প্রতি বছরের মত আবারও উপনীত হয়েছে হিসাববিজ্ঞান দিবস-২০২০। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর সারা বিশ্বের সকল ধরনের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে হিসাববিদদের বর্ণাঢ্য অবদানের কথা স্মরণ করে তাদের সম্মানার্থে এ দিবসটি উদ্যাপিত হয়। এই নির্দিষ্ট তারিখটি বেছে নেয়ার মূল কারণ হচ্ছে এই দিনেই ১৪৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ÓSumma de Arithmetica, Geometria, Proportioni et Proportionalita"- নামে ইটালির ভেনিসে একটি বই প্রকাশিত হয়- যার বাংলা করলে অর্থ দাাঁড়ায়, ”পাটিগণিত, জ্যামিতি ও অনুপাত সম্পর্কিত সামগ্রিক ধারনা”  ("Everything About Arithmetic, Geometry and Proportion")। 

এটি মূলতঃ দুই তরফা দাখিলা পদ্ধতি (double entry book keeping)-র উপর প্রথম বই - যা ভবিষ্যত হিসাববিদদের জন্য ছিল একটি মাইলফলক। এর উপর ভিত্তি করেই সারা বিশ্বে বর্তমান হিসাববিজ্ঞান পরিচালিত হচ্ছে। আমরা অনেকেই জানি বইটির লেখক আর কেউ নন। তিনি হচ্ছেন ইটালীয় বংশদ্ভূত গণিতবিদ লুকা বার্তোলোমিও ডি প্যাসিওলি (Luca Bartolomeo de Pacioli), যাকে আমরা সবাই ছোটবেলা থেকেই সংক্ষেপে ’লুকা প্যাসিওলি’ হিসাবে জানি। তিনিই প্রথম জাবেদা (journal entry)  ও খতিয়ানের (ledger)-এর ব্যবহারসহ হিসাববিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারনার সূত্রপাত করেন।

লুকা প্যাসিলিও ছিলেন লিওনার্দো দ্যা-ভিঞ্চি’র গণিত শিক্ষক। অনেকের মতে লিউনার্দো দ্যা-ভিঞ্চি লুকা প্যাসিলিওর একজন অতি ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন। ১৪৪৭ সালে ইটালীর সানসিপলক্রো-তে তাঁর জন্ম, যিনি ১৫১৭ সালে পৃথিবী থেকে আমাদের ছেড়ে চলে যান । লুকা প্যাসিওলি তাঁর ”পাটিগণিত, জ্যামিতি ও অনুপাত সম্পর্কিত সামগ্রিক ধারনা” বইটির প্রথম দুই অংশে পাটিগণিত ও জ্যামিতি নিয়ে আলোচনা করেন। বইটির তৃতীয় অংশে মোট ৩৬টি অধ্যায়ে হিসাবরক্ষণের উপর আলোচনা করেন ও বিভিন্ন সূত্রের অবতারনা করেন, যা ১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দে পূণঃমুদ্রিত হয়। বইটির একটি অধ্যায়ের নাম ’ডি কম্পিউটিস অব স্ত্রিপটুরিস” (De Computis of Scripturis) যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ’গণনা ও লিখা’। এতে তিনি দুই-তরফা দাখিলা পদ্ধতির বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং দ্বিতীয় অংশে বিণ্যাস সংক্রান্ত (Disposition) বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। উল্লেখ্য, তার এই বইটির জন্য তিনি ইটালীর ভ্যানিস শহরে একজন ধর্মযাজক হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেন। 

মূলত ’হিসাব’ ও ’বিজ্ঞান’ এ দুটি শব্দের মিলিত রূপই হচ্ছে ”হিসাব বিজ্ঞান”। আভিধানিকভাবে ’হিসাব’ বলতে গণণা করাকে বুঝায়। আর বিস্তরিতভাবে বলতে গেলে ’হিসাব’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ”অর্থ বা অর্থের মাপকাঠিতে পরিমাপযোগ্য কোন কাজের আদান-প্রদান সম্পর্কিত ঘটনার বিবরণী।” আর ’বিজ্ঞান’ বলতে ”কোন বিষয় সম্পর্কে সুশৃংখল জ্ঞানকে বুঝানো হয়।” তাই সার্বিক অর্থে, ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সুশৃংঙ্খলভাবে লেনদেনের সংরক্ষণ, ফলাফল নির্ণয় ও বিশ্লেষণ করার নামই হচ্ছে ’হিসাববিজ্ঞান’।
 
অতি প্রাচীনকাল হতেই ভিন্ন আংগিকে হিসাববিজ্ঞানের প্রচলন হয়ে আসছিল, যা ছিল সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। প্রস্তর যুগে মানুষ যখন বনে জংগলে, পাহাড়-পর্বত, গুহায় বাস করত এবং জীবিকার জন্য ফল-মূল ও পশু-পাখি শিকার করত, তখন  তারা গাছের গায়ে বা গুহার গায়ে দাগ বা চিহ্ন দিয়ে বা দড়িতে গিঁট দিয়ে দৈনন্দিন শিকারের হিসাব লিখে রাখত। অনেকের মতে, প্রায় ৭০০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়া নদীর তীরে যে সভ্যতা গড়ে উঠে সেখানেও আদিম পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনের হিসাব রাখা হত। সেই হিসাবের মূল উপাদান ছিল বছরওয়ারী ফসল উৎপাদনের তুলনা করা আর মোট ফসলের কে কত অংশ মন্দিরে দান করত তার হিসাব রাখা। আর এই অবৈজ্ঞানিক হিসাবটি রাখা হত দেয়ালে চিহ্ন দেয়ার মাধ্যমে। এই প্রাচীন দেওয়াল লিখন গুলোকে অনেকেই হিসাববিজ্ঞানের প্রাচীন প্রচেষ্টা বলে মনে করেন। হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বিবেচনা করে, ৪০০০ হাজার বছরের পুরাতন ইতিহাসকে হিসাববিজ্ঞানের সূচনাকাল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। আর ১৩৪০ সালে হিসাববিজ্ঞানের যে যাত্রা শুরু হয় ইটালির ভ্যানিস শহরে-তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৪৯৪ সালে- লুকা প্যাসিওলি-র দুই-তরফা দাখিলা পদ্ধতির মাধ্যমে। তার সূত্র ও ব্যাখ্যার উপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের আধুনিক হিসাববিজ্ঞান।

অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, ১৯৭২ সালে সানডিয়াগোতে তরুণদেরকে হিসাববিজ্ঞানকে পেশা হিসাবে নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদানের জন্য পৃথিবীতে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ’হিসাববিজ্ঞান দিবস’অনাঢ়রম্বড়ভাবে পালিত হয়। এতে ব্যক্তিগত পর্যায়সহ সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা ও সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য হিসাববিজ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বিশ্বজুড়ে সব পেশার মানুষ তখন থেকেই এই নির্দিষ্ট দিবসে হিসাবদিদেরকে বিভিন্নভাবে সম্মাননা প্রদান করে থাকেন। সহকর্মীরা এই দিনে তাদের প্রতিষ্ঠানের হিসববিদদেরকে বিভিন্নভাবে প্রশংসা করে থাকেন। বিশেষ কর্মদক্ষতার জন্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান কর্তৃক তাদেরকে পুরষ্কৃত করা হয় এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সকল হিসাববিজ্ঞান কর্মীদের ’ধন্যবাদ নোট’ (Thank-You Note) দেওয়া হয়।

বর্তমান বিশ্বে ব্যবসা কার্যক্রম জটিল হওয়ার সাথে সাথে হিসাববিজ্ঞানীদের কর্মপরিধি ও দায়বদ্ধতাও যথেষ্ট পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে হিসাববিদদের বহুবিধ উচ্চ-মানের কাজের মাধ্যমে এই বিশ্বায়নের যুগে নিজেদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। এছাড়াও হিসাববিদদেরকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে নিজেদেরকে দক্ষ এবং আরও যুগোপযোগী ধ্যান-ধারনা প্রয়োগ করে সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে গণ-মানুষের কল্যাণে কাজ করতে  হবে। এছাড়াও এই বিশেষ দিবসে বিশ্ববাসী এই নিবেদিতপ্রাণ হিসাববিদদের ও এই মহান পেশাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশেও প্রতি বছর এই হিসাববিজ্ঞান দিবসটি বিশেষ কলেবরে ও গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। ইনষ্টিটিউট অব কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আই সি এম এ বি) ও ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড একাউন্ট্যান্টস্ অব বাংলাদেশ (আই সি এ বি)-এর সম্মানিত সদস্যরা এই দিনে শোভাযাত্রা করেন। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা, এনজিওসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি  প্রতিষ্ঠান এই উপলক্ষ্যে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে হিসাববিজ্ঞান পেশার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশদ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব একাউনন্ট্যান্টস্ (সাফা) পেশা হিসাবে হিসাববিজ্ঞানের গুরুত্ব আরোপ করে বিশেষ তাৎপর্যমূলক আলোচনার আয়োজন করে। এতে পৃথিবীর সেরা হিসাববিজ্ঞানীরা তাদের অবদান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে হিসাববিজ্ঞানকে আরও যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে কি কি ভূমিকা নেওয়া যায় তার উপর আলোকপাত করেন।

হিসাববিজ্ঞান ছাড়া কোন ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব। এর বাস্তবতা স্বীকার করে সকল অফিস-আদালত এখন ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন সফট্ওয়ারের (কম্পিউটার প্রযুক্তি) কল্যানে বর্তমানে সারাদিনের কাজ করা যাচ্ছে কয়েক মিনিটের মাধ্যমে। বর্তমানে হিসাববিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বেড়েছে বহুগুণে যার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুনাফাতেও। দেশের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রেও এর বিশাল ভূমিকা অনস্বীকার্য। হিসাবিজ্ঞান দিবসের এই দিনটিকে হিসাববিদদের জন্য ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা যেতে পারে। নামী-দামী সুপ্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে হিসাববিজ্ঞান পেশার গুরুত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা যেতে পারে। অভিজ্ঞ পেশাদার হিসাববিজ্ঞানীরা সেমিনারগুলোতে তাদের কর্ম-অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞান বিষয়টিকে অনেক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে ও তাদের কর্মক্ষেত্রেও বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবহারিক দিক থেকে আগের চেয়ে বেশি সচেতন হচ্ছে।
 
তবে এটা সত্যি যে, আমাদের দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও সাধারন মানুষের কাছে এখনও ’হিসাববিজ্ঞান দিবস’টি তেমনভাবে প্রচলিত হয়ে উঠেনি। সোস্যাল-মিডিয়াসহ অন্যান্য অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে এই পেশায় নিয়োজিতরা অন্য সবাইকে দিবসটি সম্পর্কে সচেতন করতে পারেন। ফেসবুকে ’শুভ হিসাব বিজ্ঞান দিবস’ (Happy Accounting Day) স্ট্যাটাস প্রদান করে দিবসটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন-যা দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে সবাইকে উৎসাহিত করবে।

একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন পেশাদার হিসাববিজ্ঞানী কর্মীদের উদ্ভাবনী শক্তি ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা দান করতে পারেন যার মাধ্যমে দেশ ও সমাজ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। আর সাধারন মানুষকেও একটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে হিসাববিদ ও হিসাববিজ্ঞানীদের কথা কোন অবস্থাতেই ভুলে গেলে চলবে না। কেননা হিসাববিজ্ঞানের জনক লুকা প্যাসিওলি বলেছিলেন, ”একজন ব্যাক্তি ডেবিট-ক্রেডিট না মিলিয়ে  কখনো রাতে ঘুমাতে যেতে পারে না”- তার এই মহান উক্তিই প্রমান করে প্রতিদিন হিসাববিদ ও হিসাববিজ্ঞানীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনা ও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কত সহস্র রজনী নিদ্রাহীনভাবে কাটিয়েছেন। আজকের এই দিনে তাই সকল হিসাববিদ ও হিসাববিজ্ঞানীদের জন্য রইল অনেক অনেক শুভ কামনা। শুভ হিসাববিজ্ঞান দিবস-২০২০!

মো. তৌহিদুল আলম খান, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি ইনস্টিটিউট অব কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্টস্ অব বাংলাদেশ (আই সিএম এ বি)-এর একজন ফেলো সদস্য