শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

খেজুরে আলাপ

আমাদের অফিসে যেদিন প্রথম কম্পিউটার এল

মোহাম্মদ শাহ আলম

১৩:২৫, ১৭ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ১৬:৩৪, ১৭ এপ্রিল ২০২১

১১৬৪

খেজুরে আলাপ

আমাদের অফিসে যেদিন প্রথম কম্পিউটার এল

খেজুরে আলাপে যে খেজুর নিয়ে আলাপ হয় না সে কথা গেল পর্বে বলেছি। আলাপ হয় দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, জগত-সংসার, প্রেম-ভালোবাসা, পরচর্চা-পরনিন্দা, ধর্ম-অধর্ম, নিজকিয়া-পরকিয়া, সাহিত্য, সিনেমা, গান-গল্প আরো কত কী! তবে হ্যাঁ, কী নিয়ে আলাপ হবে তা নির্ভর করে যারা আলাপের অংশীজন তাদের উপর। ধরা যাক কোন এক খেজুরে আলাপে বসেছে দুই কম্পিউটার অপারেটর। তারা অবশ্যই আলাপ করবে কম্পিউটারের নানান খুঁটিনাটি নিয়ে। সফটওয়ার-হার্ডওয়ার নিয়ে। একজন হয়তো বলল, কম্পিউটার চালাতে কিবোর্ড চালানোটা ভালোমত বুঝতে হবে। বাটনগুলো কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন বাটনে চাপলে কী কাজ হয় তা জানাটা জরুরী! আরেকজন হয়ত বলল, কথা সত্য, তবে সময়মত এন্টারবাটন চাপতে জানাটাও জরুরি। না হলে কিন্তু সব বিফলে যাবে। তখন প্রথমজন হয়তো বলে উঠল, যথার্থ বলেছেন তবে স্পেস বাটনও কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এবং সেই সাথে এক্সিট বাটনও। কখন একটু বিরতি দিতে হবে এবং কখন বেরিয়ে পড়তে হবে তা জানাটা খুব দরকারী। সে যাক গে। কম্পিউটার নিয়ে খেজুরে আলাপ জমে উঠতেই পারে। তবে আজ এখানে সত্যি সত্যি কম্পিউটার নিয়ে আলাপ করব।

ঘটনা প্রায় কুড়ি বছর আগের। আমাদের অফিসে কম্পিউটার কেনা হলো। সে এক হুলস্থুল কারবার। কম্পিউটার না থাকলে নাকি অফিসের জাতকুল থাকে না। আমাদের এমডি সাহেব কোথাও শুনেছেন, একটা কম্পিউটার একাই কয়েকজনের কাজ করে ফেলতে পারে। তাছাড়া, এমডি স্যারের বন্ধুর কোম্পানিতে কম্পিউটার বসেছে, এখানে না থাকলে কি চলে! 

যেই কথা সেই কাজ। কম্পিউটার কিনতেই হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে কম্পিউটার সাহেব এসে হাজির। কম্পিউটার বসবে কোথায়? অফিসের শেষ দিকের একটা রুম সাব্যস্ত হলো। নিরিবিলি রুম। রুমে এসি লাগানো হলো। রুম নাকি ঠান্ডা রাখতে হবে। কম্পিউটার সাহেব নাকি গরম সহ্য করতে পারে না। ভাইরাসে আক্রান্ত হন। কম্পিউটার সেট করার জন্য একজন প্রকৌশলী ডাকা হলো। তিনি এসে কম্পিউটার সেট করলেন। শুধু সেটই করলেন না। সেই সাথে ১১ দফা নীতিমালা তৈরি হলো। নীতিমালার একটি কপি অফিসের নোটিসবোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া হলো। নীতিমালার ১১ দফা পড়ে সকলেরই মন বেশ ক্ষুন্ন হলো। হবেই না কেন বলুন! নীতিমালা যদি এমন হয়।

অফিসে কম্পিউটার বিষয়ক নীতিমালা-
সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আমাদের কোম্পানিকে যুগের সাথে মিল রেখে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। অফিসে একটি কম্পিউটার সংযোজিত হয়েছে। এই আধুনিক যন্ত্রটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে নিচের নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য।

বিনা অনুমেতিতে কম্পিউটার কক্ষে প্রবেশ করা যাবে না।
যদি অনুমতি সাপেক্ষে প্রবেশ করতেই হয় তবে অবশ্যই জুতা খুলে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে।
কম্পিউটার কক্ষে প্রবেশের আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। সে লক্ষে কম্পিউটার কক্ষের পাশে একটি বেসিন বসানো হয়েছে।
একসাথে একজনের বেশি প্রবেশ করা যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষের ভিতরে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষে প্রবেশের পর কোনকিছুতে হাত দেয়া যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষের ভিতরে কোনকিছু পানাহার করা যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষের সামনে হাঁটাহাঁটি করা যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষের সামনে হাঁচিকাশি দেয়া যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষের সামনে হাসাহাসি করা বা আড্ডা দেয়া যাবে না।
কম্পিউটার কক্ষে উঁকি-ঝুঁকি দেয়া যাবে না।

নীতিমালা ভালো হয়েছে। এমডি স্যার এর সফলতা দেখেছেন। গেল কয়েকদিনে তিনি লক্ষ্য করেছেন কোন স্টাফ কম্পিউটার রুমের দিকে পা বাড়াননি। অফিসে হাসি-ঠাট্টা কমেছে সেই সাথে হাঁচিকাশিও। অফিসের এক সাপ্তাহিক সভায়, আমাদের মনির সাহেব বুকে বল নিয়ে এমডি স্যারকে জিজ্ঞেসই করে বসলেন, স্যার আমাদের সকলেরই কম্পিউটার শেখা দরকার। কিন্তু রুমে প্রবেশ নিষেধ। কম্পিউটার তাহলে চালাবে কে স্যার? জবাব যেন তৈরি ছিল এমডি স্যারের। তার আগে এমডি স্যারের প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞানের একটু ধারণা দেয়া দরকার। 

তখন মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেশ শুরু হয়েছে। স্যারের বন্ধুমহল সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। কিন্তু স্যার মোবাইল ফোন ব্যাবহার করবেন না। কারণ এতে প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না। তাছাড়া প্রতি মিনিটে চলে যায় সাত টাকা। আর মিটিংয়ের মাঝখানে যখন নানান ঢঙে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে সেটা নাকি অসহ্য একটা ব্যাপার। তাই ল্যান্ড ফোনই ভালো। কিন্তু তাতে কী চলে! স্যারের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। স্কুলে যায়। তাদের বন্ধুবান্ধবীদের মা-বাবারা মোবাইল ফোন নিয়ে স্কুলে আসে। তাই ওদের বাবাকেও একটা ভালো মোবাইল ফোন কিনতে হবে। তাই স্যার অগত্যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটা মোবাইল ফোন কিনবেন। মোবাইলের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে একটা ধারণা মনে হয় স্যারের তৈরি হয়েছে। যেহেতু ছেলেমেয়েরা বলেছে একটা ভালো ফোন কিনতে হবে। তো একদিন আমাদের কয়েকজনকে সামনে পেয়ে জানতে চাইলেন, যদিও পছন্দ করি না তবুও একটা মোবাইল ফোন কিনতেই হচ্ছে। বলেন তো গ্রামীণ ফোন ভালো হবে না নোকিয়া ভালো হবে? 

শিবের গীত রেখে এবার চলেন ধান ভানতে ফিরে আসি। জী, স্যারের জবাব তৈরিই ছিল। স্যার বললেন, কে আবার? আমাদের ফজলু! বোঝাই যাচ্ছে, স্যার আগে থেকেই ফজলুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। ফজলুই হবে অফিসের কম্পিউটার অপারেটর। ফজলু এই অফিসের অফিস সহকারী। এমডি স্যারের ফায়ফরমায়েশের কাজ করে। সবাই চুপ। কেউ কথা বলছে না। সেই আবার মনির সাহেব, স্যার সিদ্ধান্তটা আরেকটু ভেবে দেখলে হতো না! টেকনিক্যাল একটা বিষয়। স্যার এবার মোক্ষম কথাটা বললেন, শোনেন মনির সাহেব, ফজলু এখানে জয়েন করার আগে পাঁচ বছর কম্পাউন্ডারের কাজ করেছে। অভিজ্ঞতার একটা ব্যাপার আছে না। তাই আমি মনে করি ফজলুই কম্পিউটারের কাজটা ভালোমত করতে পারবে, বুঝলেন।

তো হয়ে গেল। ফজলু অফিসের কম্পিউটার অপারেটর। তাকে দু’সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হলো। ফজলু সকাল সকাল অফিসে এসে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, জুতাজোড়া বাইরে রেখে কম্পিউটার রুমে ঢোকে। স্যারের চিঠিপত্র টাইপ করে। অফিসের নোটিস টাইপ করে, প্রিন্ট করে, নোটিসবোর্ডে টানায়। আমরা কম্পিউটার কম্পোজ করা নোটিস পড়ি। শেষ যে নোটিসটা পড়েছিলাম, তা ছিল হাতে লেখা। অবাক হয়েছিলাম। পড়ে দেখলাম, কম্পিউটার ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে। কে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে তা খুঁজে বের করা হবে। সে জন্য একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মোহাম্মদ শাহ আলম: লেখক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank