জিআই পণ্য ও স্মার্ট বাংলাদেশ
জিআই পণ্য ও স্মার্ট বাংলাদেশ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের একটি আলোচিত বিষয় জিআই পণ্য। কেননা একটি দেশের বিশেষ স্বীকৃতির নাম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই বা GI- Geographical Indication )। এটা হলো ভৌগোলিক নির্দেশক চিহ্ন যা কোন পণ্যের একটি নির্দিষ্ট উৎপত্তি স্থলের কারণে এর খ্যাতি বা গুণাবলী নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। জিআই পণ্যগুলো হচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ। জিআই স্বীকৃতি ও সনদের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার উৎপাদিত পণ্যের স্বত্ব বা মালিকানা লাভ করে। মূলত কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ পণ্যকে চিহ্নিত ও পরিচিত করতে ভূমিকা রাখে জিআই স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি আঞ্চলিক পণ্যের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে এবং এই নামের উপর গুরুত্ব দিয়ে ক্রেতারা পণ্যটি কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) মতে, জিআই একটি দেশ, অঞ্চল বা এলাকার পণ্যের চিহ্ন বা নামকে ইঙ্গিত করে। সেই নির্দিষ্ট পণ্যের ভৌগোলিক গুণ, মান ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (WIPO) সংজ্ঞা অনুসারে, জিআই বলতে কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, নাম বা চিহ্নকে বোঝায়। ভৌগোলিক কারণে সে পণ্যের আলাদা গুণ ও খ্যাতি থাকতে হয়। যেহেতু এর গুণাগুণ ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, কাজেই পণ্য ও এর উৎপত্তিস্থলের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকে।
সাধারণতঃ জিআই পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্যর উৎপত্তি স্থলের নাম যথা শহর, অঞ্চল বা দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে এবং কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায় যেটা বিশেষ গুণাবলীর কারণে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি লাভ করে থেকে। কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যদি সে দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া, পরিবেশ কিংবা কারিগরের বিশেষ দক্ষতার কারণে অনন্য হয় তাহলে সেই অনন্য হওয়া পণ্যকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থ্যাৎ, কৃষি, হস্তশিল্প, খাবার, প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত কিংবা কারিগর দ্বারা তৈরি হওয়া পণ্যগুলো জিআই স্বীকৃতি পাবে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ঢাকাই জামদানি, রাজশাহী সিল্ক , দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল, রংপুরের শতরঞ্জি এবং বাংলাদেশের ইলিশ। একটি বিশেষ পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে কেননা পণ্যের বিস্তারিত না জানলেও খ্যাতির উপর নির্ভর করে সেই পণ্যটি ব্যবহার করতে পারে ভোক্তারা। জিআই পণ্যের স্বীকৃতি ভৌগোলিক পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে এবং রপ্তানি বাড়াতে জিআই স্বীকৃতি গুরুত্ব বহন করে। উদাহরণ হিসেবে, জিআই পণ্য হিসেবে সনদ পাওয়ার কারণে ‘ইলিশ মাছ’ কিংবা ‘জামদানি শাড়ি’ বাংলাদেশ ব্যতীত অন্যকোন দেশ সরাসরি রপ্তানি করতে পারবে না। এই দুটি পণ্য পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপাদন হলেও বাংলাদেশের পণ্যেগুলোর সাথে শতভাগ বৈশিষ্ট্যে মিলবে না। মূলত এ যুক্তির দলিল বহন করে জিআই স্বীকৃতি।
জিআই পণ্যের সাথে জেলার নাম সংযুক্ত করে আবেদন করলে পণ্যের সাথে জড়িয়ে যায় জেলা ব্র্যান্ডিং আর জেলার নাম না থাকলেও পণ্যের ব্র্যান্ডিং, চাহিদা, উৎপাদন, আয় সবকিছুর সুবিধা ভোগ করে জেলার উৎপাদনকারীরা। যার ফলে ঐ জেলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে, ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’, ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’, ‘কুমিল্লার রসমলাই’।
জিআই ট্যাগের সুবিধা হলো নিজেদের আঞ্চলিক ও বিশেষ পণ্যের আইনি সুরক্ষা পাওয়া যায়। যাতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্য কেউ বা কোনো দেশ সে পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব দাবি করতে না পারে। সংশ্লিষ্ট পণ্যের সুনাম, ন্যায্যমূল্য ও মুনাফার পুরো ভাগীদার কেবল সেই জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্ত দেশ হতে পারে।
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী বৈশিক প্রতিষ্ঠান হলো WIPO (World Intellectual Property Organization)। WIPO এর নিয়ম মেনে বাংলাদেশের জিআই পণ্য স্বীকৃতি ও সুরক্ষার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান ‘পেটেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর’ ( DPDT- Department of Patent Design & Trade Mark) কাজ করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে উৎপাদিত বিশেষগুণ সম্পন্ন পণ্যগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৫ অনুযায়ী জিআই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে এই অধিদপ্তর। যে পণ্য জিআই নিবন্ধন নিয়মের আওতাধীন পড়ে সেই পণ্যগুলো কেবল জিআই নিবন্ধন পেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে যেসব পণ্য বাংলাদেশে প্রচলিত কোনো আইনের পরিপন্থী, নৈতিকতার পরিপন্থী, প্রতারণার আশঙ্কা থাকে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে, আক্ষরিক অর্থে দেশের ভুখণ্ডের হলেও প্রকৃতপক্ষে অন্য কোন ভূখণ্ডের ইত্যাদি পণ্যের জিআই নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
২০১৬ সালের ১৭ই নভেম্বর ‘জামদানি শাড়ি’ স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের জিআই স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিকতা পায়। বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বমোট জিআই পণ্য হচ্ছে ২১টি যথাঃ ১.জামদানি শাড়ী; ২.ইলিশ মাছ; ৩. চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আম; ৪.বিজয়পুরের সাদামাটি; ৫.দিনাজপুর কাটারীভোগ; ৬.বাংলাদেশ কালিজিরা; ৭.রংপুরের শতরঞ্জি; ৮.রাজশাহী সিল্ক; ৯.ঢাকাই মসলিন; ১০.বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি; ১১.রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলী আম; ১২.শেরপুরের তুলশীমালা ধান; ১৩.চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম; ১৪.চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম; ১৫.বগুড়ার দই; ১৬.সিলেটের শীতলপাটি; ১৭.নাটোরের কাঁচাগোল্লা; ১৮.টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম; ১৯.কুমিল্লার রসমালাই; ২০.কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং ২১. কুষ্টিয়ার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। প্রতিনিয়ত বাড়ছে বাংলাদেশের জিআই পণ্যর সংখ্যা। নতুন ১৪টি পণ্যের আবেদন জমা পড়েছে। ইতিমধ্যে টাঙ্গাইল শাড়ি; গোপালগঞ্জের রসগোল্লা ও নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা এই তিনটি পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন গেজেট আকারে প্রকাশিত করেছে ডিপিডিটি। এখন থেকে দুই মাস এই গেজেট ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে রাখা হবে। কারও যদি কোনো অভিযোগ না থাকে, তবে দুই মাস পর এই ৩টি পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এখানে উল্লেখ্যে যে, জিআই পণ্যর সনদের মেয়াদ ৫ বছর এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে জিআই সনদ নবায়ন করতে হয়।
WIPO পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারতের জিআই পণ্য ছিল ৩৩০টি এবং বর্তমানে ভারতের জিআই পণ্য রয়েছে প্রায় ৪২১টি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো জার্মানি যার জিআই পণ্যর সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৬৬টি; দ্বিতীয় জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো চীন যার জিআই পণ্যর সংখ্যা ৭ হাজার ২৪৭টি; তৃতীয় জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো হাঙ্গেরি যার জিআই পণ্যর সংখ্যা ৬ হাজার ৬৮৩টি; চতুর্থ জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো চেক রিপাবলিক যার জিআই পণ্যর সংখ্যার ৬ হাজার ২৮৫টি এবং পঞ্চম জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো বুলগেরিয়া যার জিআই পণ্যর সংখ্যা ৬ হাজার ৩৮টি। আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারত হতে অনেক পিছিয়ে আছি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে।
বাংলাদেশ যদি জিআই পণ্যের দিকে নজর দেয় তাহলে দেশের সিএমএসএমই কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) খাতও বিকশিত হবে। জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত পণ্য উৎপাদনে কৃষক, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে এবং পণ্যর বিপণন ও বাজারন্যরর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও আন্তরিক হতে হবে কেননা জিআই পণ্য হলো আমাদের শেকড়ের পণ্য, আবেগ ও ঐতিহ্যের পণ্য। এসব পণ্য সংরক্ষণে প্রচার, গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। পরিশেষে বলা যায়, আগামী ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের বিকল্প নেই কেননা ব্র্যান্ডিংয়ের ফলে দেশে পর্যটন বাড়ে, রফতানি বাড়ে, কৃষক, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হন সর্বোপুরি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ দিবে যা স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে মর্মে আমরা আশাবাদী।
জিয়াউর রহমান,পিএমপি: উপসচিব ও কনসালটেন্ট,এটুআই প্রোগ্রাম।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ