মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ || ৫ চৈত্র ১৪৩০ || ০৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মজিবুর রহমান দিলু

স্যালুট আপনাকে হে জীবন ও মুক্তির যোদ্ধা!

ড. ইসলাম শফিক

১২:০৬, ২০ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১২:৫৯, ২০ জানুয়ারি ২০২১

৪০৯৬

মজিবুর রহমান দিলু

স্যালুট আপনাকে হে জীবন ও মুক্তির যোদ্ধা!

মজিবুর রহমান দিলু বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। একাধারে তিনি মঞ্চ, বেতার ও টিভি নাটকের অত্যন্ত তুখোড় একজন অভিনেতা। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক রচনা, মঞ্চ ও টিভি নাটকের নির্দেশনাতেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা সকলের কাছে প্রসংশনীয়। এসব ছাপিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট এই ব্যাক্তিত্ব ১৯ জানুয়ারি ২০২১ ভোর ৬:৩৫ মিনিটে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬৯ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে অনন্তবাসী হয়েছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান দিলু ১৯৫২ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আবু এরফান মাহবুবুর রহমান ও মাতার নাম জাহানারা খাতুন। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ছয় ভাই ও দুই বোনের পরিবারে মজিবুর রহমান দিলু সবার মধ্যে পঞ্চম। তাঁর অন্যন্য ভাইয়েরা হলেন- প্রখ্যাত নাট্যজন মঞ্চসারথী আতাউর রহমান, জাহিদুর রহমান, সাজিদুর রহমান, যিনি ‘কবি মেহরাব’ নামে অধিক পরিচিত, নাঈম সাইফুর রহমান ও নোমান মাহমুদুর রহমান। দুই বোন জোবায়দা জেবু ও খুরশিদা বেগম। ১৯৮০ সালের ২৭ জানুয়ারি, রাণি রহমানের সাথে জীবনসঙ্গী হিসেবে পথচলা শুরু করেন। পারিবারিক জীবনে এক মেয়ে রিমঝিম তানজিলা ও দুই ছেলে অয়ন রহমান ও অতুল রহমান’কে নিয়ে জীবনসমুদ্রে ডিঙ্গি নৌকায় পাল তুলেছেন এই নির্ভিক মাঝি।

মজিবুর রহমান দিলু প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন চট্টগ্রামে। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে ভর্তি হন আজিমপুর ওয়েস্ট ইন্ড হাইস্কুলে। এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় মানবিকে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই তৎকালীন ঢাকার বিখ্যাত অভিজাত হোটেল পূর্বাণীতে চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি আর  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করার দিকে মনযোগী হননি। 

জীবনের নানাধাপে তিনি কর্মরত ছিলেন- হোটেল পূর্বাণী’র ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজার, বৈশাখী টেলিভিশন অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান, শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র উপ-পরিচালক, দৈনিক আজকের প্রত্যাশা’র নির্বাহী সম্পাদক, শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন ও শান্ত-মারিয়াম  ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০০৫ সালে ভারতে গিয়ে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জানা যায়- জটিল ভাইরাস গুলেনবারি সিনড্রোমে তিনি আক্রান্ত। সেসময় তিনি দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। তবে দেশবাসীর দোয়া ও ভালোবাসায় সে যাত্রায় সুস্থ হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন এই জীবনযোদ্ধা। তাঁর ফিরে আসাটাকে তিনি প্রায়শই বলতেন মিরাক্যল অব লাইফ; তিনি ‘দ্বিতীয় জনমও’ বলতেন! 

স্বাভাবিক জীবনে তিনি ফিরলেন কিন্তু তাঁর নিত্য সঙ্গী হয়ে সঙ্গে আসলো একটি ‘ক্র্যচ’। তাঁর হাঁটতে বেশ সমস্যা হতো, কিন্তু তিনি সেটাকে সমস্যা মনে করতেন না। কারো সাহায্য ছাড়া তিনি চলার চেষ্টা করতেন। অসীম সাহসী এই মানুষটি ঘরে বন্দি থাকার মানুষ নন, জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে পরাজিত হবার পাত্র তিনি নন। নিজের জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করে তিনি মাত্র আঠার বছর বয়সে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি যেন জন্মেছেন পরাজয়কে পরাজিত করার জন্য। মজিবুর রহমান দিলু হুইল চেয়ারে বসে থাকার জন্য জন্মাগ্রহণ করেননি। শুরু করলেন জীবনের নতুন অধ্যায়, নতুনভাবে পথচলা। রচিত হতে থাকলো জীবনকাব্যের কথামালা- নতুন এক ডায়রিতে। নতুন ডায়রির প্রতিটি পাতা, প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি বর্ণ তাঁর নিজের স্বপ্নের বুনন।

২০০৮ সালে মজিবুর রহমান দিলু বৈশাখী টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে যোগদান করেন। বৈশাখী’তে আমি প্রায় তিন বছর চাকুরিসূত্রে তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। টেলিভিশন চাকুরি বলতে গেলে মূলত চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটির একটি অতিমাত্রার পেশাদার কাজ। দীর্ঘসময় একজন কর্মী অপরজন কর্মীর কাছে থাকার পরিবেশ পায়, তাতে করে বন্ধন তৈরি হয় পারিবারিক আবহের। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম এই মহান ব্যক্তিত্বকে। যত কাছে গিয়েছি, তত গভীরভাবে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করেছি। এই উপলব্ধি প্রাণের, অন্তরের, মায়ার সংবেদনশীলতার। তাঁর পাঠপরিধি, শিল্পমনন, সৃজনশীলতা, সততা, রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব নির্মোহতা, বিনয়, শিষ্টাচার, যশ, খ্যাতি  প্রভৃতির সমন্বিত স্বাতন্ত্র্যে তিনি  আমার কাছে এক আইকনিক চরিত্র; যাঁর সম্মুখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করা যায়, যাঁর পা ছুঁয়ে পদধুলি নেয়া যায়। তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরসৈনিক, গেরিলা যোদ্ধা। ফুসরত পেলেই গল্পে আড্ডায় বা সিরিয়াস কথোপকথনে দেশ ও মানুষ নিয়ে তাঁর চিন্তা, দর্শন ও স্বপ্নের কথা জানাতেন। একাত্তরের তাঁর যুদ্ধজীবনের স্মৃতি ও গৌরবের কথা আমাদের বলতেন ।

স্কুলে পড়ার সময়ই স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন মজিবুর রহমান দিলু। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে যে মিছিলে গুলিতে আসাদ শহিদ হয়েছিলেন সেই মিছিলে তিনিও ছিলেন। মাত্র আঠার বছর বয়সে ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে যান কলকাতা হয়ে টকিপুর ক্যাম্পে। সেখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে পাঠানো হয় বিহার চকুরিয়ায়। কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে যেতে হয় মেলাঘরে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে ও  ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এর সঙ্গে। তাঁরা তরুণ দিলুকে পাঠিয়ে দেন প্লাটুন কমান্ডার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ’র কাছে। কম্পানি কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন রেজাউল করিম মানিক। কম্পানির সেকেন্ড ইন কমান্ডার ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। রেজাউল করিম মানিক যুদ্ধে শহীদ হলে গ্রুপটির কমান্ডারের দায়িত্ব নেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। মজিবুর রহমান দিলু মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে কয়েকটি দুঃসহসী অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। তার মধ্যে ঢাকা কলেজে অপারেশন অন্যতম। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান দিলু’র দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর প্রতিটি কাজে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। বৈশাখী টেলিভিশনে তাঁর অনুপ্রেরণায় ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার’ নামে একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান আমরা ধারাবাহিকভাবে চালু করেছিলাম। থিয়েটারের প্রতি তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, মূলত তিনি থিয়েটারের মানুষ; নিজের পরিচয়ের বেলায় তিনি গৌরবের সাথে থিয়েটারের মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠানের প্রচারসূচিতে মঞ্চনাটকের সাধারণত ঠাঁই হয়না। শুধুমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন অর্থাৎ বিটিভি’তে মাসে একটি বা দু’টি মঞ্চনাটক ধারণপূর্বক পরবর্তীতে সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। কিন্তু মজিবুর রহমান দিলু বৈশাখী টেলিভিশনে অনুষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বে আসার পর আমি তাঁর কাছ থেকে মঞ্চনাটক বৈশাখী টেলিভিশনের স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচার করার সবুজ সংকেত পাই। অর্থ সঙ্কট ছিল, ছিল বিরুদ্ধ মত, ছিল বিরূপ সমালোচনা, তবুও আমরা মুক্তচিন্তার বীজ রোপণ করেছি। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক আট থেকে দশটি থিয়েটার প্রযোজনা বৈশাখী স্টুডিও থেকে আমরা সরাসরি সম্প্রচার করেছিলাম। যা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রয়েছে। যেসব প্রযোজনা সম্প্রচারিত হয়েছিল- আসিফ মুনীর তন্ময় নির্দেশিত মুনীর চৌধুরী’র ‘করব’, আবুল কালাম আজাদ নির্দেশিত প্রাচ্যনাটের ‘সার্কাস সার্কাস’, মামুনুর রশীদ নির্দেশিত আরণ্যকের ‘সংক্রান্তি’, খালেদ খান নির্দেশিত সুবচনের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, আবুল কালাম আজাদ নির্দেশিত প্রাচ্যনাটের ‘কইন্যা’, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী ‘সঙপালা’ প্রভৃতিসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রযোজনা। 

মজিবুর রহমান দিলু আপাদমস্তক একজন সৃজনশীল শিল্পী। একাধারে তিনি আবৃত্তি শিল্পী, থিয়েটার, বেতার ও টিভি নাটকের অভিনেতা; আরও পরিচয় রয়েছে তিনি নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও একজন থিয়েটার সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মঞ্চনাটকের দল ‘ঢাকা ড্রামা’। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক হচ্ছে- আমি গাধা বলছি, নানা রঙের দিনগুলি, জনতার রঙ্গশালা। ১৯৭৬ সালে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় নাট্য উৎসবে নির্দেশনা দেন নাটক ‘কিংসুক যে মরুতে’, তাঁর নির্দেশিত মঞ্চনাটক হচ্ছে ‘কড়াদাম চড়াদাম’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’’, ‘আমি গাধা বলছি’, ‘নানা রঙের দিন গুলি’। মঞ্চাভিনয় দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। মজিবুর রহমান দিলু অভিনীত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকগুলো হলো- ‘নীল পানিয়া’, ‘মহাপ্রস্থান’, ‘কিছু তো বলুন’, ‘তথাপি’, ‘আরেক ফাল্গুন’। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক টিভি নাটক- ‘সময় অসময়’ এবং ‘সংশপ্তক’। আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’র অবলম্বনে নির্মিত নাটকে ‘বড় মালু’ চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এমনকি এখনো অনেকেই তাকে ‘বড় মালু’ নামেই চেনেন। ‘সংশপ্তক’ নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন ও আল মনসুর। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটার নবনাট্য আন্দোলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটার বিকাশে মজিবুর রহমান দিলু’র ভূমিকা অগ্রগণ্য। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মোরশেদুল ইসলাম’র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’তে লিটন চরিত্রে অভিনয় করে মজিবুর রহমান দিলু বিশেষ সুনাম কুড়িয়েছেন। ২০০৫ সালের পর থেকে তিনি অভিনয় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।

অসীম সাহসী, পরিশ্রমী ও চিন্তাশীল এই মহান মানুষটি আমার জীবনের একজন মহান শিক্ষক। জীবনযুদ্ধ কাকে বলে? শেষ পর্যন্ত টিকে থেকে লড়াই করার অদম্য শক্তি! সময় জ্ঞান। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণ করার সাহস প্রভৃতি বিষয়ে তিনি দ্রোণাচার্যের মতো শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিনিয়ত তাঁর কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখেছি। মূল ব্যাপার হলো তিনি থিয়েটারের মানুষ। তিনি আমাদের কালে আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। প্রচুর পড়াশুনা করতেন। দেশি-বিদেশি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, মনীষীদের জীবনী তাঁর নখদর্পণে ছিল। শিশুদের নিয়ে তিনি বহুবিধ কাজ করেছেন। আশির দশকে ছোটদের জনপ্রিয় গল্প ও সংগীতের সমন্বয়ে শ্রুতিনাটক টোনাটুনি প্রকল্পের নির্দেশক ছিলেন তিনি। শিশুদের জন্য টুনাটুনির প্রায় সব প্রযোজনা বলা যায় তাঁর হাতেই হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী ছিলেন তিনি। তাঁর উইট ও হিউমার সেন্স আমাকে ভীষণভাবে টানতো। যারা এই শিল্পরসিক মানুষটির সংস্পর্শে এসেছেন তারা বোধ করি সকলেই আমার সাথে একমত হবেন।

থিয়েটারের অন্তপ্রাণ এই শিল্পপুরুষ আবৃত্তি, বেতার নাটক, টিভি নাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তথা বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। পাশাপাশি নাট্যনির্দেশনা, টিভি নাটক রচনা ও পরিচালনাতেও তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নাট্যাঙ্গণে তাঁর জীবন ও কাজ অম্লান হয়ে থাকবে। 

তিনি আমাদের ছেড়ে অনন্তের পানে চিরস্থায়ী হলেন। দেশবাসী সকলে তার প্রয়াণে শোকে কাতর হয়েছে; বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। 

মজিবুর রহমান দিলু, আপনি একজন মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার জন্য শোক জানিয়েছেন। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আপনার জন্য শোক জ্ঞাপন করেছে। আপনার প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, ঢাকা থিয়েটার, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আপনার প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করেছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় করুণ সুরের বিউগল বাজিয়ে বনানী কবরস্থানে আপনার শবদেহ লাল-সবুজের আমাদের অহঙ্কারের জাতীয় পতাকায় শোভিত করে স্যালুট জানানো হয়েছে আপনাকে। শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে আপনার সমাধি। এসবই আপনার এক জীবনের একেকটি দিনের একেকটি শৈল্পিক ও সৃজনকর্মের প্রতিফলন!

সকলের শ্রদ্ধেয় দিলু ভাই, আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়; আমাদের অন্তরাত্মায় আপনার নিজ বিভায়। আপনি বেঁচে থাকবেন বাংলার লক্ষ-কোটি মানুষের অন্তরে অন্তরে। যতদিন স্বাধীন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান দিলু’র নাম উচ্চারিত হবে এই বাংলার মাটিতে।
স্যালুট জানাই আপনাকে হে মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা!

ড. ইসলাম শফিক: সিনিয়র টেলিভিশন কর্মী ও শিক্ষক।
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank