শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯

১৬:৪৫, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৮:৪৬, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

১৯০৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।

[পর্ব-৯]

১৯৮৮, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। একটি প্রশিক্ষন শেষ করে আমি কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকা ফিরে এসেছি। সেদিনই বিকেলে ইলিসিয়াম রেস্ট হাউজের বাসায় একটি ফোন এলো। মনসুর আল ফারুকী ভাই এর বড় মেয়ে ফোন করে সরাসরি বললো ‘চাচা, আব্বুর অবস্থাতো ভালো না, পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আপনাকে একবার দেখতে চান।’

মনসুর আল ফারুকী ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। তিনি তখন ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের উপ আঞ্চলিক পরিচালক। খুব ভালো উপস্থাপক ছিলেন। তার উপস্থাপনায় বিটিভিতে আমি ‘সংলাপ’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি বেশ কিছুদিন। 

সে বিকেলেই রিকশা নিয়ে আমি আর জেবু পিজি হাসপাতালে যাই ফারুকী ভাইকে দেখতে। তিনি কিডনি ওয়ার্ডে শুয়ে আছেন, ডায়লেসিস চলছে। তার দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের দেখে খুব খুশী হলেন। কন্ঠ ম্রিয়মাণ। বললেন ‘আমার হাতে আর সময় নেই, আমি বেশ বুঝতে পারছি। কারন এই রোগের চিকিৎসা করার সামর্থতো আমার নেই।’ তখন কিডনির উন্নত চিকিৎসার জন্য ছুটতে হতো ভারতের ভেলোরে। ঢাকার ডাক্তাররাও সেই পরামর্শ দিয়েছেন। এখন কি করা যায়! একজন মানুষ কতো অসহায় হয়ে যায় অসুস্থ হলে। বাংলাদেশ বেতার থেকে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। সাড়া পাননি। 

বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসেই আরেকজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি কাজী সিরাজের বাসায় যাই। তিনিও তখন ইলিসিয়াম রেস্ট হাউজে থাকতেন। সিরাজ ভাই ঐ সময় ‘সৃজন’ নামে বিটিভিতে আমার একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতেন। গবেষনায় ছিলেন রনজিৎ বিশ্বাস। কাজী সিরাজ তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আর রনজিৎ বিশ্বাস ছিলেন স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ে। 

আমরা তিনজন মিলে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করালাম, যাতে আমরা ফারুকী ভাইয়ের উন্নত চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা করতে পারি। সেজন্য টাকা তুলতে হবে। সে উদ্দেশ্যে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে ফারুকী ভাইয়ের উপর একটা প্রতিবেদন তৈরি করি। অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে আবেগপূর্ণ সে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন রনজিৎ বিশ্বাস। কাজী সিরাজের মর্মস্পর্শী উপস্থাপনায় ফারুকী ভাই ও তার পরিবারের অসহায়ত্বের কথা দর্শকেরা জানতে পারেন। যেদিন অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয় সেদিন পিজির ডাক্তাররাও অনুষ্ঠানটি দেখেন ফারুকী ভাইকে সাথে নিয়ে কিডনি ওয়ার্ডে বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। 

লক্ষ্য ছিলো পাঁচ লাখ টাকা। সাড়ে তিন লাখ ভেলোরে চিকিৎসার জন্য আর দেড় লাখ টাকা আনুষঙ্গিক খরচ। কিন্তু অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম। পরদিন হতে টাকা আসতে শুরু করে। বিটিভির রিসিপশনে একজন টাকা সংগ্রহ করে তার হিসাব রাখতো। অনেকে পিজি হাসপাতালেও যান সহযোগিতার উদ্দেশ্যে। ভাষা সৈনিক ডক্টর হালিমা খাতুন পিজিতে গিয়ে কিছু অর্থ সাহায্য করে আসেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব তার সাভারের একটা জায়গা বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা ফারুকী ভাইয়ের হাতে দিয়ে আসেন। তার নাম প্রকাশ করতে মানা করে দেন। মানুষের মানবিকতা দেখি আর চোখের পানি ফেলি। এক সন্ধ্যায় কাজী সিরাজ ভাই ইলিসিয়াম রেস্ট হাউজে তার রুমে যাবার জন্য আমাকে খবর দেন। তিনি একজন ব্যক্তির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। ভদ্রলোক সিরাজ ভাইয়ের হাতে দু লাখ টাকার একটি চেক দেন মনসুর আল ফারুকীর চিকিৎসার জন্য। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এই টাকা পাঠিয়েছেন তার ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে, কোনো প্রচার করা যাবে না এই শর্তে।

পরদিন সব টাকা ফারুকী ভাইয়ের পরিবারের কাছে জমা হয়ে যায়। সর্বমোট সাড়ে সাত লাখ পাওয়া গেছে। ভেলোর যাবার সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। নির্ধারিত দিনে স্কুল পডুয়া ছোটো ছেলেকে সাথে নিয়ে মনসুর আল ফারুকী ভেলোর যাত্রা করেন। তার চোখে তখন বেঁচে থাকার প্রত্যাশা।

ফারুকী ভাই ভেলোর গিয়ে আমার কাছে দু দুটো চিঠি লেখেন তার চিকিৎসার খবরাখবর জানিয়ে। অনেকদিন সেই চিঠি আমি যত্ন করে রেখেছিলাম। আমার জন্য তার স্নেহ আর দোয়া ছিলো চিঠির প্রতিটি পাতায়। 

মনসুর আল ফারুকী ভাই বেঁচে ফিরতে পারেননি। ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে তিনি ছেলেসহ ট্রেনে আজমির যান ভেলোর থেকে। আজমিরের ভীষন ভক্ত ছিলেন। সেখানে নামাজ শেষ করে পরবর্তি ট্রেনে আবার রওনা হন ভেলোরের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পথ। রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র হয়ে তামিলনাড়ু। তিনি তখন গুজরাট পার হচ্ছেন। ট্রেনের মাঝে খুব অস্বস্তিবোধ করতে থাকেন। একটি স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে তাকে শহরের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয় এম্বুলেন্সে করে। কিন্তু তিনি আর হাসপাতাল পর্যন্ত জীবিত পৌঁছতে পারেননি। মৃত্যুর আগে ছোটো ছেলেটার হাত ধরে বলে যান, তাকে নিয়ে আর কষ্ট না করতে। মাত্র চৌদ্দ বছরের স্কুল পড়ুয়া ছেলে। দায়িত্ব নিয়ে ঐ শহরের একটি গোরস্থানে বাবাকে চিরবিদায় জানিয়ে একা একা দেশে ফিরে আসে। 

আমি তখনো ঢাকার ইলিসিয়াম রেষ্ট হাউজে। ৮০৮ নং কক্ষে থাকি। বিটিভিতে হারানো দিনের গানের অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি। সে সূত্রে অনেক শিল্পীদের আনাগোনা ছিলো আমার বাসায়। একদিন সকালে ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র আজাদ এক যুবককে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এলো। কাঁধে তার ঝোলানো ব্যাগ, ব্যাগের মাঝে নানান আকারের বাঁশী। বুঝতে পারলাম সে একজন বংশীবাদক। আজাদ ঢাকা আর্ট ইন্সটিটউটের ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত নিউমার্কেটের কাছে শহীদ শাহানেওয়াজ হলে থাকতো। রাতে আজাদ ও তার দু চারজন বন্ধু দেখতে পায় একজন ক্ষুধার্ত যুবক তাদের হোস্টেলের বারান্দায় বসে বাঁশী বাজাচ্ছে। তারা বাঁশীর সুরে মুগ্ধ হয়ে যুবকের সাথে আলাপ করে। যুবকটি জানায় সে কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছে নেত্রকোনা থেকে। নাম বারী সিদ্দিকী। আজাদ বারীকে রাতে তাদের হলে রাখার ব্যবস্থা করে এবং সকালে তাকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসে।

আমি বারীকে নিয়ে রামপুরা টিভি ভবনে আসি। বিটিভির যন্ত্রসঙ্গীত শাখার প্রধান শাহজাহান ভাই এর সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেই এবং তাকে তালিকাভুক্ত শিল্পী করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলি। আমি আরো জানাই, এরপর আমার সব সঙ্গীতানুষ্ঠানে বারী বাঁশী বাজাবে। সঙ্গীত বিভাগে শাহজাহান ভাইসহ অনেকেই তার বাঁশী শুনে মুগ্ধ হন। এরপর বারী সিদ্দিকী’র কাছ থেকে একটা দরখাস্ত নেই যন্ত্রসংগীত শিল্পী হিসেবে বিটিভিতে চাকরীর জন্য এবং তা সে সময়ের বিটিভির জিএম মোস্তফা কামাল সৈয়দ এর মাধ্যমে পরিচালক (প্রশাসন) ফখরুজ্জামান চৌধুরীর কাছে পাঠাই। অল্প ক’দিনের মধ্যে বিটিভিতে বারী সিদ্দিকীর চাকুরীটা হয়ে যায়। সে সময়ে বিটিভির অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিলো সৃজনশীল ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করা। 

এরপরের কথা সবারই জানা। শুধু একজন বংশীবাদক নয় একজন লোকসংগীত শিল্পী এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও বারী সিদ্দিকীর প্রতিভা চারিদিক ছড়িয়ে পরে। একবার বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন বৃটিশ হাইকমিশনার বারী সিদ্দিকীকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে তার ভাষনে উল্লেখ করেছিলেন। 

মনসুর আল ফারুকী ভাই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। পারেননি। বারী সিদ্দিকী ও চলে গেছেন অনেকটা অকালেই। রনজিৎ বিশ্বাসের কথা বলছিলাম। কতো আন্তরিক মানুষ ছিলেন লোকটা। লেখার হাত ছিলো অসাধারন। রম্য রচনা ও প্রবন্ধ লেখাতেই শুধু নয়, ক্রিকেট খেলাকে সাহিত্যের মাঝে স্থান করে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে হাস্যরসিক মানুষটি অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের সচিব পদে থাকার সময় গাড়ী এ্যাকসিডেন্টে মারাত্মক আহত হন। অবসরে যাবার কিছুদিনের মাঝে তিনিও চলে গেলেন। চিরদিনের জন্য। আর এই করোনাকালে কতো গুণীজনইতো চলে যাচ্ছেন প্রতিদিন।

আরও পড়ুন

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank