বিমানসংস্থার উড়োজাহাজের ন্যূনতম গড় বয়স যাত্রীদের আস্থা বাড়ায়
বিমানসংস্থার উড়োজাহাজের ন্যূনতম গড় বয়স যাত্রীদের আস্থা বাড়ায়
একটি এয়ারলাইন্সের গড় বয়স তার ব্যবসায়িক আয় ব্যয়ের উপর সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করে। ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ও পরিচালন ব্যয় নির্ধারনেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীদের পছন্দ নির্ধারণে এয়ারক্রাফটের গড় বয়স অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট কিংবা নূন্যতম বয়সের এয়ারক্রাফট সবসময়ই রক্ষণাবেক্ষন ব্যয় বাবদ কম খরচ হয়ে থাকে। যাতে এয়ারলাইন্স ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লাভবান হয়। যাত্রীরা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে থাকে অনেকটাই নির্ভার।
বাংলাদেশের বিমানসংস্থাগুলো বিশেষ করে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রার পর থেকেই তাদের ব্যবহৃত উড়োজাহাজগুলোর গড় বয়স অনেক বেশি ছিলো। যার ফলে উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষন খরচ বাবদ বেশি ব্যয় করতে হতো। অনেক বেশি টেকনিক্যাল সমস্যায় পড়তে হতো, ফলে ফ্লাইট সিডিউলে বিপর্যয় ঘটতো। এ অবস্থা শুধু প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রেই ঘটতো তা নয়, জাতীয় বিমান সংস্থার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে।
সর্বশেষ এক দশকে বাংলাদেশের এভিয়েশনে জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভো এয়ার ও সর্বশেষ এয়ার এ্যাস্ট্রা। তেমনি বাংলাদেশের এভিয়েশন মার্কেট থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। গত প্রায় দু’যুগ ধরে আরো কয়েকটি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের আকাশসীমায় জ্বলজ্বল করছিলো সেগুলো হচ্ছে এ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারওয়েজ।
বন্ধ হওয়া সবগুলো এয়ারলাইন্সের ব্যবহৃত এয়ারক্রাফটগুলো ছিলো অনেক পুরাতন ও সঠিক সময়ে রক্ষণাবেক্ষন না করা ছিলো প্রধান দুর্বলতা। রক্ষণাবেক্ষনের জন্য অতিরিক্ত খরচ সময় মতো রক্ষণাবেক্ষন না করার প্রবণতা তৈরী করে। এয়ারক্রাফটের হেভী চেক বিশেষ করে সি চেক, ডি চেক কিংবা রেগুলার রুটিন চেক সময়মতো করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পুরাতন এয়ারক্রাফট ব্যবহারকারী এয়ারলাইন্সগুলোর বিগত দিনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ করতে অনীহা দেখা যায়। ফলে এয়ারক্রাফটগুলো গ্রাউন্ডেড হতে দেখা যায়। বহরে অনেকগুলো এয়ারক্রাফট থাকলেও পরিচালনায় সমসংখ্যক এয়ারক্রাফট থাকেনি। ফলে ফ্লাইট সিডিউল এর বিপর্যয় দেখা যায়।
সারাবিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলোর এয়ারক্রাফট নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা সারা বছর কাজ করে থাকে। নতুন নতুন এয়ারক্রাফট বিমান বহরে যুক্ত হওয়ার খবর থেকে শুরু করে সকল ধরনের কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধানী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
স্টাটিস্টা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বের মধ্যে চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার তুলনায় আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপ অথবা দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকার এয়ারক্রাফটগুলোর গড় বয়স বেশী। সবচেয়ে বেশী গড় বয়সের এয়ারক্রাফট দেখা যায় আফ্রিকা মহাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোতে।
চীনে ব্যবহৃত ২০২০ সালে এয়ারক্রাফটের গড় বয়স ছিলো ৬.৬ বছর, ২০২৫ সালে সম্ভাবনা রয়েছে ৭.৭ বছর আর ২০৩০ সালে ৮.৯ বছর। অন্যদিকে এশিয়ার অন্যতম জনবহুল দেশ ভারতে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ২০২০ সালে গড় বয়স ছিলো ৬.৫বছর, ২০২৫ সালে সম্ভাব্য গড় বয়স ৭.২ বছর আর ২০৩০ সালে সম্ভাব্য গড় বয়স হবে ৮.৪ বছর।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটের ২০২০ সালের গড় বয়স ছিলো ৮.৭ বছর, ২০২৫ সালে হবে ৯.৩ বছর আর ২০৩০ সালে দাড়াবে গড় বয়স ৯.৪ বছর। এছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এয়ারক্রাফটের গড় বয়স ছিলো ৯.৫ বছর ২০২০ সালে, ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এয়ারলাইন্সগুলোর এয়ারক্রাফটের গড় বয়স নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ১০.২ বছর এমনকি ২০৩০ সালে এ অঞ্চলে এয়ারক্রাফটগুলোর গড় বয়স নির্ধারণ করবে ১০.২ বছর।
ল্যাটিন আমেরিকায় ২০২০ সালে এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটগুলোর গড় বয়স ১১.২ বছর ২০২৫ সালে সম্ভাব্য ১১.১ বছর থেকে ২০৩০ সালে গড় বয়স ১০ বছর নির্ধারণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নর্থ আমেরিকায় ২০২০ সালে ছিলো গড় আয়ু ১৪ বছর, ঠিক ২০২৫ সালেও একই গড় বয়স নির্ধারণ করেছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০৩০ সালে এয়ারক্রাফটগুলোর গড় আয়ু নির্ধারণ করেছে ১৩.২ বছর।
ইস্টার্ণ ইউরোপের এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটের গড় বয়স ছিলো ২০২০ সালে ১১ বছর, ২০২৫ সালে দাড়াবে ১১.৮ বছর আর ২০৩০ সালে পৌঁছাবে ১২.৬ বছর। প্রায় একই ভাবে ওয়েস্টার্ণ ইউরোপে ২০২০ সালে ১১.৪ বছর ছিলো গড় বয়স, ২০২৫ সালে হবে ১১.৫ বছর আর ২০৩০ সালে হবে ১১.১ বছর।
সারাবিশ্বের বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে আফ্রিকার এয়ারক্রাফটগুলোর গড় আয়ু সবচেয়ে বেশী। ২০২০ সালে ছিলো ১৪.৩ বছর, ২০২৫ এ হবে ১৪.৬ বছর আর ২০৩০ সালে কিছুটা কমে গিয়ে হবে ১৪.১ বছর।
গড় আয়ু সব সময় এয়ারক্রাফটের নিরাপত্তা সূচক প্রকাশ করে না। বরং সঠিক সময়ে রক্ষণাবেক্ষন করা এয়ারক্রাফটকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করে। আমেরিকার জনপ্রিয় এয়ারলাইন্স ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটগুলোর গড় বয়স ১৪.৩ বছর আর ডেল্টা এয়ারলাইন্স গড় বয়স ১৭ বছর, সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স এর গড় বয়স ১১.৮ বছর, আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর গড় বয়স ১০.৮ বছর।
সারা বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে ২০২২ সালে সবচেয়ে কম গড় আয়ুর এয়ারক্রাফটের মুকুট অর্জন করে আফ্রিকার উগান্ডা এয়ারলাইন্স।
উগান্ডা এয়ারলাইন্স আফ্রিকা তথা সারা বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম গড় আয়ু সম্পন্ন এয়ারক্রাফট নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। উগান্ডার এয়ারলাইন্সের এয়ারিক্রাফটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী এয়ারক্রাফটের বয়স ১.১৩ বছর আর সবচেয়ে বেশী বয়সী এয়ারক্রাফটের বয়স ২.৭৫ বছর।
চিলির স্কাই এয়ারলাইন্স এর এয়ারক্রাফটগুলো দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে কম এবং সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠ গড় আয়ু হচ্ছে প্রায় ৩ বছর। সালাম এয়ার এশিয়ার মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ আর বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় কনিষ্ঠ গড় আয়ুর এয়ার ক্রাফট নিয়ে বিমান বহরকে সাজিয়েছে। যার গড় আয়ু ৫.২৯ বছর।। এছাড়া চতুর্থ আর পঞ্চম স্থানে কনিষ্ঠ গড় আয়ু নিয়ে অবস্থানে করছে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ার ভিভা এয়ার আর সৌদি এরাবিয়ার ফ্লাইএডিল।
বিশ্বের বিখ্যাত সব এয়ারলাইন্স বিশেষ করে এমিরেটস এর গড় বয়স ৮.৯ বছর, কাতার এয়ারওয়েজ ৮.৩ বছর, সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স ৭.৮ বছর, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ১০.১ বছর, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ৬.৪ বছর, থাই এয়ারওয়েজ ৭.৬ বছর, ওমান এয়ার ৭ বছর।
ভারতের বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এর মধ্যে স্পাইস জেট ও ইন্ডিগো এর গড় বয়স ১০.৭ বছর। এছাড়া মালদ্বীপের মালদেভিয়ান এয়ারলাইন্স এর গড় বয়স ২১.৯ বছর, যা দক্ষিণ এশিয়ার এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর গড় বয়স ৮.২ বছর। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এর গড় বয়স ১১ বছর। খুব শীঘ্রই ইউএস-বাংলার বিমান বহরে আরো একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফট যুক্ত হতে চলেছে। ফলে এয়ারলাইন্স এর গড় বয়স দাড়াবে প্রায় ১০.৬ বছর। নতুন যুক্ত হওয়া এয়ারলাইন্স এয়ারএ্যাস্ট্রার এয়ারক্রাফটের গড় ৬ বছর। যা চলমান সব দেশীয় এয়ারলাইন্স এর মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউএস-বাংলা কিংবা এয়ারএ্যাস্ট্রা ব্যতিত বাংলাদেশে চালু কিংবা বন্ধ হওয়া সকল বেসরকারী এয়ারালাইন্স এর গড় বয়স ১৯ বছরের অধিক।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দেশের অভ্যন্তরে ও কলকাতা রুটে ৭টি এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সারা বিশ্বে ব্যবহৃত এটিআর এয়ারক্রাফট ১৭৬টি এয়ারলাইন্স এর মধ্যে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সর্বশেষ র্যাংকিং ১৩তম স্থানে অবস্থান করছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স খুব শীঘ্রই এয়ারক্রাফটগুলোর গড় বয়স ১০ বছরের মধ্যে নিয়ে আসবে যা বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ইতিহাসে সর্ব নিম্ন। যাত্রী নিরাপত্তায় নতুন এয়ারক্রাফটের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের এভিয়েশনে প্রথমবারের মতো অভ্যন্তরীণ রুটে ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। যা যাত্রী সেবায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে সেই প্রত্যাশা করছে সংশ্লিষ্ট সকলে।
মোঃ কামরুল ইসলাম: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ