মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ || ৫ চৈত্র ১৪৩০ || ০৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই

অনুবাদ: আসাদ আলম সিয়াম

১৫:১৭, ৫ অক্টোবর ২০২০

আপডেট: ২৩:৪৪, ৭ অক্টোবর ২০২০

৪৩৭৪

সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই

ফ্রিডা হিউজ
অনুবাদ: আসাদ আলম সিয়াম


[ সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই – ‘এরিয়েল’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর স্বামী কবি টেড হিউজের সম্পাদনায়, ১৯৬৬ সালে, সিলভিয়ার মৃত্যুর তিন বছর পরে। এ বইয়ের পান্ডুলিপি সিলভিয়া মারা যাবার পর তাঁর পড়ার টেবিলে ‘এরিয়েল’ নামের একটা ফোল্ডারে পাওয়া গিয়েছিলো। টেড হিউজের সম্পাদিত বইটিতে সিলভিয়া যেভাবে তাঁর কবিতাগুলো নিজের ফোল্ডারে বিন্যস্ত করে গিয়েছিলেন, সেভাবে কবিতাগুলো সাজানো হয়নি। টেড হিউজ, ফোল্ডারের বেশ কিছু কবিতা তাঁর সম্পাদিত ‘এরিয়েল’ বইটিতে বাদও দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে সিলভিয়া তাঁর পান্ডুলিপিতে কবিতাগুলো যে ক্রমে ও বিন্যাসে সাজিয়ে গিয়েছিলেন, সেভাবে আরেকটি সংস্করণ বের হয় ‘এরিয়েল’ এর।  এই বইয়ে সিলভিয়ার পান্ডুলিপির অনুলিপিও সংযুক্ত করা হয় তাঁর পরিমার্জন সহ। 

বইটির ভূমিকা লেখেন টেড হিউজ ও সিলভিয়া প্লাথের মেয়ে ফ্রিডা হিউজ। ফ্রিডা নিজেও একজন কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পী। ফ্রিডা, নিউ ইয়র্কে এই দ্বিতীয় ‘এরিয়েল’ বইটির সার্বজনিক পাঠ অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য রেখেছিলেন এ লেখাটি তারই অনুবাদ। এতে টেড হিউজ, সিলভিয়া প্লাথ ও ফ্রিডার হিউজের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে কিছু বক্তব্য রয়েছে ফ্রিডার। - অনুবাদক।]


যখন হার্পার কলিন্সের ডেভিড সেমাঙ্কি – যিনি ‘এরিয়েল’ এর এই সংস্করণটির সম্পাদনা করেছেন, আমাকে প্রস্তাব করেন যে আমার মায়ের এই কবিতাগুলো মায়ের করা মূল বিন্যাসে প্রকাশ করলে তা একটা উল্লেখযোগ্য বই হয়ে উঠবে, তখন আমার মনে হয়েছিলো যে এটা একটা খুবই চমৎকার পরিকল্পনা। আমার মনে হয় যে আমার বাবা ১৯৬৬ সালে ‘এরিয়েল’ এর কবিতাগুলো যেভাবে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেছিলেন তার বিপরীতে আমার মায়ের করে যাওয়া বিন্যাসে ‘এরিয়েল’ প্রকাশিত হলে তা বেশ একটা আগ্রহোদ্দিপক বিষয় হবে। আমার বাবা যেভাবে কবিতাগুলো সাজিয়েছিলেন তাতে তিনি তাঁদের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের আহত করতে পারে এমন বেশ কিছু কবিতা বাদ দিয়েছিলেন। বাদ দিয়ছিলেন সেইসব কবিতাও যা তিনি দূর্বল মনে করেছিলেন, মায়ের সেইসব কবিতার তুলনায় – যে কবিতাগুলো দিয়ে তিনি ঐ কবিতাগুলো প্রতিস্থাপন করেছিলেন। সম্পাদনার জন্য তিনি নিজের জন্য যে সীমা নির্ধারণ করেছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন তার মধ্য থেকে যেন মায়ের বইটি সেরা বই হয়ে ওঠে।

বাদ দেয়া কবিতাগুলো কিন্তু মায়ের সমগ্র রচনাবলীতে পাওয়া যেতো। কিন্তু তা আমাদের আজকের সংকলনটির মতো নয়, যা কিনা নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই পুনঃসন্নিবেশিত সংস্করণটি আমার মায়ের মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাঁর নিজের করে যাওয়া কবিতার বিন্যসাটিকে সম্মান করেছে এবং তাঁর মূল পান্ডুলিপির একটি অনুলিপি অন্তর্ভুক্ত করেছে। পক্ষান্তরে আমার বাবার সম্পাদিত বইটির বিন্যাস, আমার মা তাঁর লেখার টেবিলে ‘এরিয়েল’ ফোল্ডারে যে কবিতাগুলো রেখে গিয়েছিলেন – তার মধ্যে  থেকে তাঁর জীবনের শেষমুহূর্তগুলোর সেরা ও বলিষ্ঠ কবিতাগুলোকে সারা পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেছে। 

যখন ডেভিড আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে এই বইটির ভূমিকা আমি লিখবো কিনা, আমি কল্পনা করি যে এ কাজে মায়ের লেখার মধ্য দিয়ে আমি তাঁর সাথে কিছুটা সময় কাটাবার সুযোগ পাবো, যা কিনা এর আগে আমার কখনোই করা হয়ে ওঠেনি। কারণ, আমার বয়স পয়ত্রিশ হবার আগ পর্যন্ত আমি তাঁর কোন কবিতাই পড়িনি। প্রকৃতপক্ষে আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমার বাবার কিছু শিশুতোষ কিছু কবিতা ছাড়া, আমি তাঁরও কোন কবিতা পড়িনি।

আমার বাবা ও মায়ের কবিতা আমার স্কুলের পাঠ্যসূচীতে ছিলো। কিন্তু আমি আমার শিক্ষকদের ক্রমাগত অনুরোধ করতাম যাতে তাঁদের সেই কবিতাগুলোকে আমাকে পাঠ্য হিসেবে পড়তে না দেওয়া হয়। কারণ, যদি আমি পরীক্ষায় কম নাম্বার পেতাম তবে তার অর্থ দাঁড়াবে যে আমার বাবা তাঁর নিজের এবং মায়ের কবিতা সম্পর্কে আমাকে যে ধারণা দিয়েছিলেন – তা ভুল। আর যদি আমি বেশী নম্বর পেতাম, তবে সে হবে উওর আগে থেকে জেনে গিয়ে একধরণের নকল করা, তা যতই আমি বাবার দেয়া ধারণাগুলো ধর্তব্যের মধ্যে না নেই।

কিন্তু এছাড়াও, বাবা-মার লেখা কবিতা না পড়তে চাওয়ার আমার আরো অনেক ব্যক্তিগত কারণ ছিলো। বয়ঃসন্ধির এক একরোখা বালিকা হিসেবে আমি চাইতাম না যে আমার নিজের কবিতা তাঁদের কবিতার সুরে প্রভাবিত হোক – বিশেষ করে যখন আমি নিজেই আমার স্বকীয় কবি সত্তাকে খুঁজে পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, তাও আবার আমার জীবনের সেই সময়ে যখন ‘কবি’ আর ‘বাবা-মা’ শব্দ দু’টো আমার কাছে সমার্থক ছিলো।

আরেকটা কারণ ছিলো যে আমার সারাটা জীবন গণমাধ্যম আর অন্যান্য কৌতুহলী এবং আগ্রহী গোষ্ঠীগুলো এত পৌনঃপৌনিকভাবে আমার মায়ের মৃত্যুকে আলোচনায় নিয়ে আসতো যে তাঁকে হারানোর কষ্টটা আমার সবসময়ই টাটকা আর সাম্প্রতিক মনে হোতো, যেন এই মাত্রই তিনি মারা গিয়েছেন। আমার প্রায়ই মনে হতো যে তিনি যে এত বিখ্যাত তার একমাত্র কারণ তিনি আত্মহনন করেছিলেন। আর মনে প্রাণে চাইতাম যে তাঁর আত্মহত্যাকে যেন এত গুরুত্ব দেওয়া না হয় যে অন্যদের চোখে এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হয়ে ওঠে; অথবা তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে যার চারপাশে তাঁর কবিতাগুলো নিছক অনুচিন্তন হয়ে আবর্তিত হতে থাকে। ফলে যখনই কোন বইয়ের দোকানে আমার মায়ের কোন বই হাতে তুলে নিয়েছি, কল্পনা করেছি যে তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তবে কেমন হতো, একসময় আবিষ্কার করেছি যে আমি কাঁদছি আর দোকান থেকে বের হয়ে গিয়েছি।

তাই ১৯৯৫ সালে আমার প্রথম কবিতার বই সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার বাবা মায়ের কবিতা এড়িয়ে চলেছি। শুধুমাত্র তার পরেই আমি আমার মায়ের বই ‘উইন্টার ট্রিজ’ থেকে তার কিছু কবিতা ও বাবার নির্বাচিত কবিতার বই থেকে তার আধা ডজন কবিতার উপর হালকা চোখ বুলাই। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার যে প্রান্তে আমি তখন থাকতাম, সেখানকার বইয়ের দোকানগুলোতে তখন এই বইগুলোই পাওয়া যেতো। তাদের কবিতাগুলো আমি চুপিসারে পড়তাম শুধু নিজেকে এই সন্তুষ্টি দেবার জন্য যে আমি তাদের মতো লিখিনি।

কিন্তু ১৯৯৭ সালে – বাবা মারা যাবার একবছর আগে – তিনি তাঁর ‘বার্থ ডে লেটার’ বইয়ের পান্ডুলিপি আমাকে পাঠালেন এবং জানতে চাইলেন ঐ বইয়ের কবিতাগুলো সম্পর্কে আমার মতামত কি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর আমার বাবা কবিতায় তাঁর সাথে যে মর্মভেদী আলাপচারিতা চালিয়ে গেছেন তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। কবিতা ছিলো তাঁদের মধ্যে যোগাযোগের গতানুগতিক ভাষা। আর বাবা মায়ের মৃত্যুর পরও কবিতায় তাঁর সাথে সেই কথোপকথন করে গেছেন।

তারপর গতবছর, আমার বাবার কবিতা সমগ্রের প্রকাশনা উপলক্ষে আমাকে একটা লেখা লেখবার জন্য অনুরোধ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে আমি যে আমার কবি বাবা-মায়ের মেয়ে, সে সম্পর্কে কম বিব্রত হতে শিখেছি এবং এটা মেনে নিয়েছি যে তাঁরা আমার পরিচয়ের ও আমার অংশ বিশেষ, যেমন আমিও তাঁদের অংশীদার বটে। “বাঘ থেকে বাঘেরই জন্ম হয়, তাদের দেখতেও বাঘেরই মতো লাগে, এক মাংসই তাদের আহার, আর নিজেদের ডোরাকাটা দাগ সম্পর্কে তাদের কোন অভিযোগ থাকেনা” ( ফ্রিডা হিউজের কবিতা, বই - ‘উরুলু’, হার্পার পেরিনিয়েল, ১৯৯৫)।

আমি আশা করেছিলাম যে বাবার কবিতায় এভাবে নিমগ্ন হতে পারলে তা আমাকে আমার মায়ের কবিতাতেও মগ্ন হবার শক্তি জোগাবে। কারণ মায়ের কবিতা এড়িয়ে যাবার মধ্য দিয়ে আমি আসলে বাবার সাথে তাঁর সম্পর্কের ইতিবৃত্ত, বিষাদ্গ্রস্থতার সাথে তাঁর সার্বক্ষনিক লড়াই এবং তাঁর মৃত্যুর খুঁটিনাটি ইত্যাদি গভীরভাবে অনুসন্ধান করাকে এড়িয়ে গেছি। আমি নিরন্তর কঠিন সত্যটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি – বিশেষ করে যখন তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন তখন আমি যে সেখানেই ছিলাম, সেটাকে। এসব নিয়ে ভাবা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক ছিলো। 

অথচ আমি যখন বড় হচ্ছিলাম আমার বাবা কিন্তু তখন আমার মায়ের স্মৃতি আমার জন্য জাগরুক রেখেছিলেন কেননা তাঁকে বাবা ও মা দুজনেরই দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিলো। তিনি এমন কি টেপরেকর্ডারে তাঁর কন্ঠও আমাকে শোনাতেন। আর আমার মায়ের মৃত্যু নিয়ে গনমাধ্যম এবং অন্যান্য উৎসাহী গোষ্ঠীগুলোর আক্রমন থেকে তিনি আমাকে আর আমার ভাইকে বছরের পর বছর রক্ষা করে গেছেন। কিন্তু তাঁকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি যদিও তিনি মায়ের সৃষ্টিকে বরাবর শ্রদ্ধা করে গেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন যে সেগুলো প্রকাশিত হয়।

‘এরিয়েল’ এর এই সংস্করণের ভূমিকা লেখার কাজটি আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে যেখানে আমি – আমার মা যে প্রানশক্তি ও সামর্থ্যের সন্নিবেশ করে এ কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন – তার মধ্য দিয়ে অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে তাঁর জীবনের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি। আমি বুঝতে পেরেছি কিভাবে তিনি আমার বাবার সাথে তাঁর বিচ্ছেদের কষ্ট দিয়ে তাঁর আর সব কষ্টকে সংগায়িত করেছেন, কিভাবে তিনি তাঁর আবেগকে তাঁর সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত করেছেন, কিভাবে তিনি তাঁর প্রত্যেকটা কষ্টকে তাঁর দুঃখবীণার তারে পরিণত করে নিজের জন্য মূর্ছণার সৃষ্টি করেছেন। তাঁর জীবন সংক্ষিপ্ত হতে পারে কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছেন যে তা যেন বৃথা না হয়। আর আমার বাবার সম্পর্কে লোকে যাই ভাবুকনা কেন, তিনি নিশ্চিত করেছেন যে সবাই যেন জানে যে আমার মায়ের জীবন বৃথা নয়। তাই ‘এরিয়েল’ এর প্রত্যেক সংস্করণেরই নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে, যদিও দুটোর ইতিহাস আসলে একই।

আসাদ আলম সিয়াম: কবি ও অনুবাদ।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank