দুর্নীতির মহাচক্রের কবলে ইউজিসি : আলোর নিচে অন্ধকার
দুর্নীতির মহাচক্রের কবলে ইউজিসি : আলোর নিচে অন্ধকার
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার এই নিয়োগ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এস এম এ ফায়েজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এক.
প্রথম প্রশ্ন— বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাজ কী?
উত্তরে বলা যায়— ইউজিসি বাংলাদেশের সকল সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। মূলত সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই সংস্থাটি সমন্বয়সাধন করে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে স্থাপিত হয়ে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। প্রথমদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ এবং বিষয় অনুমোদনের মধ্যে কমিশনের কর্মকাণ্ড সীমিত থাকলেও বর্তমানে এর কাজ অনেক বিস্তৃত। গবেষণা, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, ইউজিসি লাইব্রেরি এবং উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রভৃতি প্রকল্প তৈরি করে বাস্তবায়ন করা।
দুই.
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ইউজিসি কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে? শক্ত অভিযোগ রয়েছে— পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি ও অনিয়মকে বৈধতা দেবার জন্য ইউজিসি একটি সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার ব্যবস্থাপনা, কোর্স কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠদান, শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি পরীক্ষা, শ্রেণিকক্ষের পাঠদান কোয়ালিটি, পরীক্ষা মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি বিরাজমান রয়েছে। এসব অব্যবস্থাপনাকে ইউজিসি’র অসাধু চক্র টাকার বিনিময়ে বৈধতা দেয়। ইউজিসি’র স্ট্যাটেজিক প্লানিং এন্ড কোয়ালিটি এস্যুরেন্স বিভাগ অদক্ষ অপেশাদার লোকবল নিয়োগ দিয়ে অর্থলোপাট বাণিজ্য চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে! বিষয়ভিত্তিক এক্সপার্ট না নিয়ে অপেশাদার ভুয়া বিশেষজ্ঞ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাস মূল্যায়ন ও কোয়ালিটি নিশ্চিতকরণ অভিযান পরিচালনার নামে প্রকল্প তৈরে করেছে। OBE (Outcome-based education) নামে শুধুমাত্র কাগজে-কলমে সফল আসলে বাস্তবে প্রয়োগহীন ফালতু একটা প্রকল্প চালু করেছিল ইউজিসি’র পূর্বতন উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ইউজিসি’র দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের স্বপদে বহাল রেখে শুধু কদিন পরপর চেয়ারম্যান বদল করলে কোনো লাভ হবে না! ইউজিসি’র ভেতরের চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের বাদ দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে। সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধু শিক্ষক ও কর্মকর্তা ও ইউজিসি’র অসাধু চক্রের যোগসাজশে একটি বৃহৎ মহাদুষ্টচক্রে রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি গোপনে গিলে খাচ্ছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে, প্রশাসনিক কাঠামোকে সর্বোপরি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে। এই মহাচক্র খুব শক্তিশালী এদের বিনাশ করা চাট্টিখানা কাজ নয়! ইউজিসি’র পূর্বতন চেয়ারম্যান, কর্মকর্তা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ভিসি, প্রো-উপাচার্য, ট্রেজেরার ও চিহ্নিত অসৎ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে কমিশন গঠন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মিলেমিশে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছে। এদের মুখোশ উন্মোচন করে আইনের আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিন.
প্রত্যাশা রাখছি— ইউজিসি’তে সদ্যনিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ এই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তের মহাচক্রকে বিনাশ করবেন। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির অপসংস্কৃতির সুবিধাগ্রহণ বন্ধ করবেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার অপনীতির পথ রুদ্ধ করবেন। গবেষণার নাম করে শিক্ষকদের ভুয়া প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ লোপাটের রাস্তা বন্ধ করবেন। শিক্ষক নিয়োগ ও পেশাগত পদোন্নতিতে সঠিক নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যেমন-তেমন করে ভুয়া আর্টিকেল ছাপিয়ে প্রমোশনের পথ বন্ধ করতে হবে। গবেষণা জার্নাল ডাবল ব্লাইন্ড পিআর রিভিউড্ হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষকগণ নিজেরা নিজেদের আর্টিকেল রিভিউ করে সেই আর্টিকেল মুদ্রণপূর্বক পদোন্নতি নিয়ে থাকে, আশা করছি— আপনি এসব অসৎ পথ বন্ধ করবেন। যাঁরা ভিসি প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, প্রক্টর, ডিন বা প্রভোস্ট বা প্রশাসনিক পদে নিয়োগ পাবেন তাদের নিজেদের স্ত্রী/স্বামী, সন্তান, ভাই-বোন, পিতা-মাতা ও শ্বশুর-শাশুড়ী, শ্যালক-দেবব প্রমূখের বর্তমান আয়-ব্যয় ও স্থাবর অস্থাবর সম্পদের বিবরণী অত্যাবশ্যকীয় ভাবে জমা দিতে হবে। এবং বছরান্তে অডিট করে অর্থআয়ের জবাবদিহি নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি, গবেষণা, সঠিক সময়ে ক্লাস নেয়া, পরীক্ষা মূল্যায়ন, যথাসময়ে রেজাল্ট প্রকাশে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আমরা বহুকাল যাবত দেখে আসছি- দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব অরাজক সংস্কৃতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব ক্ষেত্রে ভীষণ অসহায়। আপনাকে শক্তভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে হবে এবং আইন অমান্যকারীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
নামসর্বস্ব অথর্ব মঞ্জুরি কমিশন আমরা আর দেখতে চাই না! আপনার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নতুন করে ঘুরে দাঁড়াক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক শিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞান চর্চা ও উৎপাদনের পবিত্রভূমি।
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ