মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১ || ১২ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নেতৃত্ব নাকি মেধা, কোনটির বেশি প্রয়োজন?

রাকিবুর রহমান তামিম

০৮:১১, ২২ জুন ২০২১

২৩৭২

নেতৃত্ব নাকি মেধা, কোনটির বেশি প্রয়োজন?

হেলেদুলে স্বর্গ বাড়ির হুলো বিড়াল ‘মার্জার’ বাড়ির সামনের সিড়ির উপর গা এলিয়ে বসলো। পাশের বাড়ির বাঁশ ঝাড়ের ঝোপে ছোট্ট এক টুনটুনির বাচ্চা আটকে ছিল। কই থেকে এসে টুনটুনির বাচ্চাটা আটকে পড়েছিল মার্জারের সে সম্পর্কে কোনো ধারনা নাই, জানার ইচ্ছাও নাই। উদরপূর্তি করতে পেরেই সে খুশি। আগে মার্জার যখন ছোট ছিল স্বর্গ বাড়ির বড় মেয়ে আর ছোটো ছেলেটি নিয়ম করে তাকে মাছ,দুধ দিয়ে ভাত খেতে দিত। বাড়ির কর্তা আর কর্ত্রীও সে সময় আদর করতো। বয়স হয়ে যাওয়ার পর এখন আদর তো দূর দিনে দুবেলাও খাবার জোটে না কপালে। মার্জার দেখেছে বাড়ির ছেলে মেয়ে গুলি যখন খেতে বসে তখন তাদের সামনে গিয়ে মিউমিউ করলেও খেতে দেয়না। তবুও মার্জার তাদের খাওয়া শেষ না হওয়া অবধি বসে থাকে হয়তো তাদের খাওয়ার শেষে মার্জার খেতে পাবে এই আশায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই আশার গুড়েবালি। মার্জার তাই নিয়ম করে এখন স্বর্গ বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে। আজ তেমনি খুজতে খুজতেই টুনটুনির বাচ্চাটা পেয়ে যায়।

সিড়ির উপর দুপুরের কড়া রোদ এসে পড়ায় মার্জার উঠে বাড়ির ভেতর সোফার রুমের মেঝেতে গা এলিয়ে বসে। বাড়ির কর্ত্রী টিভিতে খবর দেখছে। দেশের নেতাদের দুর্নীতির খবর দেখাচ্ছে। নেতাদের দুর্নীতির খবর দেখলেই বাড়ির কর্ত্রী মনের সুখ মিটিয়ে গালাগাল করে নেয়। এই যেমন এখন “ধুরো ধুরো হারামজাদা এতো মানুষ মরে তোরা মরতে পারসনা?” বলে বিরক্তি প্রকাশ করল। বাড়ির কর্ত্রীর বিরক্তিতে যেনে তাদের কিছু যায় আসেনা সে কি বাড়ির কর্ত্রী জানেনা? মার্জার ভেবে পায়না।

মার্জার ভাবতে থাকে একটা দেশের উন্নতির স্বার্থে নেতৃত্বের বেশি প্রয়োজন নাকি মেধার বেশি প্রয়োজন? সেই দেশের তরুণ সমাজ নেতৃত্বের গুনাবলি বেশি শিখবে নাকি জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে মেধাবী হওয়ার জন্যে বেশি চেষ্টা করবে?একটি দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে নিশ্চয়ই সে দেশের সকলকে নেতা হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং নেতা বেশি হয়ে গেলেই সমস্যা। সবাই চাইবে নেতৃত্ব দিতে, কাজের কাজ কাউকে দিয়ে হবেনা। কিন্তু মেধাবীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে নিশ্চয়ই সমস্যা নেই। বরং যতো বেশি মেধাবী বানাতে পারবে একটি দেশ, সেই দেশের উন্নতির চাকা ততো জোরে আবর্তিত হবে। কিন্তু কোনো দেশের অবস্থা যদি এমন হয় যে সেই দেশে নেতারাই সব, তাঁরাই হর্তা-কর্তা জনগণের ভাগ্য বিধাতা, মেধাবীরা দু-পয়সার দাম পায়না, তরুণ সমাজ মেধাবী হওয়ার বদলে নেতা হয়ে বেড়ে উঠতে চায়, সেই দেশের ভবিষ্যত কি? নেতার কাজ তো নেতৃত্ব দেওয়া, সে হবে একজন সংগঠক। বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন তিনি, নিজেতো আর কাজ করবেন না। কাজ করবেন এক্সপার্টরা, মেধাবীরা। কিন্তু যখন পর্যাপ্ত মেধাবী তৈরি না হবে তখন উন্নতির চাকা থেমে যাবেনা? মেধার বাজার দর আছে, মেধা কেনার জন্যে কত জায়গায় কতরকম ভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে অফার দেওয়া হয়, কিন্তু কেউ কি কখনো দেখেছে নেতা খুঁজছি বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে? সেরকম হলেতো পশ্চিমে-পুর্বে এদেশের এতো এতো নেতাকে রপ্তানি করে রাষ্ট্র কবেই ধনী হয়ে যেতো। মার্জারকেও আর কষ্ট করে খাবারের জন্য এদিক ওদিক দৌড়াতে হতোনা, বাড়ির লোকে খেতে বসলে তাদের সামনে গিয়ে মিউমিউ করতে হতো না, তারও জীবন যাত্রার মান উন্নত হত।

মার্জার বিশ্বাস করে নেতা ও মেধা উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে তবে যারা নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকবে তাদের তো মেধার সম্মান করতে জানতে হবে। নেতা কি সব নিজের খেয়াল খুশি মতো করবেন? অবশ্যই না! দেশের মেধাবীদের থেকে নেতা পরামর্শ চাইবেন, তাদের পরামর্শ মোতাবেক সবচাইতে উৎকৃষ্ট পন্থায় যে কোনো কার্য সম্পাদন করবেন। এইখানে আবার প্রশ্ন আসতে পারে দেশের মেধাবী কারা? দেশের মেধাবীদের সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। স্বাভাবিকভাবে যেকোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যাদের বিবেচনা করা হয় তাদেরই কি দেশের মেধাবী হিসেবে বিবেচনা করা যায়না? মার্জার মনে করে অবশ্যই করা যায়। মেধাবীদের যদি আবার দল, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে বিভক্ত করে ফেলা হয় তাহলে মেধাবীদের চিহ্নিত করার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। মেধাবীদের কোনো দল, বর্ণ, গোত্র থাকা উচিত বলে মার্জার মনে করেনা। মেধাবীদের পরিচয় হবে শুধুই তাদের মেধা দিয়ে, অন্য কিছু নয়। এতো গেলো মেধাবীদের চিহ্নিত করা নিয়ে, কিন্তু সেই মেধাবীদের চিহ্নিত করবে যে নেতারা তাদের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে? কথায় আছেনা “মানিকে মানিক চেনে?” এর মানে কি দাঁড়ালো? একজন মেধাবীই কেবল ও কেবলমাত্র আরেকজন মেধাবীকে চিহ্নিত করা ও যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতে পারে। এ কথা সকলেই জানে বলে মার্জার মনে করে কিন্তু হায় কেউই মানে না।

একজন নেতাকে অবশ্যই মেধাবী হতে হবে, তবেই তাঁর দ্বারা যেকোনো প্রয়োজনে অন্য মেধাবী বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে তাদের পরামর্শ মোতাবেক সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালানো সম্ভব। কেবলমাত্র অকালকুষ্মান্ডরাই মনে করে তারা নিজেরাই পারবে সব সম্ভব করে ফেলতে। আর অকালকুষ্মান্ড নেতাদের হাতে যখন নেতৃত্ব থাকে তখন দুর্ভোগের অন্ত থাকেনা। গেল বছর স্বর্গবাড়ির ছোটো ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে। মার্জার সময়ে সময়ে ছোটো ছেলেটিকে বলতে শুনেছে ‘একজন ইঞ্জিনিয়ারই জানে আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার কি জানে!’ কথাটি মার্জারের খুব মনে ধরেছে। এ কথার দ্বারা বোঝা যায় একজন মানুষের জ্ঞান যথেষ্ট নয়, সমষ্টিগতভাবে সকলের জ্ঞান একত্রিত করলে তবেই সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল সম্ভব। একজন মেধাবীর ভুল করার অধিকার আছে। মেধাবীরা ভুল থেকে শিখতে শিখতেই মেধাবী হয়ে ওঠে কিন্তু একজন নেতার ভুল করার কোনো অধিকার নাই। একজন মেধাবী ভুল করলে তা শুধুমাত্র ওই ব্যক্তি বিশেষরই ভোগান্তির কারণ হতে পারে কিন্তু একজন নেতা ভুল করলে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে তার ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়। অতএব নেতার ভুল করলে চলবেনা।

তার মানে কি একজন নেতাকে মেধাবীদেরও মেধাবী হতে হবে? তার আসলে কোনো দরকার নাই। একজন নেতাকে কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হওয়ারও আসলে প্রয়োজন নাই। কোনো কাজ করার আগে বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উক্ত বিষয়ের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার মতো বোধটুকু তার থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ তার মতের বিরুদ্ধে গেলেও গোয়ার্তুমি না করে তা মেনে নেয়ার সৌজন্যতা বোধ থাকতে হবে। মার্জার ইদানিং খেয়াল করেছে স্বর্গবাড়ির পূর্বধারের মনু মিয়ার বড় ছেলেটি নতুন বাইক নিয়ে চলাচল করে। এলাকার অন্যান্য বিড়ালের থেকে খবর পেয়েছে সে নাকি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। দু মাস আগেও মনুমিয়া স্বর্গবাড়ির কর্তার নিকট কাজের জন্যে এসেছিল, তার বড় ছেলেটি নাকি কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বাপ পয়সা দিতে পারেনা বলে। সেই ছেলে এখন বাইক নিয়ে ঘোরে সরকারি দলের রাজনীতি করার ফলে। কদিন আগে নাকি পশ্চিম পাড়ার বড় বিড়ালটিকে বাইক চাপাও দিতে নিয়েছিল। কোনো রকমে বেঁচে গিয়ে বড় বিড়ালটি “জাত হারামজাদা” বলে গালি দিয়ে দৌড় দিয়েছিল। মার্জার ভাবে এই ছেলেটি যদি নেতা হয়ে যায় সে কি বুঝবে দেশের মেধাবীদের মূল্য? তার থেকে মেধাবী সমাজ কি যথাযথ সম্মান আশা করতে পারে? নাকি বড় বিড়ালটিকে চাপা দেওয়ার মতো করে সে তার বিরুদ্ধের সকল কিছুকে ওই ভাবে চাপা দেওয়াপূর্বক নিজেকে আরও যোগ্য নেতা করে তুলবে? বড় বিড়ালটিতো মুখের উপর গালাগাল করে এসেছিল। কিন্তু মানুষ সমাজ অমন সুযোগ্য নেতার মরণ চাইবে স্বর্গবাড়ির কর্ত্রীর মতো সোফার রুমে গা এলিয়ে বসে। দু-একটা গালাগাল দিয়ে সতর্ক চাহনিতে দরজা-জানালার দিকে তাকাবে। আইনের হাতের থেকেও র্যা্ব-পুলিশের কান আজকাল নাকি অনেক বেশি লম্বা। 

রান্নাঘর থেকে প্লেট-বাটির শব্দে মার্জারের ভাবনায় ছেদ পড়লে সে কানখাড়া করে তুলল। বড় মেয়েটি খেতে বসছে। মার্জার আড়মোড়া ভেঙে মিউমিউ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলল। যদি অনুগ্রহপূর্বক কপালে কিছু আহার জোটে!

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank