সোমবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ || ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ০৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সেবাখাতে সুশাসন, প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ অথবা রাজস্ব ফাঁকির মতলব

কবির য়াহমদ

১৩:৫৪, ৩ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৬:১৫, ১০ অক্টোবর ২০২১

১৬৩৯

সেবাখাতে সুশাসন, প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ অথবা রাজস্ব ফাঁকির মতলব

‘দুর্নীতির রেট অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় জমি রেজিস্ট্রি করতে পারেননি’ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ, তার সংসদীয় এলাকার সাব রেজিস্ট্রি অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসে এক ‘জনসচেতনতা সমাবেশে’ প্রতিমন্ত্রী এই ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য করেছেন। শব্দটা এখানে বিস্ফোরক বলছি কারণ অভিযোগকারী একজন প্রতিমন্ত্রী, দুইবারের নির্বাচিত সাংসদ।

অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী জানান, ‘কখনও মিথ্যা তথ্য দেওয়া উচিত নয়। আমরা যেখানে কথা বলছি, একটি অফিস দেখছি এখানে। সেখানে লেখা আছে, আমি এবং আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত। এই তথ্য কি সঠিক? সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আমি গত সপ্তাহে একটি জমি রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে দুর্নীতির রেট অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় সেই জমি রেজিস্ট্রি হয়নি।’ অভিযোগ অভাবনীয় নয়, তবে অভিযোগকারীর অভিযোগের ধরন এবং তার সামাজিক-রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় অবস্থান বিবেচনায় এটা ভয়ঙ্কর।

এরআগে গত জুনে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) বিএম আব্দুর রাফেলের পরিবারকে জমির দলিল রেজিস্ট্রি করতে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল। কুষ্টিয়া সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ডিএজির কাছ থেকে প্রথমে ত্রিশ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। এরপর তিনি তার পরিচয় দিলে তাকে ৫ হাজার টাকা ‘ছাড়’ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ডিএজি নিজে সেই ঘুষ না দিলেও পরবর্তীতে তার ভাই সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসের লোকজনকে দশ হাজার টাকা দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়ে নিয়েছেন। এই ঘটনা ডিএজি প্রকাশ করেছিলেন এবং ওই দুই কর্মচারীর একজনকে পরবর্তীতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

এ ত গেল মন্ত্রিসভার এক সদস্যের পরিবার, ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেলের অভিজ্ঞতা। এরবাইরে যে তথ্যগুলো জনসমক্ষে আসে না তা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। আমার গ্রামের একজন লোক কিছুদিন আগে সিলেটের চারখাই ভূমি অফিসে জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলেন। ওখানে জমির দাগ, খতিয়ান নাম্বার দেওয়ার পর ওই অফিসের কর্মচারীরা তাকে খাজনা পরিমাণ এগারো হাজার টাকা বলে জানিয়েছিল। এরপর তিনি দরদাম করে খাজনার পরিমাণ নির্ধারণ করেন সাত হাজার টাকা। ওই টাকা তাদের হাতে দেওয়ার পর তাকে যে রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হয় সেটা মাত্র ৮৩২ টাকার। অর্থাৎ মাত্র এ ৮৩২ টাকাই জমা পড়েছে সরকারের রাজস্ব হিসাবে, বাকিটা ওই কর্মচারীসহ অফিসের লোকজনের পকেটে। এমন অবস্থা চলমান এবং প্রতিকারহীন। সাধারণ মানুষ ভূমি অফিসে বিবিধ ভোগান্তিতে পড়ে, এবং সরকারকে রাজস্ব প্রদান করলেও সেটা সরকার পর্যন্ত পৌঁছায় না, জমা পড়েছে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভূমি দলিল নিবন্ধন সেবায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে সে সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘ভূমির দলিল ও নিবন্ধন সেবাখাতে ব্যাপক সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। এখাতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সেবাখাত মানেই সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্নীতিপ্রবণ। দলিল নিবন্ধন আর দুর্নীতি যেন অনেকটা সমার্থক হয়ে গেছে। এই খাতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের চিত্র বিরাজ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত আছে যে, একজন সাব-রেজিস্ট্রারকে বদলি করতে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়েছে।’ তবে কিছু কিছু জায়গায় যে ব্যতিক্রম রয়েছে এও স্বীকার করা হয়েছে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে। সংখ্যায় এটা যে খুব তাও উল্লেখ হয়েছে।

টিআইবির ওই প্রতিবেদনের পর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন পুরোপুরি সত্য নয়, তবে তাদের রিপোর্ট একেবারে উড়িয়েও দিচ্ছি না। ভূমি রেজিস্ট্রেশন বিভাগে কিছু দুর্নীতি হয়, তবে এ অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’ তিনি জানান, ‘রেজিস্ট্রেশন বিভাগের অংশটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এখানে একটা ভুল ধারণা রয়েছে। এটা কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে না, এটা হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। রেজিস্ট্রেশন বিভাগ যেহেতু আমার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, তাই আমি এখানে হাত দিতে পারছি না।’ মন্ত্রী স্বীকার করে নিয়েছেন দুর্নীতি হয়, আবার এখানে যে মন্ত্রণালয় বিষয়ক যে দূরত্ব রয়েছে সেটাও তিনি বলেছেন। ভূমি রেজিস্ট্রি বিষয়ক কাজগুলোর কোনটা কোন মন্ত্রণালয়ের এটা জনগণের দেখার বিষয় নয়, দেখার বিষয় সঠিক ও ভোগান্তি ছাড়াই কাজ করা যাচ্ছে কি না।

নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের জমি রেজিস্ট্রিতে ভোগান্তি বিষয়ক অভিযোগ। প্রতিমন্ত্রী যা বলেছেন সেটার সঙ্গে বাস্তবতার অমিল হয়ত নেই, তবে জাতীয় দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’ দিচ্ছে ভিন্ন তথ্য। এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ‘...মন্ত্রীর সেই বক্তব্য ধরে খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল নানা তথ্য, তাতে বেশ গরমিলও আছে। যেমন বিক্রেতার দাবি, দুই একর আয়তনের জমিটি তিনি ৫৯ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। কিন্তু ক্রেতা মন্ত্রীর ছেলের দাবি, তিনি জমি কিনেছেন ১৯ লাখ টাকায়। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ওই জমির বাজারমূল্য ৫৯ লাখ টাকার চেয়ে বেশি। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিবন্ধনের সময় দেশের শতকরা ৭৮ ভাগ দলিলে জমির দাম কমিয়ে দেখানো হয় বলে তথ্য উঠে এসেছিল কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে। কথা হচ্ছে যে জমিটি নিয়ে, সে ক্ষেত্রেও এমন অনিয়ম হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’ [১ অক্টোবর ২০২১]

স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বাজার রোহিতা বাজার। বাজার ঘেঁষে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা। সেই রাস্তা লাগোয়া প্রতি শতাংশ জমির দাম বর্তমানে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। সে হিসাবে ওই এলাকায় দুই একর (২০০ শতাংশ) জমির দাম কয়েক কোটি টাকা। এমন মূল্যবান জমি কীভাবে ১৯ লাখ টাকায় বিক্রি হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আলোচিত এই জমির বিক্রেতা মিজানুর রহমান রোহিতা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তার কাছ থেকে জমি কিনেছেন সুপ্রিয় ভট্টাচার্য, যিনি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের ছেলে। বৃহস্পতিবার মনিরামপুরের সাবরেজিস্ট্রার শাহজাহান আলী জানান, গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাসুদেবপুর মৌজার (৭৬, ৭৭, ৭৮ ও ৮৯ দাগে) ওই জমি সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের নামে দলিল করা হয়েছে। দাতার নাম মিজানুর রহমান। দলিলে জমির দাম উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ লাখ টাকা’। ‘...বিক্রেতা মিজানুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানান, ৫৯ লাখ টাকার বিনিময়ে জমিটি তিনি বিক্রি করেছেন। চাইলে তিনি জমিটি আরও ১০-২০ লাখ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে পারতেন। সরকারি প্রকল্প হলে এলাকার মানুষের উপকার হবে এমন ভাবনা থেকে অল্প দামেই বিক্রি করেছেন। টাকার লেনদেন হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকে। দলিলে দাম কত দেখানো হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে দাবি মিজানের। এদিকে মিজানের ভাগনে আলী হায়দার মুকুল বলছেন, জমিটি তার মামা ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ জমির অন্য দাম যা তৃতীয় কোন ব্যক্তি থেকে এসেছে বলে তা ধর্তব্যের মধ্যে না নিলেও বিক্রেতার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে জমি বিক্রি হয়েছে ৫৯ লাখ টাকায়, আর দলিল করা হয়েছে ১৯ লাখ টাকার। এখানে প্রকৃত দাম ও দলিলে উল্লেখ যে দাম সেখানে বিস্তর পার্থক্য, এবং এটা ৪০ লাখ টাকার। এই টাকার উল্লেখ করা হয়নি মূলত সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে। প্রতিমন্ত্রীর ছেলে সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের দাবি ‘সরকার নির্ধারিত দামেই তিনি জমি কিনেছেন এবং দলিল করেছেন’। জমির দাম নিয়ে এই আলোচনাকে তিনি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত জমির যে দাম সেটা সর্বনিম্ন দাম। জমির বেচাকেনা সাধারণত এমন সর্বনিম্ন দামে হয় না। জমির নিবন্ধনে দরদামজনিত লুকোচুরি ঠেকাতে সর্বনিম্ন দামের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে করে এলাকাভেদে অন্তত সর্বনিম্ন রাজস্বটা পায় সরকার। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির বেচাকেনা সরকার নির্ধারিত এলাকাভিত্তিক সর্বনিম্ন দামের চেয়ে বেশি দামে হয়ে থাকে। প্রতিমন্ত্রীর পুত্রের কেনা জমিও এর ব্যতিক্রম নয়, যা বিক্রেতার ভাষ্য থেকেই পরিস্কার।

প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দুর্নীতির যে অভিযোগ তুলেছেন এটাকে হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই। সরকারের প্রতিমন্ত্রী তাদের সরকারের সময়ে একটা অফিসের দুর্নীতির অভিযোগ তুলবেন আর এ নিয়ে তদন্ত হবে না তা ঠিক নয়। এটার তদন্ত করা উচিত। একই সঙ্গে খতিয়ে দেখাও উচিত প্রকৃত দাম আর দলিলে উল্লেখ দামের সঙ্গে কোন গরমিল আছে কি না। কারণ এখানে সরকারের রাজস্বের ব্যাপার জড়িত। প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য বলে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অধিকার তিনি রাখেন না। এছাড়া প্রতিমন্ত্রী নিজেই যেখানে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দুর্নীতি অভিযোগ তুলেছেন তখন এটা সাধারণ কোন অভিযোগ আর থাকছে না।

জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার সংস্কৃতি তৈরি করতে প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ এবং প্রকৃত অবস্থার একটা স্বচ্ছ তদন্তের দাবি করি আমরা। একই সঙ্গে দাবি করি সেবাখাতে সুশাসন নিশ্চিতের।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank