিলল। বালি। ট্রাকের কার্নিশ সমান। হয়তো ঠিক সমান নয়। বালুর উপরিতল কার্নিশ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচুও হতে পারে। সে যাক গে। ত্রিপল সরিয়ে রাখা হয়েছে। এবার চালক সাহেব পিছনে এলেন। আরও দ্রুত কাজ করার তাগিদ। শ্রমিক দুজন কথা বলছেন না। কাজে ব্যস্ত। দুজনের হাতে বেলচা। বালু সরাচ্ছে। ট্রাকের বালু ট্রাকেই সরানো হচ্ছে। আজব কান্ড। ঘটনার আগামাথা বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমে ট্রাকের শেষ প্রান্তের বালি বেলচা দিয়ে তুলে মাঝখানে ফেলা হচ্ছে। পেছন দিকটা একটু খালি হয়েছে বটে তবে মাঝখানটা উঁচু হয়েছে। এবার পেছন থেকে সরে এলেন দুজন। দুজন বেলচা হাতে দুপাশে। দুজন দুপাশের মাটি সরাচ্ছেন। ঐ একই কাজ। পাশের বালি তুলে মাঝখানে ফেলছেন। মাঝখানটা আরও খানিকটা উঁচু হয়েছে। শেষে বেলচা দিয়ে বালিটাকে সমান করে শ্রমিক দুজন চালকের পেছনের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়ালেন। আর ত্রিপল টানালেন না। মিনিট দশেকের মধ্যে কাজ শেষ। ট্রাকখানা তার গন্তব্যের জন্য দ্রুতই প্রস্থান করল।

কী বুঝলাম জানি না। অথবা যা বুঝলাম তা ঠিক বুঝলাম কি না তাও জানি না। তবে এই ঘটনার সাথে অনেক পুরোনো একটা ঘটনা মনে পড়ল। সম্ভবত তখন ক্লাস এইটে পড়ি। চৈত্র্য মাস। আমাদের খেতের গম পেকেছে, কাটতে হবে। ৪-৫ জন বদলি নেয়া হয়েছে। আমাদের এলাকায় কৃষি শ্রমিককে বলা হয় বদলি। বদলিরা সকাল সাতটা থেকে যোহরের আজান পর্যন্ত কাজ করবে। আব্বা আমাকেও একজন বদলি হিসেবে বিনা মজুরিতে নিয়োগ দিয়েছেন। আসল বদলিদের দেখাশোনার জন্য। খেতটা অনেক বড়। একদিনে সম্পূর্ণ গম কাটা শেষ হবে না। আব্বার ধারণা অর্ধেক শেষ হবে। সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ধুমছে কাজ চলল। নয়টায় নাস্তা খাবার বিরতি। সবাই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। ওদের খাওয়া শুরু করলে আমি বাড়ি যাই। আমি বাড়ি থেকে নাস্তা খেয়ে এসেও দেখি ওরা বসে আছে। নাস্তা পর্ব শেষ করে বিড়ি পর্ব চলছে। আব্বা আসেননি। আব্বার হয়তোবা ধারণা ছিল আমি সাথে থাকলে বদলিরা সময় নষ্ট করবে না। এখন আমার মনে হচ্ছে আমি সাথে থাকাতে ওদের ফাঁকি দেয়ার প্রবনতা বেড়েছে। তো এগারোটার দিকে দেখা গেল খেতের চারভাগের এক ভাগও কাটা শেষ হয়নি। হাতে আছে দুঘণ্টা। আসলে এক ঘন্টা। কারন বারোটা থেকে গমের আটি বাড়ি নেয়া শুরু করবে। হঠাৎ করে ওদের স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করল। পাঁচজন পাঁচদিক থেকে কাটা শুরু করল। এতক্ষণ সবাই কাটছিল একদিক থেকে। মানে খেতের পূর্বদিকে কেটে কেটে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। ওদের এই অবস্থা দেখে আমি জানতে চাইলাম আপনারা চারদিক থেকে কাটছেন কেন? জবাব তৈরিই ছিল। তোমার আব্বারে কী জবাব দিমু। দেহ না মাত্র কতটুকু কাটছি। চারদিক থেকে কাটলে মনে হবে অনেক কাটছি। বুঝছ? জ্বী, বুঝছি। সেই সাথে আরো বুঝছি এখানে আমার থাকা না থাকা সমান।

দুটো ঘটনার মধ্যে একটা বিষয় এসে মিলে যাচ্ছে। তা হলো মালিককে হিসেব দিতে হবে। তারা নিজেদের মতো করে একটা হিসেব করেছে। এই হিসেবটা একটু ফাঁপানো। একই বালি এমনভাবে সাজিয়েছে যেন মনে হয় ট্রাক বোঝাই বালি। যা আনার কথা ছিল তার থেকে আরো বেশি এনেছে। মালিক খুশি হবে। দু’পয়সা বখশিস দেবে। গম কাটার সেই একই দৃশ্য। যা কাটার তাই কেটেছে বা নানান বিরতির কারনে কম কেটেছে। কিন্তু দেখাতে হবে বেশি। বেশি দেখিয়েছে। মালিকগণ হয়তো খুশি হয়েছে। মালিকের এই খুশির কারণ আসলে অকারণ। ফাঁপা। লোক দেখানো।

এই বিষয়টির কারন খুঁজতে গেলে হয়তো আর্থ-সামাজিক অনেক কার্যকারণ সম্পর্ক উঠে আসবে। হাজার বছরের বঞ্চনার ইতিহাস উঠে আসবে। অসম সমাজ ব্যবস্থায় খাপ-খাওয়ানো বা টিকে থাকার কৌশল আলোচনায় আসবে। তবে সে যাই হোক শ্রমিক শ্রেণী যে অবহেলিত, নিগৃহীত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই শ্রমিকদের ঘাম ও শ্রমের উপর দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বের তাবৎ সুদৃশ্য স্থাপনা অথবা নামকরা সব ব্র্যান্ড।

তো শেষ করার আগে, ছোট্ট এবং সাধারণ একটা গল্প বলা যাক। 

এক কৃষি শ্রমিক কাজ করে এক গৃহস্থের বাড়িতে। দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে কৃষি কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে সে। তার এই দক্ষতা দেখে পাশের গ্রামের আরেক গৃহস্থের খুব ইচ্ছা এই শ্রমিকটিকে ভাগিয়ে নেয়। সময় সুযোগ পেলে শ্রমিকটির সাথে এটা সেটা আলাপ করে। তার বাড়িতে শ্রমিকরা কত কত সুবিধা পায় তার বয়ান করে। এই করতে করতে একদিন খুব আক্ষেপ করে লোকটি বলে, তোর জন্য আমার অনেক মায়া হয় রে ফজর। ঐ বাড়িতে তোর কত খাওয়ার কষ্ট । লোকটা টেনে টেনে আরো বলে, তোকে সেইইইইইই স....কা....লে এ...ক...বা...র খে...তে দে...য়য়য়, আ...বা...র সে...ই বি...কা...লে। তুই যদি আমার বাড়ি আসিস তাইলে তুই সকাল-বিকাল খেতে পারবি। কোন কষ্ট হবে না। চলে আয় আমার বাড়ি। রাজার হালে থাকবি।

আগের লেখা পড়ুন:

‘স্যার’ বলবেন না প্লিজ, ‘ভাই’ বলবেন 

‘খেজুরে আলাপ’

আমাদের অফিসে যেদিন প্রথম কম্পিউটার এল

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank