শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ || ২১ বৈশাখ ১৪৩১ || ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নানা সঙ্কটে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সম্ভাবনাময় লাক্ষা চাষ

আজমাল হোসেন মামুন, শিক্ষক ও সাংবাদিক

১৫:৪৫, ৭ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১৬:১৬, ৭ আগস্ট ২০২১

২০৬৭

নানা সঙ্কটে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সম্ভাবনাময় লাক্ষা চাষ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী শিবগঞ্জ উপজেলা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর আগে লাক্ষা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও বর্তমানে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। 

লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ মোখলেসুর রহমান জানান, নিঃসন্দেহে লাক্ষা চাষ লাভজনক। কিন্তু নানা সমস্যার জন্য কৃষক লাক্ষা চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাচোল ও নওগাঁতে পোরশা উপজেলায় কিছু লাক্ষা চাষ হচ্ছে। চারদিকে প্রচুর আমবাগানে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষিত হওয়ার ফলে লাক্ষা পোষক মারা যাচ্ছে। মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন লাক্ষা চাষীরা।

পাশাপাশি ভারত থেকে এলসির মাধ্যমে লাক্ষা আসায় দেশি উৎপাদিত লাক্ষার ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, অবাধে লাক্ষা উৎপাদিত বৃক্ষ নিধন এবং বেসরকারি উদ্যোক্তার অভাবে লাক্ষা চাষ ভেস্তে যেতে বসেছে।

লাক্ষা এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র পোকা, ক্যারিয়া ল্যাক্কা কর্তৃক নিঃসৃত রজন জাতীয় পদার্থ। দেখতে অনেকটা উকুনের মতো। এটা প্রাণিজাত বহুমুখী কর্মশক্তি সম্পন্ন এক ধরনের রজন যার অনুপম গুণাগুণের জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লাক্ষা পোকার ত্বকের নীচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে আঁঠালো রস নিঃসৃত হয়, যা ক্রমশ শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে ফেলে।পোষক গাছের ডালের এ আবরণকেই 'লাক্ষা' বলা হয়। তবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের কাছে 'লাহা' হিসাবে পরিচিত এ লাক্ষা। 

পরবর্তীকালে ডালের উক্ত শক্ত আবরণ ছাড়িয়ে ও শোধিত করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে সকল প্রজাতির গাছের লাক্ষা ভালো জন্মায় সেগুলোকে লাক্ষার পোষক গাছ বলা হয়। প্রায় ১০০ প্রজাতির গাছে লাক্ষা জন্মানো গেলেও মাত্র কিছু প্রজাতিতে লাক্ষাপোকা ভালোভাবে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। বাংলাদেশে বরই, শিরিষ (কড়ই), বট, পাকুড়, পলাশ, খয়ের, বাবলা, ডুমুর, অড়হড়, কুসুম প্রভৃতি গাছে লাক্ষা ভালো জন্মে। তবে আবাদি জমির মধ্যে বরই জাতীয় পোষক গাছ লাগালে লাভজনকভাবে বিভিন্ন ফসলের চাষ করাও সম্ভব হওয়া সত্ত্বেও এখন নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কৃষক। বিভিন্ন ফসলের একক চাষের ফলে যে পরিমাণ লাভবান হওয়া যায় সে তুলনায় লাক্ষার সঙ্গে সাথী ফসলের চাষ করে ৪ গুণ লাভ পাওয়ার আশায় গম, কচু ও হলুদ সাথী ফসল হিসাবে চাষাবাদ করা যায়।

দুই ধরনের লাক্ষা পোকা বিভিন্ন ধরনের লাক্ষা ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। বরই, শিরিষ, বট, পাকুড়, পলাশ, খয়ের, বাবলা, ডুমুর ও অড়হড় ইত্যাদি পোষক গাছগুলোর যে পোকা লাক্ষা উৎপাদন করে তাদের রঙ লাল বলে রঙ্গিনী পোকা বলে। অপরদিকে আর এক ধরনের লাক্ষা পোকা কেবল কুসুম গাছে ভালোভাবে বৃদ্ধি লাভ ও বংশ বিস্তার করতে পারে যাদের রঙ হলদে বা কুসুমী । সে জন্য এরা কুসুমী পোকা নামে পরিচিত। মজার বিষয়, প্রতিবছর দুই প্রকারের লাক্ষা পোকা দুই বার ফসল দিতে পারে। সেজন্য বছরে ৪টি ফসল পাওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশে কুসুমী পোকার অপর্যাপ্তরার কারণে রঙ্গিনী পোকা দ্বারা লাক্ষা চাষ করা হয়। রঙ্গিনী পোকা থেকে বছরে দুইবার বৈশাখ ও কার্তিক মাসে ছাড়ানো লাক্ষা পাওয়া যায়। রঙ্গিনী পোকা কার্তিকী ফসলের সঙ্গে জুন-জুলাই মাসে লাগানোর পর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এবং বৈশাখী ফসলের সঙ্গে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে লাগানোর পর এপ্রিল-মে মাসে লাক্ষা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

লাক্ষার উপাদান কাঠের আসবাবপত্র বার্ণিশ করা, বিভিন্ন ধরনের বার্ণিশ পেইন্ট,পারফিউম, অস্ত্র কারখানা, রেলওয়ে কারখানা, লবণাক্ত পানি হতে জাহাজের তলদেশ রক্ষার কাজে বার্ণিশ, ওষুধ, স্বর্ণালঙ্কারের ফাঁপা অংশ পূরণ,

চামড়া ও বৈদ্যুতিক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা, পিতল ও আসবাবপত্রের বার্ণিশে ব্যবহার হয়। এছাড়াও ডাকঘরের চিঠি, পার্সেল সিলমোহর, পুতুল, খেলনা,আলতা, নখরঞ্জন, শুকনো মাউন্টিং টিস্যু পেপার ইত্যাদি তৈরির কাজে লাক্ষা ব্যবহৃত হয়।

ইদানীং এর উপাদান চকলেট, চুইংগাম ও লেবু জাতীয় ফলের সংরক্ষণ গুণ বৃদ্ধির জন্য কোটিন হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, ভারত, দক্ষিণ চীন, সমগ্র মিয়ানমার, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ, থাইল্যন্ড ও তাইওয়ানে বাণিজ্যিকভাবে লাক্ষা পোকার চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে আবার ভারত ৮০ ভাগ এবং অন্যান্য দেশে বাকি ২০ ভাগ চাষ হয়। ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও আসাম প্রদেশেই বেশিরভাগ লাক্ষা উৎপাদন করে থাকে।তবে বাংলাদেশে খুবই সামান্য লাক্ষা চাষ হয়। যা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল-এর এনএটিপি এর অর্থায়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় দেশের নওগাঁ, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গাজীপুর অঞ্চলে লাক্ষা গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এর সাথে ওই অঞ্চলের প্রান্তিক ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠিকে লাক্ষা চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বাৎসরিক প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে লাক্ষা চাষ হয় এবং সেখান থেকে মাত্র ১ হাজার মেট্রিকটনের মত ছাড়ানো লাক্ষা উৎপাদিত হয়। অথচ বাংলাদেশের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ২০ মেট্রিকটনের বেশি। তবে এর বাইরে পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে এর বাজার।

লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য মতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বর্তমানে লাক্ষার যে পোষক রয়েছে সেখান থেকে বছরে প্রায় ৫০০ টন‌ লাক্ষা উৎপাদন করা সম্ভব। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকার মত। এখান থেকে প্রায় ২০ হাজার ভূমিহীন প্রান্তিক কৃষকের কর্মসংস্থান করাও সম্ভব হলেও বর্তমানে লাক্ষা চাষের অবস্থা হতাশা ব্যঞ্জক।

ড. মোঃ মোখলেসুর রহমান জানান, লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রে মাত্র ১ জন বিজ্ঞানী রয়েছেন।আরো বিজ্ঞানী দরকার।যাতে লাক্ষা চাষ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা যায়। সরকারিভাবে ভারত থেকে উন্নত জাতের লাক্ষা পোষক আনা হবে। এতে লাক্ষা চাষিদের আগ্রহ বাড়বে। এটি ফলনশীল দেশি জাতের লাক্ষার চেয়ে।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ অনেক জেলায় লাক্ষার অসংখ্য পোষক গাছ অযত্ন অবহেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ গাছগুলোকে লাক্ষা চাষের আওতায় আনা হলে প্রচুর পরিমাণে লাক্ষা উৎপাদনের পাশাপাশি বিশাশ কর্মহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত