শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১০]

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

১০:৪৮, ১০ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ১২:৪০, ৮ মে ২০২১

১৭৩৭

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১০]

১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

[পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার] [পর্ব- পাঁচ] [পর্ব-ছয়] [পর্ব- সাত] [পর্ব-আট] [পর্ব-নয়]

পর্ব-দশ

রুটি আর পনির গেলা শেষ করলো উইনস্টন। চেয়ারে একদিকে একটু বেঁকে গিয়ে কফির মগে চুমুক দিলো। বামদিকে পেছনের টেবিলের লোকটি তখনও কর্কশ স্বরে তার অবিরাম অবিন্যস্ত কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক তরুণী, হতে পারে তার সেক্রেটারি, উইনস্টনের সঙ্গে পীঠাপীঠি করে বসা, ভদ্রলোকের সব কথায় আগ্রহভরে অবিরাম সায় দিয়ে চলেছে। রিনরিনে নারী কণ্ঠের সে উচ্চারণের দু’একটা উইনস্টনের কর্ণকুহরে পশেছে- ‘আমি মনে করি আপনিই ঠিক, আমি আপনার সাথে একমত’ ধরনের বাক্য। আর উল্টোদিকের বক্তা বকে যাচ্ছেন অবিরাম। মেয়েটি যখন কিছু বলছে তখনও থামছেন না। চোখের দেখায় লোকটিকে চেনে উইনস্টন, ফিকশন বিভাগে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, এটুকুর বাইরে কিছুই জানা নেই তার। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, মোটা গ্রীবা, বড় হা। মাথাটি ইষৎ হেলিয়ে রাখায় তার চশমা জোড়ায় যে আলো পড়েছে তাতে উইনস্টনের চোখে তার চোখ নয়, ধরা পড়ে আছে দুটো ব্ল্যাঙ্ক ডিস্ক। তবে কিছুটা ভয়ের বিষয় হচ্ছে, তার মুখ থেকে যে কথার ফল্গুধারা ছুটছিলো তার মধ্য থেকে একটি শব্দও আলাদা করে বুঝতে পারা ছিলো প্রায় অসম্ভব। মাত্র একটি বারের মতো উইনস্টন ধরে ফেলেছিলো তার কথা- ‘গোল্ডেস্টেইনীয় তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত অবসান’- আর সে কথা দ্রুতই আবার হারিয়ে গেলো অন্যান্য অবোধ্য উচ্চারণে। অন্যদের জন্য এই বকবকানি শোরগোল বা হাঁসের মতোই প্যাঁকপ্যাঁক বই আর কিছুই নয়। আর আপনি যখন শুনতেই পাবেন না লোকটি কি বলছে তখন সেই কথা নিয়ে আপনার মনে সন্দেহও দানা বাঁধবে না। হতে পারে সে গোল্ডস্টেইনের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছে, আর চিন্তা অপরাধী ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরতর শাস্তির দাবি তুলছে, হতে পারে সে ইউরেশীয় সেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ফোঁসফাঁস করছে, নতুবা হতে পারে সে বিগ ব্রাদারের কিংবা মালাবার যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের প্রশংসা করছে- এর কোনও কিছুতেই কিছু আসে যায় না। যাই থাক-না থাক এই বকবকানিতে, মূল সূর একটাই তা হচ্ছে- খাঁটি গোঁড়ামি আর খাঁটি ইংসক। একটি চোখহীন মুখমণ্ডলের চোয়ালটি যখন অবিরত উপর-নিচ করে যাচ্ছিলো, তা দেখে উইনস্টনের মধ্যে একটি কৌতুহলের অনুভূতি কাজ করলো, তার মনে হলো লোকটি আসলে রক্ত-মাংসের মানুষ তো! নাকি স্রেফ একটা কুশপুতুল! লোকটির মস্তিষ্ক থেকে এই কথা বেরিয়ে আসছে না, আসছে তার বাগযন্ত্র থেকে। তার ভেতর থেকে যা কিছু বেরিয়ে আসছে তা বাস্তবিক অর্থে কোনও কথা নয়, কেবলই শব্দের সমাহার; অসচেতনতায় উচ্চারিত হৈচৈ ধ্বনি, ঠিক যেনো হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক।

এক মুহূর্তের জন্য থামলো সাইম, চামচের হাতল ধরে স্ট্যুর মধ্যে নাড়ানাড়ি করছে অবিরাম। অন্য টেবিল থেকে প্যাঁকপ্যাকানি চলছেই, যা চারিদিকের শোরগোলের মধ্যেও সহজেই কানে এসে বাড়ি মারছে। 

‘নিউস্পিকে একটা শব্দ আছে,’ বললো সাইম, ‘তুমি জানো কিনা জানিনা, ডাকস্পিক, মানে হাঁসের মতো প্যাঁক-প্যাঁকানো। এটি সেইসব মজার শব্দের একটি যা একই সঙ্গে দুটি পরস্পর বিরোধী অর্থ দেয়। তুমি তোমার প্রতিপক্ষের কারো সম্পর্কে কথাটি বললে তাকে হেয় করা হবে আর যদি তুমি তুষ্ট এমন কারো প্রসঙ্গে বলো, তাহলে সেটা হবে প্রশংসা।’

প্রশ্নাতীতভাবেই সাইমকে বাষ্পায়িত করে দেওয়া হচ্ছে, আরও একবার ভাবলো উইনস্টন। তার এই ভাবনার মধ্যে একধরনের দুঃখবোধও কাজ করছিলো। যদিও সে ভালো করেই জানতো সাইম তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, কিছুটা অপছন্দ করে আর যদি একটি বারও তার কাছে মনে হয় সে চিন্তা অপরাধী তাহলে তাকে ফাঁসিয়ে দিতে এতটুকু পিছপা হবে না। বোকার মতো কিছু একটা ভুল সাইম করে ফেলেছে। কিছু একটা অভাব ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে: অসাবধানতা, উদাসীনতা, বা নির্বোধের মতো কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছে। ওকে তো ব্যত্যয়কারীদের কেউ একজন বলা যাবে না। ইংসকের নীতিতে বিশ্বাসী, বিগ ব্রাদারের প্রতি বিশ্বস্ত, যে কোনো জয়ে আনন্দের সীমা থাকে না, উৎপথগামীদের ঘৃণা করে, আর তা যে কেবল অত্যন্ত আন্তরিকতায় করে তাই নয়, সীমাহীন উদ্দীপনার সাথেই করে। পার্টির সব তাজা খবরই সে রাখে, যেসব খবর অন্য অনেক সদস্য গায়ে মাখে না তা নিয়েও সে থাকে সমান উদ্দীপ্ত। তারপরেও মৃদু একটা অশোভনতা ওকে যেনো ঘিরে থাকে। ও এমন কিছু বলে, যা না বললেই বরং ভালো হতো, অনেক বই পড়ে, চিত্রকর আর গায়কদের দেখতে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতেও তার নিয়মিত গতায়ত। চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে যাওয়া যাবে না এমন কোনও আইন নেই। নেই কোনও অলিখিত বিধান। তারপরেও স্থানটিকে কেন জানি অশুভ বলেই জ্ঞান করা হয়। দলের পুরোনো, অসম্মানিত নেতারা শেষ ধোলাই হওয়ার আগে এখানেই আড্ডা জমাতো। বলা হয়, দশক কয়েক আগে গোল্ডস্টেইনকেও বার কয়েক ওখানে দেখা গেছে। এই থেকে সাইমের কপাললিখন পড়ে ফেলা খুব কঠিন কিছু নয়। একথা ধ্রুব সত্য, সাইম যদি তিন সেকেন্ডের তরেও উইনস্টনের গোপন এই ধারনার কথা জানতে পারে, তার বিরুদ্ধে থট পুলিশকে নালিশ করে দিতে সে একদণ্ড সময়ও নেবে না। অন্য যে কেউই তাই করবে: কিন্তু সাইম এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে। উদ্দীপনা দেখালেই তা যথেষ্ট নয়। গোঁড়ামি অবচেতনতারই নামান্তর।

মাথা তুললো সাইম। ‘এই ঢুকলো পারসন্স,’ বললো সে।

গলার স্বরে এমন একটা ভঙ্গি ছিলো যেনো সে বলতে চেয়েছিলো, ‘ফালতু নির্বোধটা এলো’। ভিক্টরি ম্যানসন্সে উইনস্টনের প্রতিবেশী পারসন্স, ততক্ষণে রুমের ওপ্রান্তে যাওয়ার যুদ্ধে রত। মাঝারি উচ্চতার মোটাসোটা লোকটার মাথায় সাদা চুল, ব্যাঙমুখো চেহারা। পয়ত্রিশেই তার ঘাড়ে-গর্দানে আর ভুরিতে দলা দলা চর্বি জমেছে। তবে তার হাঁটাচলায় একটা বালকসুলভ ভঙ্গিমা আছে। তার পুরো অবয়বে মনে হয়, ছোট একটা বালক, গায়ে-গতরে একটু বেশি বেড়ে গেছে। নীতি মেনে কাপড় পরেও এই ভাব সে কাটাতে পারে না। স্পাইজের নীল শর্টস, ধূসর শার্ট আর লাল গলবন্ধ ছাড়া পারসন্সকে দেখা যাবে, এমনটা ভাবাও অসম্ভব। তাকে চোখে পড়া মাত্রই দেখা যাবে তার শর্টসের হাঁটুর অংশ আর শার্টের আস্তিন কুঁচকে উপরে উঠে হাত ও পায়ের থলথলে চর্বি তুলে ধরছে। তবে দলের যখন কোনো কর্মসূচি থাকে তখন এই পোশাক ছেড়ে অন্যকিছু পরতেও পারসন্সকে দেখা যায়। ‘হালো, হালো!’ বলে দুজনকেই শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের টেবিলেই বসে পড়লো। আর সাথে সাথে নাকে এসে লাগলো ঘামের গাঢ় গন্ধ। গোলাপি মুখমণ্ডলটা ভেজা ভেজা। তার ঘামের গন্ধের শক্তি অনন্যসাধারণ। কমিউনিটি সেন্টারে যে কেউ টেবিল টেনিস ব্যাটের হাতল ধরে বলে দিতে পারবে পারসন্স খেলে গেছে। সাইম এক পাতা কাগজ তুলে তার মধ্যে লেখা দীর্ঘ একটি কলাম গভীর মনোযোগে পড়তে শুরু করলো। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটি কালির কলম চেপে ধরে সেটি টেনে টেনে পড়ছিলো।

‘দ্যাখো ব্যাটাকে, লাঞ্চের সময়েও কাজ করছে,’ উইনস্টনের গায়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো পারসন্স। ‘কি মনোযোগ, আহা! ওর মধ্যে তুমি এমন কি পাচ্ছো, বুড়ো বালক? আশা করবো, আমার জন্য জ্ঞানের কিছু একটা হবে। স্মিথ, বুড়ো বালক, আরে শোনো, তোমাকেই খুঁজছি। আমাকে চাঁদা দেওয়ার কথা ভুলে গেছো বুঝি!’ 

‘কিসের চাঁদা?’, টাকার ওপর দরদ থেকেই বললো উইনস্টন। প্রত্যেকের বেতনের চারভাগের একভাগই এই স্বেচ্ছাসেবীদের চাঁদার খাতে চলে যায়। আর এরা সংখ্যায় এত বেশি যে আপনি চাইলেও ওদের হিসাব কষে রাখতে পারবেন না।

‘ঘৃণা সপ্তাহের জন্য- তুমি জানো- ঘরে ঘরে আদায় হচ্ছে এই তহবিল। আমাদের ব্লকে আমিই কোষাধ্যক্ষ। উঠেপড়ে লেগেছি- একটা দারুণ কিছু দেখাতে চাই। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, ভিক্টরি ম্যানসন্সের বাইরের ফ্ল্যাগগুলো হবে গোটা সড়কের মধ্যে সবচেয়ে বড়, টাকার অভাবে না পারলে পরে আমাকে দুষবে না, বলে দিচ্ছি। দুই ডলার দেবে বলে কথা দিয়েছিলো তুমি।’

পকেট হাতড়ে কোচকানো, নোংরা দুটি নোট বের করে এগিয়ে দিলো উইনস্টন। পারসন্স ওদুটো ছোট নোটবুকের পাতার ভাজে ঢুকিয়ে দিয়ে তাতে অশিক্ষিত সাবধানি হস্তাক্ষরে টুকে রাখলো।

‘ওহ শোনো, বুড়ো বালক,’ বললো সে। ‘শুনলাম আমার ছোট পাঁজিটা তোমার গায়ে গতকাল গুলতি ছুঁড়েছে। ব্যাটাকে কঠিন করে বকে দিয়েছি। আর বলেছি ফের যদি এমনটি করে আমি ওর গুলতিটাই কেড়ে নেবো।’
 
‘ফাঁসি দেখতে যেতে না পেরে ও মনে হয় একটু বিচলিত ছিলো,’ বললো উইনস্টন।

‘সেটা ভালো- আসলে আমি বলতে চাইছি এমটাইতো হওয়ার কথা, কি বলো? দুটোই পাঁজি ছোট বেয়াদব, কিন্তু ওদের অনুরাগের কথা ভাবো! ওদের চিন্তা জুড়েই আছে স্পাইজ, যুদ্ধ- এগুলো। তুমি কি জানো, গত শনিবার বার্কহ্যামেস্টেডে প্রচার অভিযানের সময় আমার ওই ছোট্ট মেয়েটি কি করেছে? আরও দুটি মেয়ে জুটিয়ে নিয়ে কর্মসূচি থেকে আস্তে করে সটকে পড়ে, আর গোটা বিকেল ওরা এক আগন্তুকের পিছু নিতে থাকে। টানা দুই ঘণ্টা লেজে লেজে কাটিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যখন আমার্শ্যামে পৌঁছায় তখন টহলদারদের হাতে ব্যাটাকে ধরিয়ে দেয়।’

‘ওরা কি জন্য এটা করলো?’ একটু উদ্বেগের স্বরেই বললো উইনস্টন। আর পারসন্স তার খুশির গদগদ ভাবটা ধরে রেখেই বলে চললো: ‘মেয়ে আমার বুঝে ফেলেছিলো লোকটি শক্রপক্ষের চর- ধরে নাও প্যারাসুটে চেপে এসেই নেমেছে। কিন্তু এখানেই কথা, হে বুড়ো বালক। কি বলোতো- মেয়েটিকে নিশ্চয়ই তোমায় সবার সেরা বলতে হবে। সে কি করছে, লক্ষ করেছে ব্যাটার জুতোয়। এক অদ্ভুদ ধরনের জুতো পরেছিলো সে- বললো এমন জুতো আর কাউকে কখনোই পরতে দেখেনি। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় সে বিদেশি। সাত বছরের এক দুধের শিশুর জন্য ভীষণ স্মার্ট একটা কাজ, কি বলো?’

‘লোকটির কি হলো?’ প্রশ্ন উইনস্টনের। 

‘আরে, সেটা জানি না। তবে এ কথা শুনলে মোটেই বিস্মিত হবো না যদি... পারসন্স বন্দুক তাক করার একটি ভঙ্গি করলো আর মুখে ‘ফটাস’ শব্দ করলো।

‘দারুণ,’ অন্যমনষ্ক ভঙ্গিমাতেই উচ্চারণ সাইমের, তবে তার সেই কাগজের লেখা থেকে চোখ তুললো না।

‘অবশ্যই কোনো সুযোগ দেওয়ারই সুযোগ নেই আমাদের’ দায়িত্বের অংশ হিসেবে সম্মতি জ্ঞাপন করলো উইনস্টন।

‘আসলে আমিও তাই বলতে চাই, ঠিক যখন একটি যুদ্ধ চলছে,’ বললো পারসন্স।
 
যেনো সে কথারই নিশ্চয়তা দিতে ঠিক তখনই ওদের মাথার ওপর বসানো টেলিস্ক্রিনে বেজে উঠলো তুর্যনাদ। সেটা অবশ্য কোনো সামরিক য্দ্ধু জয়ের ঘোষণা দিতে নয়, স্রেফ প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের একটি এলান তুলে ধরতে।

‘কমরেডস!’ একটা উত্তেজিত যৌবনদ্দীপ্ত কণ্ঠ বেজে উঠলো। ‘অ্যাটেনশন, কমরেডস! তোমাদের জন্য আমাদের কাছে দারুণ খবর আছে। আমরা উৎপাদন যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। উৎপাদিত সকল ভোগ্যপণ্যের অবিক্রিত অংশের হিসাব বলছে মানুষের জীবনমান যা বেড়েছে তা গেলো বছরের তুলনায় ২০ শতাংশের কম হবে না। গোটা ওশেনিয়া জুড়ে আজ সকালে ফ্যাক্টরি শ্রমিক আর অফিস কর্মীরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, তাদের হাতে ব্যানার, মুখে স্লোগান। তাতে বিগ ব্রাদারের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতারই প্রকাশ। তারা বলেছে, বিগ ব্রাদারের বুদ্ধিমত্তার নেতৃত্বই তাদের নতুন সুখী জীবন এনে দিয়েছে। এখানে কতগুলো পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। খাদ্য সামগ্রী....।'

‘আমাদের নতুন সুখী জীবন’ কথাটি কয়েকবার করে বাজলো। প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় এর ব্যবহার খুব শোনা যায়। সেই যে তুর্যধ্বনি পারসন্সনের মনোযোগ কেড়ে নিলো, এরপর গভীর নিরবতায়, গাম্ভীর্য নিয়ে পুরো ঘোষণাটি শুনলো। পরিসংখ্যানগুলো তার ধরতে পারার কথা নয়; কিন্তু এটা বুঝেছিলো ওগুলো সন্তোষজনক কিছু হবে। বড় সাইজের নোংরা একটি পাইপ বের করে আনলো সে, যার আধাটা পোড়া তামাকে ভরা। যখন তামাকের রেশন সপ্তায় ১০০ গ্রাম, তখন গোটা পাইপ পুরে তামাক টানা কারো পক্ষে কদাচই সম্ভব। অতি সাবধানে আড়াআড়ি করে ধরে রেখে একটি ভিক্টরি সিগারেট ফুঁকছিলো উইনস্টন। আগামীকালের আগে নতুন রেশন মিলছে না, আর তার কাছে মাত্র চারটি সিগারেট মজুদ আছে। বাইরের শোরগোল বাঁচিয়ে টেলিস্ক্রিনের কথাগুলোই শোনার চেষ্টা করছিলো উইনস্টন। বলা হচ্ছে- চকোলেটের রেশন বাড়িয়ে সপ্তাহে ২০ গ্রাম করায় কোথায় যেনো বিগ্র ব্রাদারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মিছিল হয়েছে। মাত্র গতকালই সে চকোলেটের রেশন সপ্তাহে ২০ গ্রামে নামিয়ে আনার পূর্ব ঘোষণাটি ঘঁসে ঠিক করে রেখেছিলো। এও কি সম্ভব মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মানুষ এই নতুন কথা মেনে নেবে! কিন্তু হ্যাঁ, তারা তো মেনেই নিয়েছে। যেমন পারসন্স খুব সহজেই মেনে নিয়েছে, নির্বোধ পশুর মতোই মেনে নিয়েছে। অন্য টেবিলের চক্ষুহীন জন্তুটিও আরও অতিমাত্রার গোঁড়ামি আর গদগদ ভাব নিয়েই মেনে নিয়েছে। আর কেবল মেনেই নেয়নি, গেলো সপ্তাহেও চকোলেটের রেশন ত্রিশ গ্রাম ছিলো এমন কথা যারা ঘুণাক্ষরে মনে আনবে তাদের খুঁজে বের করে নিন্দাবাদ জানিয়ে, বাস্পায়িত করে দেওয়ার উগ্র মনোভাবও পোষণ করছে। সাইম, সেও- তবে আরেকটু জটিল উপায়ে, দ্বৈতচিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে সেও এই কথা মেনে নিয়েছে। তাহলে সেই কি একা এক ব্যক্তি যে সেই সত্যিকারের স্মৃতির ধারক? 

অসাধারণ সব পরিসংখ্যানে ভরে উঠছে টেলিস্ক্রিন। গেলো বছরের সঙ্গে একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে বলা হচ্ছে- খাদ্য, বস্ত্র বেশি উৎপাদন হয়েছে, তৈরি হয়েছে অধিকতর বাসস্থান, আসবাবপত্র, বেশি রান্নার পাত্র, জ্বালানি, আরও বেশি জাহাজ, বেশি সংখ্যক হেলিকপ্টার, বেশি পুস্তক, আর বেশি বেশি শিশুও... রোগবালাই, অপরাধ আর মস্তিষ্কবিকৃতি ছাড়া সবকিছুই বেশি বেশি। বছর-বছর আর মিনিটে মিনিটে সবকিছুই তরতর করে বেড়ে উঠছে উপরের দিকে। একটু আগে সাইম যেমনটা করছিলো ঠিক তেমনি হাতের চামচটি দিয়ে টেবিলের ওপর লম্বা লাইন হয়ে ছড়িয়ে পড়া ম্যারম্যারে রঙের থকথকে বস্তুগুলোর ওপর আঁকিবুকি শুরু করলো উইনস্টন। বড় তিক্ত মনে এই বাহ্যিক জীবনবিন্যাস নিয়ে ভাবতে বসলো সে। সবসময়ই কি জীবনটা এমনই ছিলো? ক্যান্টিনময় চোখ ঘুরিয়ে নিলো, দেখলো একটি অনুচ্চ ছাদের কক্ষে মানুষ গিজগিজ করছে। অসংখ্য শরীরের গন্ধে ঘৃণ্য পরিবেশ, ভাঙ্গাচোরা ধাতব চেয়ার-টেবিল এত ঠাসাঠাসি করে বসানো যে বসলেই কনুই লেগে যায়, বাঁকানো চামচ, বেঁকে যাওয়া ট্রে, মোটা সাদা মগ; যার উপরটা তেলতেলে, প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ময়লার আস্তর, আর ফালতু জিন ও কফির মিলিত টক-টক গন্ধ, ধাতবরঙা স্ট্যু আর ময়লা কাপড়। এসবের মাঝে আপনার পাকস্থলী আর ত্বক সদাই যেনো প্রতিবাদী হয়ে বলতে থাকে এই কথা, তোমার যা অধিকার তা থেকে তুমি প্রতারিত হচ্ছো। এটা সত্য যে খুব একটা পার্থক্য টানা যাবে এমন কোনও স্মৃতিও তার নেই। ভালোভাবেই মনে করতে পারে একটি সময়ও ছিলো না যখন পর্যাপ্ত খাদ্য ছিলো, ছেঁড়া মোজা বা ছেঁড়া গেঞ্জি-জাঙিয়া পরতে হয়নি, আসবাবপত্র সবসময় দেখেছে ভাঙাচোরা, নড়বড়ে, অনুষ্ণ ঘর, টিউব ট্রেনে ঠেলাঠেলি, বাড়িগুলোতে আস্তর খসে খসে পড়ছে, কালচে রুটি, চায়ের আক্রা, বিস্বাদময় কফি, অপর্যাপ্ত সিগারেগ- সিনথেটিক জিন ছাড়া কোনও কিছুই সস্তা নয়, প্রাচুর্য নেই। কারো শরীর যখন বুড়িয়ে যায় তখন এগুলো আরও মন্দ আকার নেয়। যখন অস্বস্তি, আবর্জনা আর অভাবগ্রস্ততায় কারো হৃদয় আক্রান্ত হয়, দীর্ঘ শীতে কাবু থাকে, একটাই মোজা পরতে হয় দিনের পর দিন, লিফট যখন কখনোই কাজ করেনা, পানি ঠাণ্ডা হয়ে থাকে, খসখসে হয় সাবানের টুকরো, সিগারেট যখন ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে হয়, আর খাদ্যের হয় এমন অগ্রাহ্য স্বাদ, তখন ওই বুড়িয়ে যাওয়াকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলা চলে কি? আর কেনই এগুলো অসহনীয় ঠেকবে যখন অতীতের কোনও স্মৃতিই এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলো না? ..... পরের পর্ব পড়ুন এখানে

 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank