শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বঙ্গ তথা ভারতের সাহিত্য জগতে `শঙ্খ`ধ্বনি স্তব্ধ

সাদ্দাম হোসেন, সাংবাদিকতার শিক্ষক (কলকাতা)

১৪:৪৬, ২৫ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ১৪:৫৪, ২৫ এপ্রিল ২০২১

১৪৩৮

বঙ্গ তথা ভারতের সাহিত্য জগতে `শঙ্খ`ধ্বনি স্তব্ধ

কবি শঙ্খ ঘোষের মহাপ্রয়াণে
কবি শঙ্খ ঘোষের মহাপ্রয়াণে

বাংলা তথা ভারতের কবিতা ও সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁর লেখা এবং কলমের কালিতে তিনি সমাজকে ধ্বনিত করতেন, কিন্তু সর্বগ্রাসী করোনা এই ধ্বনি স্তব্ধ করে দিল। 

কবির লেখায় সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার চরিত্র ফুটে ওঠে। সমাজে কবির লেখার দ্বারা সচেতন এবং সাহসী নাগরিক বানানোয় এক বড় অবদান ছিল তাঁর। শঙ্খ ঘোষ গদ্যকার প্রাবন্ধিক হিসেবে অন্যতম হলেও, তাঁর প্রধান পরিচয় তাঁর কবিতা । উনি কবিতার দ্বারা সমাজে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন । উনার পংক্তির মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং সত্য যথার্থ জিনিসকে কেড়ে নেওয়ার জোড় থাকতো । যেমন কবিতার পংক্তি;

পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি 
কাজেই এখন স্বাধীন মত ঘুরি

উনার বিদ্রোহী সৎ চরিত্র সকল পাঠক এর কাছে তাঁকে করেছিল অতি প্রিয় এবং সম্ভ্রান্ত | ঠিক তেমনই 'মুক্ত গণতন্ত্র' নামের কবিতায় লিখেছিলেন;

যথার্থ এই বীরভূমি, উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে পেয়েছে শেষ তীর ভূমি ।
দেখ খুলে তোর তিন নয়ন, রাস্তাজুড়ে খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন ।

তিনি শব্দের সাথে সামাজিক সত্য গুলোকে নিয়ে সর্বক্ষণ নিরীক্ষণ করতে থাকতেন । সমাজে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর রূঢ় বাস্তব গুলো শব্দের দ্বারা চিত্রায়ন করে এই সমাজের পাঠকদের কাছে তুলে ধরতেন। যেমন 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে' কবিতায় তিনি লিখেছেন;

মুখের কথা একলা হয়ে 
রইলো পড়ে গলির কোণে
 ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু 
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।

তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে আমরা পাঠকরা সামাজিক বিবেক কাকে বলে তা উপলব্ধি করি এবং অনুভব করতে শিখেছি। এইসব সামাজিক মননের সচেতন কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি দেখিয়েছিলেন আমাদের মুখ কিভাবে বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায় । বর্তমানে বিকট ছবিসহ বিশাল বিজ্ঞাপনের আড়ালে ক্রমশ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সকলের মুখ ।
 
তাঁর লেখার মধ্যে একাধারে যেমন বিদ্রোহ প্রবণতা আছে ঠিক অন্যদিকে কবিতার জগতের সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া যায়। ১৯৭৭ সালে 'মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়' কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন নরসিংহ দাস পুরস্কার । কবির লেখার মধ্যে দিয়ে সমকালের বাস্তব চিত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢেউ তুলেছেন; গুজরাটের দাঙ্গা থেকে নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর | ফসলি জমি দখল ও প্রতিবাদী কৃষকদের উপর নির্মম অত্যাচার ও উৎপীড়ণের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন বারবার ।

ঠিক তেমনই উত্তরবঙ্গে যথার্থ খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তরুণের মৃত্যু হয়েছিল, সেই প্রতিবাদে তাঁর ঐতিহাসিক কবিতা 'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে' এবং 'যমুনাবতী এবং সরস্বতী' কবিতাগুলি আজও জীবিত ।  তিনি কথা কম বলতেন আর তাঁর কলমের কালি আর শব্দ ছিল উনার গর্জনের ধ্বনি। কবি বলতেন 'চুপ করো শব্দহীন হও’ |

কবি তাঁর পোশাকের মধ্যে দিয়েও বাঙালি ও বাঙালিয়ানাকে উচ্চশিরে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাঙালি ভদ্রলোক পোশাক বলে আন্তর্জাতিক ধারণা 'ধুতি ' আর এই বাঙালিয়ানাকে রেখে কবি সব জায়গায় ধুতি পড়ে থাকতেন এবং শেষ পর্যন্ত ধুতি ব্যবহার করতেন । বাঙালির প্রিয় শঙ্খ ধ্বনির সাথে শেষ ধুতিটিও চিরতরে বিদায় নিলো। তাঁর পংক্তি এবং শব্দ, বঙ্গ তথা গোটা ভারতবর্ষে সমাজ চেতনার সূচক হয়ে থাকবে সবসময়।

শঙ্খ ঘোষের লেখা আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক আর বাস্তববাদী করে তুলুক, এবং আলোর পথ দেখানোর চাবিকাঠি হিসেবে চিরদিনের জন্য স্মৃতি হয়ে থাকুক । ছোটদের জন্য ছড়া, উপন্যাস থেকে শুরু করে কবিতা শিল্প সাহিত্য এবং রবীন্দ্র গবেষক সুবাদে তিনি খ্যাতনামা এবং অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হন; নরসিংহ দাস পুরস্কার , সাহিত্য একাডেমী , রবীন্দ্র পুরস্কার সরস্বতী সম্মান, কবির সম্মান, দেশিকোত্তম, পদ্মভূষণ ও জ্ঞানপীঠ | ২১ এপ্রিল, ২০২১ তাঁর ইন্দ্রপতন ঘটে | আর সমগ্র বাঙালি জাতিকে শঙ্খধ্বনি থেকে চিরতরে বঞ্চিত করে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান |

সাদ্দাম হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগ, নেতাজি নগর কলেজ, কলকাতা
[email protected]

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank