শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ || ৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ওয়েব সিরিজ রিভিউ-২: ডাকাতের জন্য সহানুভূতি, মন্দের জন্য ভালোবাসা!

রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক

১৯:৫১, ২২ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ২০:২৩, ২২ এপ্রিল ২০২১

১৯৪৪

ওয়েব সিরিজ রিভিউ-২: ডাকাতের জন্য সহানুভূতি, মন্দের জন্য ভালোবাসা!

চলমান করোনা সংক্রমণে সমাজ অবরুদ্ধ। লকডাউনে গৃহবন্দি নিস্তরঙ্গ অবসাদের জীবন। বাইরে যখন ওত পেতে আছে করোনা ভাইরাস, তখন বন্ধ রেস্তরাঁ, সিনেমা হল। নেই নতুন সিনেমা, টিভি সিরিয়ালেও ভাটা। এই বোরিং কোয়রেন্টিন কাটাতে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা নেটফ্লিক্স, হটস্টার, ইউটিউব, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই, আড্ডা টাইমসের বাজার বাজিমাত করা ওয়েব সিরিজ, সিনেমা ও ডকুমেন্টারি রিভিউ নিয়ে অপরাজেয় বাংলার নতুন এই আয়োজনে আপনিও সাথে থাকুন। আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি। 

চলমান করোনাযুদ্ধের পাশাপাশি গত দু’টি বছর অনলাইনে চলছে সিরিজ-যুদ্ধ। এর মধ্যে তুমুল আলোচনায় আছে দু’টি ওয়েবসিরিজ- La CaSa De PaPeL বা  Money Heist এবং Breaking Bad। যদিও সিরিজ দু’টি প্রচারিত হয় করোনা সংক্রমণের বহু আগেই, কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণের ফলে গৃহবন্দী জীবনে সিরিজ দুটি পেয়েছে দারুণ জনপ্রিয়তা। গত পর্বের লেখায় ‘ওয়েব সিরিজের হাইপ: দুই মাস্টারমাইন্ড প্রফেসর’ দেখিয়েছি দুই সিরিজের দুই প্রধান চরিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। আজ রইলো দুই সিরিজের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

‘ব্রেকিং ব্যাড’ সিরিজে আমরা দেখি আমেরিকার এক কেমিস্ট্রি প্রফেসর কিভাবে নিজেকে নিষিদ্ধ মাদক (মেথ) তৈরি ও বিজনেসে জড়িয়ে ফেলেন। এই সিরিজের মূল চরিত্র ওয়াল্টার হোয়াইট আর জেসি পিন্কম্যান। ৫টি সিজনে মোট ৬২টি পর্ব, শুরুর দিকের সিজনগুলো কিছুটা ধীরগতির হলেও ক্রমেই এই সিরিজটি রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠে। ওয়াল্টারের ছাপোষা জীবন বদলে যায় তার ক্যানসার ধরা পড়ার পর। আমরা দেখি, সিরিজের নায়ক প্রফেসর ওয়াল্টার আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনের মানুষ। তিনি কখনো মাদক সেবন করেন না। কিন্তু ভাগ্য বা রহস্যের জের ধরে তিনিই হয়ে উঠেন মাদক সামাজ্যের মাস্টার মাইন্ড। রসায়ন বিদ্যার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ও এক্সপেরিমেন্টাল কাজকর্মের অভ্যাস তাকে এই পথে ধাবিত করে। ফলে পেশীবহুল, তরুণ, খুল্লামখুলা না হয়েও তিনি ‘হ্যান্ডসাম’। পড়তি বয়সের এক আধবুড়ো হয়েও তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের মুগ্ধতায় সবাইকে বশ করতে জানেন। পরিবারের প্রতি দায়, শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এবং প্রত্যুতপন্নমতিতা তাকে  দিয়েছে এই চরিত্রের প্রতি আপামর দর্শকের ভালোবাসা। সিরিজে সিজন যত এগোয়, শিক্ষক-ছাত্রের বন্ধন ক্রমাগত দৃঢ় হয়। পরষ্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা। তাদের সাথে যুক্ত হয় গুস্তাভ ফ্রিং। মাদক সম্রাটরা সাধারণত মানুষের ঘৃণা কুড়ালেও এই চরিত্রটি কুড়িয়েছে ভালোবাসা। এরকম একটি কুল ব্লাডেড ক্যারেক্টার সচরাচর পর্দাতেও খুব কম দেখা যায়। প্রফেসরের স্ত্রী স্কাইলার তার স্বামীর সঙ্গে সেপারেশনে গেলেও সমাজে স্বামীর মাদক ব্যবসা নিয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ আনতে পারছেন না, কারণ স্বামীর প্রতি মানবিক সহানুভূতি। জেসি পিঙ্কম্যান আগাগোড়া অস্থিরমতি ও দুষ্ট প্রকৃতির হলেও দর্শকদের চোখে তার অপরাধের চাইতেও অপরাধের জন্য অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ মনটিই হয়ে উঠে মুখ্য। জেসি যেন কিশোর বয়সী এক প্রাণোচ্ছ্বল আবেগী চরিত্র, স্কুল পালানো এক ব্যাকবেঞ্চারের প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠতে দেখি প্রফেসর ওয়াল্টারকে। অথচ প্রফেসর এবং তার এই ছাত্রটির মাঝে সিরিজজুড়ে চলে তীব্র বাদানুবাদ, কখনো বা মারামারিও। কিন্তু দিন শেষে নদী যেমন সাগরে মিলে যায়, তেমনি ছাত্র-শিক্ষকের সৌহার্দ্য বন্ধনে দুজন থাকে আগাগোড়া বন্দী। সাময়িক লোভ, মোহ এবং স্বার্থ জেসিকে দূরে ঠেললেও ওয়াল্টার কখনো বেশি দূরে যেতে দেননি।   

এসব চরিত্র আপাতত নেতিবাচক হলেও নেটজুড়ে দর্শক প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায় এরাই দর্শকদের ভালোবাসা বা সহানুভূতি কুড়িয়েছে। এর কারণ কী? কারণ, এরা পুরো সিরিজে নানান চরিত্রের মধ্যে ভালো, তুলনামূলক ভালো, আরো ভালো, তার চেয়েও.. এরকম একটি সাইকেলের সাথে এরা আমাদের পরিচিত করায়। সিরিজে ভালো থেকে উত্তম চরিত্রগুলো ক্রমান্বয়ে আমাদের মুদ্ধ করে রাখে। খারাপ চরিত্রেরও মানবিক ও বুদ্ধিদীপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে। ফলে যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় চরিত্রগুলো আমাদের কাছে সহানুভূতি ও সমানুভূতি তৈরি করে নেয়। আমরা ভাবতে থাকি, ওই একই পরিস্থিতিতে থাকলে আমি কি করতাম?

প্রথম কিস্তি পড়ুন এখানে...

‘ব্রেকিং ব্যাড’ কেবল ওয়াল্টার আর জেসি দুজনের মধ্যকার কারবার হলেও ‘মানি হাইস্ট’ হলো সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এখানে যুদ্ধ শুধুই রাষ্ট্র নামক বহির্শত্রুর সঙ্গে নয়, বরং সিরিজের প্রতিটি চরিত্র নিজের সঙ্গেও যুদ্ধ করে। দু’টি ডাকাতিকে ঘিরে চারটে সিজন। এই দু’টি ডাকাতিতে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, মানসিক টানাপড়েন বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এই সিরিজে টোকিওর অস্থিরমতির জন্য টোকিওকে দোষ দেয়া যাবে না, রিও’র সরলতার জন্য তাকে একটু সাবধান করতে ইচ্ছে করবে, নাইরোবির জন্য মায়া জন্মাবে, ডেনভারের বোকা হাসির জন্য দর্শকদের হাসি উঠবে, আর্তুরো আর গান্ধিয়াকে দর্শক ঘৃণা করবে। আর বার্লিন? সবাই চুরি করেছে টাকা, কিন্তু বার্লিন চুরি করে দর্শকদের মন। এরা সবাই বিপদে কাঁধে কাঁধ মেলায় কিন্তু একে অপরের দিকে বন্দুকও তাক করে। মানসিক দ্বন্দ্বকে ঘিরে ‘স্টকহোম সিনড্রোম’ দেখানো হয় সূক্ষ্ম অনুভূতির মাধ্যমে। ফলে আশ্চর্য এক সহানুভূতি তৈরি হয় দর্শকদের মনে। যে প্রোফেসর তার পুরো টিমকে প্রেম না করার পরামর্শ দেয়, সেই যখন পুলিশ ইন্সপেক্টর রাকেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে, দর্শকমনে তৈরি হয় আরো একটি সহানুভূতি মন। প্রথম দুই সিজনে যাকে ঘৃণা করেছে দর্শক, শেষের দুই সিজনে তিনিই হয়ে উঠছেন ভালোবাসার ‘রাকেল’।

‘ব্রেকিং ব্যাড’ এবং ‘মানি হাইস্ট’ দুই সিরিজেই দুই প্রফেসর ‘সিমপ্যাথি-এমপেথি ট্রাম্পকার্ড’ দিয়ে ভক্ত জুটিয়ে নেয়। ভক্তরা তাদের প্রফেসরদের মাদক রসায়নে মজে যায় বা সালভাদর দালির মুখোশ পরে হায়েস্টকে সমর্থন করে যায়। ব্রেকিং ব্যাডের মতো এই সিরিজের প্রফেসরও পেশীবহুল কোন তারকা নন। তিনিও ওয়াল্টারের মতো এক মাঝবয়েসী সাধারণ মানুষ। প্রয়াত পিতার অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করতে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় চুরির দায় নেন তিনি। প্রফেসরের দল স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির মুখোশকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। প্রফেসরের সের্গিও মার্কিনার মানবিক দিক হলো ব্যাংক ডাকাতি হবে কিন্তু কোন খুনাখুনি হবে না এমনকি আটকে পরা জিম্মিদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। অবশ্য প্রফেসরের ছাত্ররা ভালো ব্যবহারই নয় বরং বাড়তি হিসেবে প্রেমটুকুও করেছে! ডায়লগের দার্শনিক দিক যেমন আছে, আছে প্রতিটি চরিত্রের গভীরতা। সাসপেন্স, থ্রিলার, রোম্যান্স, উইটিনেস, ক্রাইম মিলে এই বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে এই ওয়েব সিরিজটি। দর্শকরা কেন ডাকাতদলকে সমর্থন করে? করে কারণ, কোন একটি কাজ বাস্তবায়নের জন্য কতটা নিঁখুত পরিকল্পনা দরকার আর সেই পরিকল্পনার জন্য কতটা ডেডিকেশন দরকার এই সিরিজে দেখতে পাওয়া যায়। মানি হাইস্ট সিরিজটির প্রথম সিজনে ১৩টি, দ্বিতীয় সিজনে ৯টি, তৃতীয় সিজনে ৮টি এবং চতুর্থ সিজনেও ৮টি পর্ব রয়েছে। সর্বমোট চারটে সিজন, আটত্রিশটা এপিসোড। এখন পঞ্চম তথা শেষ সিজনের শুটিং চলছে। গত দুই বছরে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের লকডাউনে নেটফ্লিক্সের ওয়েব সিরিজে এই সিরিজটি সবার মুখে মুখে। গতবছর ‘প্রফেসরের কী পরিণতি’ এমন এক নাটকীয় প্রশ্ন রেখে পুলিশের গুলির মুখে গ্রেফতার হওয়ার দৃশ্যে শেষ হয় চতুর্থ সিজন। কিন্তু প্রফেসরের কপালে বন্দুক ঠেকানোই যেন কাল হলো, দর্শক সিম্প্যাথি আরো জোরালো হয়ে উঠলো যেন। দর্শক পুরো একবছরজুড়ে ভাবছে সম্ভাব্য পরিণতি। কখনো ভাঙ্গা মুখোশকে মনে করছে প্রফেসরসহ পুরো দল কী মারা যাবে? নাকি গ্রেপ্তার হবে? নাকি প্রথম ডাকাতির মতো প্রফেসর সফল হয়ে পালাতে পারবে সদলবলে? শেষ সিজন পর্যন্ত অপেক্ষায় কাটছে দর্শকদের, এসব উত্তরের শুটিং চলছে। প্রফেসর চরিত্রের আলভারো মর্তে ইনস্টাগ্রামে মাঝে মাঝে এমন কিছু ছবি পোস্ট করছেন, তাতে উন্মুখদশা তো কাটছে না, বরং মুগ্ধতা তৈরি করছে।

পুরো পৃথিবী এখন করোনা নামক অদৃশ্য অণুজীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। সঙ্গরোধ গৃহবন্দীত্বে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ এবং ‘মানি হাইস্ট’ দুই সিরিজের ‘অ্যান্টিহিরো-সাগা’কে চিত্তাকর্ষক করে তুলছে ইন্টারনেট মাদকতা। এই মাদকতা এমন ভয়াবহ যে, প্রফেসর ওয়াল্টারের হতাশায় দর্শক যেমন মুষড়ে পড়েন, প্রফেসর সের্গিও মার্কিনার প্রতিরোধ ভেঙে গেলে দর্শকও চিন্তিত হয়। জেসি পিঙ্কম্যান যখন মার খেয়ে কাতরায় তখন দর্শকও ব্যথা পায়। নােইরোবি মারা গেলে চোখের জল প্লাবন নামে দর্শকদের। মহামারিতে  পৃথিবী দেখলো দুই অভূতপূর্ব উন্মাদনা। ইন্টারনেট বিনোদনের বাজারে তাই এই দুটি সিরিজ আমেরিকা-স্পেন ছড়িয়ে এন্টিহিরো সিমপ্যাথি নিয়ে করোনা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এই দুই ওয়েব সিরিজ তৈরি করেছে বিনোদনের নয়া বিশ্বায়ন। যে বিনোদনে ‘ভালো’ নয়, ‘মন্দ’দের প্রতি তৈরি হয় এক অপার মানবিক অনুভূতি।

লেখক: রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন:

ওয়েব সিরিজের হাইপ: দুই মাস্টারমাইন্ড প্রফেসর

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank