শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

শুনুন পদ্মাসেতুর ৪২ খুঁটিতে ৪১ স্প্যানের গল্প

কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, মুন্সীগঞ্জ

০৯:৩৯, ১১ ডিসেম্বর ২০২০

আপডেট: ০৯:৪৪, ১১ ডিসেম্বর ২০২০

৮৭২

শুনুন পদ্মাসেতুর ৪২ খুঁটিতে ৪১ স্প্যানের গল্প

পদ্মাসেতু
পদ্মাসেতু

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পদ্মাসেতুর ৪২টি খুঁটির ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। এর মধ্যে ২০১৭ সালে একটি, ২০১৮ সালে ৫টি, ২০১৯ সালে ১৪টি এবং চলতি বছর ২০২০ সালে ২১টি স্প্যান বসানো হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিস্ময় হয়ে শতভাগ দৃশ্যমান হলো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতল পদ্মাসেতু।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মাসেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান করা হয়। এরপর দ্বিতীয় স্প্যানটি বসতে সময় লেগে যায় প্রায় চার মাস। ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটির ওপর দ্বিতীয় স্প্যানটি বসানো সম্ভব হয়। তাতে সেতুর কাঠামো ৩০০ মিটার বিস্তৃত হয়। এরপর ফের প্রায় দেড় মাসের অপেক্ষা। পরে ১১ মার্চ ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটির ওপর তৃতীয় স্প্যান বসলো। আর দুই মাসের ব্যবধানে ১৩ মে ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির ওপর ৪র্থ স্প্যান, এবং অনেকটা একই সময়ের ব্যবধানে  ২৯ জুন ৫ম স্প্যানটি বসানো হয়। এগুলোর সব কটি স্প্যানই বসে জাজিরা প্রান্তে। তবে সে বছরের ১৩ অক্টোবর মাওয়া প্রান্তে দু’টি খুঁটির ওপর ৬ষ্ঠ স্প্যানটি বসানো হয়। ২০১৮ সালে সব মিলিয়ে ৫টি স্প্যান বসানো হয়। মোট কাঠামোয় সেতু তখন প্রায় ১ কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই।

এক কিলোমিটার কাঠামোর মাইল ফলক সেতু ছুঁয়ে ফেলে ২০১৯'র জানুয়ারিতেই। ২৩ জানুয়ারি জাজিরা প্রান্তের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর খুঁটির ওপর ৭ম স্প্যানটি বসলে সেতু ১ হাজার ৫০ মিটার দৃশ্যমান হয়। এরপর সেতু কর্তৃপক্ষ যেনো নতুন গতি পায়। কাজ এগুতে থাকে দ্রুত গতিতে। আর সে কারণে এক মাস যেতে না যেতেই পদ্মায় উঠে যায় আরেকটি স্প্যান। সেদিন ২০ ফেব্রুয়ারি ৩৫ ও ৩৬ নম্বর খুঁটির ওপর ৮ম স্প্যান টি বসে। মাসে একটি স্প্যান যেনো নিয়মে পরিণত হয় সেতু প্রকৌশলীদের কাছে। তাই ঠিক এক মাস পরে ২১ মার্চ ৩৪ ও ৩৫ নম্বর খুঁটির উপর ৯ম স্প্যানটি বসানো প্রত্যক্ষ করে দেশবাসী। এরপর আর এক মাস নয় মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে পরের স্প্যানটি বসানোর ঘোষণা আসে সেতু কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। ১০ এপ্রিল মাওয়া প্রান্তে ১৩ ও ১৪ নম্বর খুঁটির ওপর ১০ম স্প্যানটি বসিয়ে সেতুকে দেড় কিলোমিটার কাঠামো দেওয়ার মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন সেতু কর্তৃপক্ষ। 

এরপর বলা চলে সকলকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় তারা পরের স্প্যানটি বসানোর জন্যও প্রস্তুত। ২৩ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর খুঁটির উপর বসানো হলো ১১ তম স্প্যান। 

এরপর একটু বড় সময়ের ব্যবধান নিয়ে ১ মাস ১৩ দিন পরে ৬ মে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝামাঝি স্থানে ২০ ও ২১ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১২তম স্প্যানটি। এবং ১৯ দিনের মাথায় ২৫ মে মাওয়া প্রান্তের ১৪ ও ১৫ নম্বর খুঁটির ওপর ১৩তম স্প্যানটি বসিয়ে ফেলা হয়। 

চার বছরের অভিজ্ঞতা বলছে বর্ষা মৌসুম এলে সেতুর কাজ কিছুটা মন্থর হয়ে পড়ে। প্রমত্ত পদ্মা সেই সময়টিতে ফুসতে গর্জাতে থাকে। দুই পাড় ভাঙতে থাকে ভীষণ আক্রোশে। ২০১৯ও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না। বরং ভাঙ্গন হানা দিয়েছিলো সেতুর কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডেও। সেসব সামলে প্রায় ৫ মাস পার করে সে বছরের ১৪ অক্টোবর জাজিরা প্রান্তের ২৮ ও ২৯ নম্বর খুঁটির ওপর ১৪ তম স্প্যানটি বসায় সেতু কর্তৃপক্ষ। ফলে সেতু কাঠামো ২ কিলোমিটারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়। 

তবে এবার অপেক্ষা করছিলো আরো বড় অপেক্ষার পালা। ঠিক এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সেতু কর্তৃপক্ষ জানালো তারা ১৫তম স্প্যানটি বসাতে প্রস্তুত। এবং যেই বলা সেই কাজ। ২২ অক্টোবর ২৮ ও ২৯ নম্বর খুঁটির ওপর বসিয়ে দেওয়া হলো ১৫তম স্প্যানটি। এর ২৮ দিনের মাথায় ১৯ নভেম্বর মাওয়া প্রান্তের ১৬ ও ১৭ নম্বর খুঁটির ওপর বসলো ১৬তম স্প্যান। তবে এরপর ফের এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৬ নভেম্বর জাজিরা প্রান্তের ২২ ও ২৩ নম্বর খুুঁটির ওপর নম্বর ১৭ তম স্প্যানটি বসলো। ১১ ডিসেম্বর ১৭ ও ১৮ নম্বর খুঁটির ওপর ১৮তম স্প্যানটি, ১৮ ডিসেম্বর ২১ ও ২২ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১৯তম স্প্যানটি এবং বিদায়ী বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ১৮ ও ১৯ নম্বর খুঁটির ওপর ২০ তম স্প্যান বসানো হয়। ২০১৯ সালের মধ্যেই পদ্মাসেতুর কাঠামো বেড়ে বেড়ে ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলে।

তিন হাজার ১৪০ টন ওজনের প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। এ হিসেবে, ২০টি স্প্যান স্থাপনে পদ্মার সেতুর মূল অবকাঠামো দৈর্ঘ্যে ৩০০০ মিটার বা ৩ কিলোমিটারে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালে ১৪টি স্প্যান বসানো সম্ভব হয়। সে হিসেবে গড়ে প্রতি এক মাসেরও কম সময়ে বসানো হয় একটি করে স্প্যান। 

২০২০ সালের শুরুতে কাজের গতি বাড়তে থাকে। নতুন বছরে ১৪ জানুয়ারি ৩২ ও ৩৩ নম্বর খুঁটির ওপর ২১তম স্প্যানটি বসানো হয়। ২৩ জানুয়ারি মাওয়া প্রান্তের ৫ ও ৬ নম্বর খুঁটির ওপর বসে ২২তম স্প্যানটি এবং এক সপ্তাহ কাটিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি জাজিরা প্রান্তের ৩১ ও ৩২ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় পদ্মাসেতুর ২৩তম স্প্যান। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি জাজিরা প্রান্তে সেতুর ৩০ ও ৩১ নম্বর খুঁটির ওপর ২৪তম স্প্যানটি বসানো হয়। এরপর ১০ দিনের মাথায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২৫তম স্প্যানটি  বসানো হয়। ১০ মার্চ জাজিরা প্রান্তের ২৮ ও ২৯ নম্বর খুঁটির ওপর ‘৫-ডি’ নম্বরের ২৬তম স্প্যানটি বসে। এবং ২৮ মার্চ ২৭তম স্প্যান বসানোর দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৮তম স্প্যান ২০ ও ২১ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১১ এপ্রিল। এতে পদ্মা সেতু মূল অবকাঠামো ৪ হাজার ২০০ মিটার দৃশ্যমান হয়ে নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। 

এরই মধ্যে গোটা বিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও হানা দেয় করোনা মহামারি। চীনা প্রকৌশলীরা অনেকেই দেশে ফিরে যান। এতে কাজের গতি কমে। তবে তার মধ্যেও দেড় মাসের কিছুটা বেশি সময়ের ব্যবধানে ২৯তম স্প্যানটি জাজিরা প্রান্তের ২৬ ও ২৭ নম্বর খুঁটির উপর বসানো হয় ৪ মে ২০২০ তারিখে। সে মাসের মধ্যেই ৩০ মে বসানো হয়  ৩০তম স্প্যান বসানো হয় সেতুর ২৬ ও ২৭ নম্বর খুঁটির উপর। এতে সেতু কাঠামো পায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। 

১০ দিনের মাথায় ৯ জুন জাজিরা প্রান্তে ২৫ ও ২৬ নম্বর খুঁটির উপর  ৩১তম স্প্যান বসানো হলো। কিন্তু করোনার প্রকোপ বাড়তেই থাকলে দেশ জুড়ে লকডাউন ও অন্যান্য বিধি-নিষেধের প্রভাব পড়ে সেতু প্রকল্পের ওপর। সঙ্গে শুরু হয় সেই একই বর্ষা মওসুম। দেশজুড়ে দেখা দেয় বন্যা। এসব কারণে সেতুর উপর স্প্যান বসানোর কাজ বন্ধ রাখে সেতু কর্তৃপক্ষ। 

ঠিক চার মাস পরে ১০ অক্টোবর মাওয়া প্রান্তের ৪ ও ৫ নম্বর খুঁটির ওপর ৩২তম স্প্যান বসিয়ে কাজে ফেরে কর্তৃপক্ষ। পরের দুটি মাসের কথা এখন সকলেরই জানা। সপ্তায় সপ্তায় একটি করে স্প্যান বসানোর ঘোষণা দিতে থাকে ও তা বাস্তবায়ন করতে থাকে সেতু কর্তৃপক্ষ। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯ অক্টোবর মাওয়া প্রান্তের ৩ ও ৪ নম্বর খুঁটির ওপর ৩৩তম স্প্যানটি বসানোর ছয় দিনের মাথায় ২৫ অক্টোবর মাওয়া প্রান্তের ৭ ও ৮ নম্বর খুঁটির ওপর ৩৪তম স্প্যানটি বসানো হয়। সে মাসের ৩১ অক্টোবর বসানো হয় ৩৫ তম স্প্যানটি বসিয়ে এক মাসে চারটি স্প্যান বসানোর রেকর্ড তৈরির পাশাপাশি সেতু কাঠামো ৫ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। সেতুর পূর্ণ কাঠামো পেতে তখন আর বাকি থাকে ৯০০ মিটার। হাতে ছয়টি স্প্যান। 

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ৬ নভেম্বর মাওয়া প্রান্তের ২ ও ৩ নম্বর খুঁটির ওপর ৩৬তম স্প্যানটি বসে যায়। সপ্তাহে একটি স্প্যান- সেই গতিতেই ১২ নভেম্বর ৯ ও ১০ নম্বর খুঁটির ওপর বসে ৩৭তম স্প্যানটি। আর ১৮ নভেম্বর মাওয়া প্রান্তের ১ ও ২ নম্বর খুঁটির ওপর ৩৮তম স্প্যানটি বসিয়ে ফেলা হয়। ২৭ নভেম্বর ১০ ও ১১ নম্বর খুঁটির ওপর ৩৯তম স্প্যানটি বসলে মাসে চারটি স্প্যানের কোটা পূরণ করে সেতু কর্তৃপক্ষ। এরপর রইলো বাকি দুই। সামনে বিজয়ের মাস। 

বিজয়ের মাসে ৪ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তে ১১ ও ১২ নম্বর খুঁটির ওপর ৪০তম স্প্যানটি বসিয়ে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। লক্ষ্য ছিলো ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের আগেই নতুন এই আরেক বিজয়ের স্বাদ দেশবাসীকে দেওয়া হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বিজয়ের দিনটি আসারও ছয় দিন আগে ১০ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামো শতভাগ দৃশ্যমান করে প্রমত্তা জয় করে নেয় বাঙালি জাতি।

উল্লেখ্য, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতল পদ্মা সেতুতে সব মিলিয়ে ৪২টি খুঁটি। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে ২১টি ও জাজিরা প্রান্তে ২১টি। আর ৪২টি খুঁটির ওপর বসেছে ৪১টি স্প্যান। এর মধ্যে ৪০টি খুঁটি থাকবে পানিতে আর ২টি ডাঙায়। ডাঙায় থাকা দু’টি খুঁটি সংযোগ সড়কের সঙ্গে মূল সেতুকে যুক্ত করবে। ৬টি মডিউলে বিভক্ত থাকবে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে এক হাজার ৪৭৮ মিটার ভায়াডাক্ট বা ঝুলন্ত পথ ও জাজিরা প্রান্তে থাকবে এক হাজার ৬৭০ মিটার। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতল পদ্মা সেতুর পুরোটাই নির্মিত হচ্ছে স্টিল ও কংক্রিট স্টাকচারে। সেতুর ওপরে তৈরি হচ্ছে কংক্রিটিং ঢালাইয়ের চাল লেনের মহাসড়ক আর তার নিচ দিয়ে যাচ্ছে রেললাইন। মূল কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে এখন ধুন্ধুমার চলছে সড়ক ও রেল স্ল্যাব বসানোর কাজ। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত