শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৫]

২৩:২৪, ২৩ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১১:০৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

১৮২০

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৫]

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

[পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার]

পর্ব- পাঁচ

ও’ব্রায়েন তার শত্রু নাকি মিত্র- উইনস্টন কখনোই তা নিশ্চিত হয়ে ভাবতে পারেনা- এমনকি আজ সকালে তাদের চোখাচোখিতে যে লহমামাত্র হলেও একটা ঝলকানি খেলে গেলো, তারপরেও পারেনি। কখনো বিষয়টি নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেও নি সে। তবে এইটুকু বোঝে, তাদের মধ্যে পারষ্পরিক অনুধাবনের একটা যোগসাজশ আছে, যা এই ভালোলাগা বা অংশীদারীত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে। ‘আমাদের দেখা হবে যেখানে কোনো অন্ধকার থাকবে না,’ এটাইতো বলেছিলেন তিনি। উইনস্টন জানতো না, কীই এর মানে। তবে খুব মনে হয়, এভাবে নয়তো অন্য কোনোভাবে একদিন কথাটি সত্যি হবে।

টেলিস্ক্রিনের শব্দটা হঠাৎই থেমে গেলো। এরপর ইথারে ভেসে এলো একটি স্পষ্ট কণ্ঠের ঘোষণা- 
অ্যাটেনশন প্লিজ! আমাদের ম্যালাবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এই মাত্র খবর এলো- দক্ষিণ ভারতে আমাদের সৈন্যরা গৌরবময় বিজয় অর্জন করেছে। আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে জানাচ্ছি, যে ঘটনার কথা আমরা এখন বললাম তা থেকে বুঝে নেওয়া যায়, যুদ্ধ এখন শেষের দিকে।
 
তাহলে খারাপ খবর আসছে, ভাবলো উইনস্টন। সে পুরোই নিশ্চিত যে, নিহত আর কারারুদ্ধদের ভয়াবহ সংখ্যাগুলো ঘোষণার পাশাপাশি এক ইউরেশীয় সেনাকে হাপিস করে দেওয়ার যে নৃশংস বর্ণনা চলছে এর পরপরই ঠিক জানিয়ে দেওয়া হবে- আগামী সপ্তাহ থেকে চকোলেটের রেশন ত্রিশ গ্রাম থেকে কমিয়ে বিশ গ্রাম করা হলো।

আরেকবার ঢেঁকুর তুললো উইনস্টন। পাকস্থলী চিমসে করে দিয়ে বাষ্প হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে জিন। টেলিস্ক্রিনে, হতে পারে বিজয়ের উল্লাস প্রকাশে, হতে পারে হারানো চকোলেটের স্মৃতি মুছে দিতে, হঠাৎই ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো ‘ওসেনিয়া টিস ফর দি’ (ওসেনিয়া এ তোমারই জন্যে)। এই গান যখন বাজবে আপনাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হবে। তবে রক্ষা, যেখানটাতে সে বসে সেখান থেকে তাকে টেলিস্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে না।
 
‘ওসেনিয়া ‘টিস ফর দি’ ধীরে ধীরে হালকা বাজনা স্তিমিত হয়ে আসলো। উইনস্টন টেলিস্ক্রিনে পেছন রেখে জানালার দিকে গেলো। দিনটি যেমন ঠাণ্ডা তেমনি উজ্জ্বল। দূরে কোথাও একটি রকেট বোমা বিষ্ফোরণের ভোঁতা শব্দ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলছে। লন্ডনে আজকাল প্রতি সপ্তাহে ওগুলোর বিশ-ত্রিশটি করে পড়ছে। 

নিচে রাস্তায় বাতাসে ছেঁড়া পোস্টারের সেই কোনাটি অবিরাম ঝাপটা খাচ্ছে, আর ইংসক শব্দটি একবার দৃশ্যমান হচ্ছে, আর একবার ঢাকা পড়ছে। ইংসক। ইংসকের পূজনীয় নীতি। নিউস্পিক, ডাবলথিঙ্ক, মিলিয়ে যাওয়া অতীত। তার মনে হলো সমুদ্রের তলদেশে কোনো জঙ্গলে দিক হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোনো এক দৈত্যের রাজ্যে হারিয়ে গেছে সে, আর সেখানে সে নিজেই এক দৈত্য বনে গেছে। সে একা। স্রেফ একা। অতীত মরে গেছে, ভবিষ্যত কল্পনায় আসছে না। এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে একজন মানব সন্তানকে আর কখনো সে তার পাশে পাবে?  আর কিভাবেই বা জানবে- পার্টির এই আধিপত্য চিরদিন ধরে টিকে থাকবে কি না? এসব প্রশ্নেরই একটি উত্তর হয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সত্য মন্ত্রণালয়ের সামনের সেই তিনটি স্লোগান:

যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব 
অবজ্ঞাই শক্তি।

পকেট থেকে পঁচিশ সেন্টের একটি মুদ্রা বের করলো। এতেও একপীঠে খোদাই করা এই স্লোগান; অন্য পীঠে বিগ ব্রাদারের মুখ। ওই মুদ্রার মধ্যে থেকেও চোখ দুটি পাকিয়ে যেনো তাকেই দেখছে। মুদ্রায়, ডাক টিকিটে, বইয়ের মলাটে, ব্যানারে, পোস্টারে, সিগারেটের প্যাকেটে- সবখানেই। সবসময়ই চোখ দুটো আপনাকে দেখছে এবং একটি কণ্ঠস্বর আপনাকে বন্দি করছে। ঘুমিয়ে কিংবা জেগে, কাজে কিংবা ভোজনে, ঘরে কিংবা বাইরে, গোসলে কিংবা বিছানায়- কোথাও মুক্তি নেই। খুলির ভেতরে গোটা কয় ঘন সেন্টিমিটার জুড়ে আপনার যে মগজ ওইটুকু ছাড়া আপনার নিজের বলে আর কিছুই নেই। 

সূর্য ততক্ষণে উল্টো আকাশে পড়েছে। সত্য মন্ত্রণালয়ের অগুনতি জানালার শার্সিতে আলো ঠিকরাচ্ছে না বলে ওগুলোকে বিশাল দুর্গের গায়ে ছোট ছোট ঘুপচির মতো লাগছে। এর অতিকায় পিরামিডীয় আকৃতি ভয় ধরিয়ে দেয়। এতই শক্ত এর গড়ন যে কিছুতেই কিছু হবে না। হাজার হাজার রকেট বোমা ফেললেও না। মনের মধ্যে আবার সেই একই ভাবনা, কার জন্য এই ডায়রি লিখছে সে। ভবিষ্যতের জন্য, অতীতের জন্য- কোনোও একটি কল্পিত সময়ের জন্য! তার সামনে যা অপেক্ষা করছে তা মৃত্যু নয়, স্রেফ ধ্বংস। ডায়েরিটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হবে, আর তাকে বাষ্পে পরিণত করা হবে। অস্তিত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার আগে, স্মৃতি থেকে সরিয়ে ফেলার আগে সে যা লিখেছে তা কেবল থট পুলিশই পড়বে ও জানবে। তাহলে আপনার কোনও অস্তিত্বই যখন থাকছে না, এমনকি এক টুকরো কাগজে নামহীন-অর্থহীন একটি শব্দও টিকে থাকছে না, তখন ভবিষ্যতের কাছে নালিশেরই বা কী উপায়? 

টেলিস্ক্রিন দুপুর ২টার ঘণ্টা বাজালো। দশ মিনিটের মধ্যেই তাকে বের হতে হবে। আড়াইটার মধ্যেই ফিরতে হবে কাজে।

তবে এই ঘণ্টাধ্বনি তার ভেতরে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দিলো। সে এক একাকী দৈত্য, সত্য উচ্চারণ করে চলেছে যা কেউ কখনো শুনতেও পাবে না। কিন্তু যখন সে তা উচ্চারণ করছে, হতে পারে অতি মিনমিনে সে উচ্চারণ, তাতে একটা ধারাবাহিকতাতো রক্ষা হলো। কথাগুলো অন্যকে শোনানোর মধ্য দিয়ে নয়, বরং যে মানব ঐতিহ্য সে বহন করে তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার মধ্য দিয়েই এই ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে। টেবিলে ফিরে গেলো উইনস্টন, কালিতে কলম চুবিয়ে নিয়ে সে লিখলো: 

ভবিষ্যত কিংবা অতীতেই যাই, পৌঁছুতে হবে একটি সময়ে যখন চিন্তাগুলো মুক্ত হবে, যখন মানুষগুলো একে অন্যের থেকে আলাদা হবে, কিন্তু তারা আর একা হয়ে যাবে না- উপনীত হতে হবে এমন একটি সময়ে যখন তাতে সত্য বিরাজ করবে, আর যা কিছু ঘটছে কিংবা ঘটে গেছে তাকে মুছে দেওয়া হবে না: সরে যেতে চাই এই উর্দির যুগ থেকে, একাকীত্বের যুগ থেকে, বিগ ব্রাদারের যুগ থেকে, দ্বৈত চিন্তার যুগ থেকে- শুভেচ্ছা!

ধরেই নেওয়া যায় তার মৃত্যু হয়ে গেছে, ভাবলো উইনস্টন। তার মনে হলো, এখুনি সে তার ভাবনাগুলো গুছিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, সে একটি সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে পেরেছে। যে কোনো কাজের পরিণতি ওই কাজের মধ্যেই নিহিত থাকে। সে লিখলো: 

চিন্তাঅপরাধ মৃত্যু ডেকে আনে না: চিন্তাঅপরাধ নিজেই এখন মৃত। 

নিজেকে একজন মৃত মানুষ হিসেবে মেনে নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব বেঁচে থাকাটাই এখন তার কাছে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে হলো। ডান হাতের দুটি আঙ্গুলে কালি লেপ্টে গেছে। এতেও আপনি ধরা পড়ে যেতে পারেন। মন্ত্রণালয়ের কিছু নাক গলানো কর্মী (কোনও নারী, হতে পারে সেই ধূসরকেশী কিংবা ফিকশন ডিপার্টমেন্টের কালোকেশী) আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে- কেনো সে মধ্যাহ্ন বিরতিতে লিখতে গেলো- কেনই সে একটি সেকেলে কলম ব্যবহার করলো, কীই বা সে লিখছিলো- এবং অতঃপর যথাযথ কর্তৃপক্ষে একটি ইঙ্গিতও ঠুকে দিয়ে আসতে পারে। বাথরুমে ঢুকে পড়লো উইনস্টন। খসখসে কালচে বাদামি রঙের সাবান, যা হাতে ঘষলে পিচ্ছিল নয়, বরং শিরিস কাগজের মতো চামড়ায় ঘসা লাগায়, তাই দিয়ে যত্নের সঙ্গে আঙুলগুলো পরিষ্কার করলো। ডায়রিটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলো। এটি লুকিয়ে রাখার ভাবনা বৃথা, বরং ভাবলো ডায়রিটি এমনভাবে রেখে যেতে পারে যাতে যে কেউ দেখে ভাববে এটি এখানে অধরা পড়ে আছে অনেকদিন। পাতাগুলোর শেষ মাথায় আড়াআড়ি একটি চুল থাকতেই পারে। চিমটি দিয়ে কিছুটা সাদাটে ধুলো তুলে এনে মলাটের এক কোনায় এমনভাবে রাখলো, যাতে যে কেউ ভাবতে পারে ডায়রিটি কেউ ধরলে এই ধুলাগুলো গড়িয়ে পড়তো, এভাবে জমে থাকতো না। 

তৃতীয় অধ্যায়

মাকে স্বপ্ন দেখছিলো উইনস্টন। 

মা যখন চলে গেলেন তখন তার বয়স দশ-এগারো বছর। লম্বা গড়নের নিশ্চল খোদাই মূর্তির মতো নিরব এক নারী ছিলেন মা। ধীর লয়ে চলাফেরা করতেন, মাথায় উজ্জ্বল সাদা চুল। বাবাকে যতটা মনে পড়ে হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন। কালো পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। (উইনস্টনের মনে পড়ে তার বাবার জুতোর তলি থাকতো খুবই পাতলা) চশমা পরতেন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে দেখা মুখদুটো আবছা মনে আসে।

স্বপ্নে উইনস্টন দেখছিলো তার মা অনেক গভীরে নীচে একটি জায়গায় বসে আছেন। কোলে তার ছোট বোনটি। বোনটিকে উইনস্টনের আর মনেই পড়ে না। ক্ষুদে দুর্বল একটি শিশু, বড় বড় চোখ করে সদাই নিরব তাকিয়ে থাকতো, এটুকুই মনে আসে। গভীর খাদ থেকে ওরা দুজনই উইনস্টনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা যেখানে তার যেনো কোনও তল নেই। নলকূপের গভীর তলদেশ যেমনটা হয়, অথবা গভীর কোনো কবর- এটি এমনই এক স্থান যা ওর থেকে অনেক অনেক নীচে, আর তারা আরও নীচেই নেমে যাচ্ছিলো। ওরা যেনো একটি ডুবন্ত জাহাজের সেলুনের ভেতর, আর ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসা পানির ভেতর থেকে ওরা উপরে তার পানে তাকিয়ে। ওরা তখনও তাকে দেখতে পাচ্ছে আর সেও ওদের দেখছে, কিন্তু ক্রমশঃই ওরা গভীর থেকে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছিলো। ডুবে যাচ্ছিলো সবুজ জলরাশির ভেতর, যেনো তারা একবার চোখের আড়াল হলে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সে বাইরে, চারিদিকে আলো-বাতাস, আর ওদের মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সে উপরে বলেই ওরা নীচে যাচ্ছে। এটা সে জানতো, ওরাও জানতো। আর ওরা যে জানে তা ওদের চেহারায় ফুটে রয়েছে। তবে এ জন্য ওদের চেহারায় কিংবা হৃদয়ের গভীরে কোনো অভিযোগ নেই। ওদের একটা বিষয় জানা, মৃত্যুই তাদের পথ আর তা এই জন্য যে, উইনস্টনকে বেঁচে থাকতে হবে। এটাই যেনো এক অমোঘ বিধান। 

কি ঘটেছিলো তা আর মনে নেই, তবে স্বপ্নে সে জানতো, কোনও না কোনও পথে তার জীবনের জন্যই মা ও বোনের জীবন উৎসর্গ হয়েছে। কিছু স্বপ্ন আছে যাতে স্বপ্নের দৃশ্যপটে মনোজাগতিক জীবনের বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকে এবং স্বপ্নের মাঝেই কিছু ঘটনা ও ভাবনা এসে যায় যা সম্পর্কে স্বপ্নদ্রষ্টা সতর্ক হয়ে ওঠে, যা আবার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর জাগ্রত অবস্থায়ও মূল্যবান মনে হতে থাকে। এটিও ছিলো তেমনই এক স্বপ্ন।

এখন উইনস্টনের মনে যা খেলে যাচ্ছে, তা তার মায়ের হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি। বছর ত্রিশেক আগের সে ঘটনা যতটা হৃদয়ভাঙ্গা ছিলো এখন আর তেমনটা ঘটে না। বিয়োগান্তক এই বিষয়গুলো আগেই বেশি আলোড়িত করতো। সে সময় মানুষের কাছে একান্ততা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এগুলোর মূল্য ছিলো। পরিবারের একজনের পাশে অন্যজন দাঁড়াতো, প্রশ্নটিও করতো না। মায়ের হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি তার হৃদয়টাকে ভেঙ্গে দেয় কারণ তাকে ভালোবেসেই ছিলো মায়ের চলে যাওয়া। সে সময় প্রতিদানে ভালোবাসা দেওয়ার মতো বড় সে ছিলো না। আর সে মনেও করতে পারে না কিভাবে আনুগত্যের কাছে ছিলো তার আত্মোৎসর্গ, যা ছিলো একান্তই ব্যক্তিগত আর অবশ্যম্ভাবী।

অতীতে যা কিছু সে দেখেছে, আজকাল আর তা ঘটেই না। ভয়, ঘৃণা ও কষ্ট জর্জরিত একটি সময় এখন। এখানে আবেগের মর্যাদা নেই, কোনও গভীর বা যৌগিক দুঃখবোধও কাজ করে না। অথচ এর সবটাই সে যেনো দেখতে পেলো তার মা ও বোনের দুজোড়া বিষ্ফোরিত চোখে। উর্ধ্বপানে দৃষ্টি মেলে তারা তাকে দেখছিলো, সবুজ পানির ভেতর থেকে, শতশত বাঁও গভীর থেকে তারা দেখছিলো। আর তখনও তারা আরও গভীরেই ডুবে যাচ্ছিলো।

এবার দেখলো, কোনও এক গ্রীস্মের বিকেলে একটি স্প্রিংয়ের টার্ফের ওপর সে দাঁড়িয়ে। সূর্যের তীর্যক আলো ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। এমন একটি দৃশ্যপট এই প্রথম নয়, প্রায়শঃই তার স্বপ্নে আসে, তবে উইনস্টন নিশ্চিত হতে পারে না, বাস্তবে কখনোই এমনটি সে দেখেছে কি না। তার বয়ে চলা চিন্তাধারায় নিজেই এর নাম দেয় সোনালি দেশ। একটি খরগোশের আঁচড়কাটা পুরোনো চারণভূমি, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পায়েচলা পথ। আর ছোট ছোট ঢিবি ছড়িয়ে এখানে সেখানে। মাঠের উল্টোদিকের শীর্ণ বেড়া ঘেঁষে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে দেবদারু গাছের পাতাগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে ঝিরিঝিরি নড়ছে। নারীর চুল যেমন বাতাসে ওড়ে দেবদারুর পাতায়ও তেমন নাচন লেগে আছে। যদিও দৃষ্টির বাইরে, তাও বুঝা যাচ্ছে কাছেই কোথাও ধীর স্রোতে বয়ে চলছে স্বচ্ছজলের নদী, যাতে উইলো গাছের ছায়ায় মিঠা পানির মাছেরা সাঁতার কাটছে।

কালোকেশী মেয়েটি মেঠোপথ ধরে এগিয়ে আসছে। এক লহমায় তার মনে হলো মেয়েটি তার গায়ের পরিধান টেনে ছিঁড়ছে আর তাচ্ছিল্যভরে আশেপাশে ছুঁড়ে ফেলছে। তার ফর্সা, নিটোল দেহবল্লরী উইনস্টনের মধ্যে কোনও আগ্রহই তৈরি করছে না, এমনকি সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না সে। বরং শরীর থেকে কাপড় ছুঁড়ে ফেলায় মেয়েটির যে তাচ্ছিল্যের প্রকাশ ছিলো, সেটিই তাকে বেশি আলোড়িত করছে। এই সাবলীল অবজ্ঞা প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি সংস্কৃতি বিধ্বস্ত হলো, ধ্বংস হলো চিন্তার প্রক্রিয়া। একটি অসামান্য বাহুছোঁড়ার ভঙ্গিমায় যেনো বিগ ব্রাদার, পার্টি আর থট পুলিশ অসারতায় ভেসে গেলো। এটিও ছিলো প্রাচীণ সময়েরই একটি ভঙ্গিমা। ‘শেক্সপিয়র’ শব্দটি ঠোঁটে নিয়ে ঘুম ভাঙলো উইনস্টনের।

কান ঝাঁঝানো সিটি বাজিয়ে চলছে টেলিস্ক্রিন। ত্রিশ সেকেন্ড ধরে একই স্বরে বাজলো সে শব্দ। সকাল সোয়া সাতটার সাইরেন, অফিস কর্মীদের ঘুমভাঙ্গার সময়। বিছানা ছাড়লো উইনস্টন। ন্যাংটো সে। আউটার পার্টির একজন সদস্য কাপড়ের জন্য বছরে ৩০০০ কুপন পায়, তার মধ্যে একটি পাজামায়ই খরচ হয়ে যায় ৬০০। তা পরে ঘুমিয়ে নষ্ট করার মানে হয় না। হাত বাড়িয়ে চেয়ারের উপরে রাখা ময়লা গেঞ্জি আর শর্টস তুলে নিলো। তিন মিনিটের মধ্যেই শুরু হবে শরীর চর্চা। এসময় তার উঠলো কাশির দমক। ঘুম থেকে উঠলেই এমনটা হয় উইনস্টনের। এতে তার ফুসফুস পুরোই ফাঁকা হয়ে গেলো। চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ হাঁপানোর পর স্বাভাবিক নিশ্বাস নিতে পারলো। কাশির দমকে তার শিরাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। পাশাপাশি আলসারের ব্যাথাও চাগাড় দিয়ে উঠলো। 

‘ত্রিশ থেকে চল্লিশের গ্রুপ!’ কর্কশ নারী কণ্ঠ বেজে উঠলো। ‘ত্রিশ থেকে চল্লিশের গ্রুপ! অনুগ্রহ করে জায়গায় দাঁড়ান। ত্রিশের থেকে চল্লিশের!...’
টেলিস্ক্রিনের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো উইনস্টন। স্ক্রিনে ততক্ষণে লিকলিকে অথচ পেশীবহুল, জোব্বা গায়ে, শরীর চর্চার জুতো পায়ে তরুণীর মতো দেখতে এক নারীর ছবি ভেসে উঠেছে।
‘হাত বাঁধো, হাত ছাড়ো!’ তারস্বরে বললো মেয়েটি। ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে... এক, দুই, তিন চার! এক, দুই, তিন, চার! কাম অন কমরেডস, জীবনের কিছুটা সময় এখানে দাও! এক, দুই, তিন, চার! এক, দুই, তিন, চার!...’ ....  পরের পর্ব পড়ুন এখানে

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank