শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

জয়তু শহীদ জননী

সঙ্গীতা ইমাম

১১:২৬, ৩ মে ২০২১

১১৬৮

জয়তু শহীদ জননী

জাহানারা ইমাম জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯২৯ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ৩ মে। স্কুলের পাঠ শেষে কারমাইকেল কলেজে এইচএসসি পড়ার পরে কোলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রেবোন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। শিক্ষকতার ডিগ্রী নেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে নানা স্তরে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। বেতারে কথিকা পাঠসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। জাহানারা ইমাম একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও অসামান্য নারী ছিলেন। যেমন সুন্দর তিনি দেখতে ছিলেন, তেমনি তাঁর সাজে ও সজ্জায় ছিল পরিমিতি বোধ। একজন ঋজু নারীর উদাহরণ হিসেবে তাই তাঁর ছবিটিই চোখে ভেসে উঠে। সে যুগে যে কজন নারী নিজেই গাড়ি চালাতেন, তাঁদের মধ্যে জাহানারা ইমাম অন্যতম। সংসারটিও ছিল পরিপাটি। বাগান করতে ভালোবাসতেন। 

এমন সুন্দর সাজানো জীবনে ঝড় এলো একদিন। সে ঝড় অবশ্য এসেছিল বাংলার মানুষের জীবনে, পুরো দেশ জুড়েই। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাহানারা ইমামের বড়ো ছেলে শাফী ইমাম রুমী তখন তরুণ। দৃঢ় কণ্ঠে সন্তান মাকে জানায়, সে যুদ্ধে যেতে চায়। ছেলের বাক্যটির চেয়ে কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা মাকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়। রুমী ও তাঁর বন্ধুদের সেই দেশপ্রেমের টগবগে তারুণ্য, উজ্জ্বল চোখ ও দৃঢ়তা জাহানারা ইমামকে কেমন এক শক্তি যোগায়। সেদিন থেকে তিনি ওদের সবার মা হয়ে যান। ছেলেদের সাথে যুদ্ধের প্ল্যানিংয়েও অংশ নেন।

দোসরা মে রুমি সীমান্ত পার হবার চেষ্টা করে ফিরে আসেন। একাত্তরের তেসরা মে মায়ের জন্মদিনে রুমি বাড়ি এলো, মায়ের প্রিয় বনি প্রিন্স দিয়ে আদর করে জড়িয়ে ধরলো মাকে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কোনো কোনদিন ছেলেরা আসে নতুন নতুন অপারেশনের প্ল্যান নিয়ে। তিনি রান্না করেন ওঁদের প্রিয় খাবার। 
সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার প্ল্যান্ট ওড়ানো আর ধানমন্ডিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু নেয়া পাকিস্তানের আর্মি জিপ লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনার বর্ণনা আমরা জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলিতে পাই। আরও পাই আগস্টের ২৯ তারিখের ঘটনা।

সেদিন বাড়িতে এসেছিল রুমি। উৎসবের আনন্দ বাড়িতে। কিন্তু রাতটা যে এমন ভয়াল হবে ভাবতে পারেননি কেউ। রাতে দরজায় আঘাত। ঘরে ঢুকে গেল পাকিস্তানি আর্মি আর ঘর থেকেই ধরে নিয়ে গেলো রুমী, তাঁর ছোটো ভাই জামী আর তাঁদের বাবা শরীফ ইমামকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ছোটো ছেলে জামী ও তাঁদের বাবা শরীফ ইমাম সাহেব ফিরে এলেও রুমী আর কোনো দিনই ফিরে আসেননি। রুমী চলে যাবার পর রুমীর বন্ধুরা তাঁকে মা বলেই সম্বোধন করতেন। আর জাতির জন্য তিনি হলেন- শহিদ জননী।

দুই
স্বাধীন দেশে আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগলো জীবন। জীবনের কাজগুলো চলতে থাকলেও কোথায় যেন বেসুরো বাজে, তাল কেটে যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে বেড়ে উঠল যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন। বঙ্গবন্ধুর সরকার রাজাকার গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। কিন্তু ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে রাজাকার গোলাম আযম। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কোনো প্রকার বৈধ ভিসা ছাড়াই সে বাংলাদেশে বাস করে।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামী তাদের আমির হিসেবে ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে। জনবিক্ষোভের সূচনা হয় বাংলাদেশে। এই বিক্ষোভের অংশ হিসেবেই ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সকলের অনুরোধে কমিটির আহ্বায়ক হতে রাজি হন শহিদ জননী জাহানারা ইমাম। ১১ ফেব্রুয়ারি ৭০ টি সামাজিক, সাংস্ককৃতিক, রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। জাহানারা ইমামকে এই কমিটিরও চেয়ারম্যান করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বহু প্রতিবন্ধকতা আর প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। সেখানে ২২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতে নরঘাতক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম। এই গণ-আদালতে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

১৯৮২ সাল থেকেই শহীদ জননী ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। ক্যান্সারের জীবানু তাঁর মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সবকিছুতেই ছিল নানা বিধি-নিষেধ। তারপরেও এই কর্কটরোগ নিয়েই তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং করেছেন। হেঁটেছেন মিছিলে।

আমি তখন ঢাকায় অনুষ্ঠিত তাঁর প্রায় সব জনসভায় যেতাম। শুনতাম তাঁর কথা। মাঝে মাঝে এলিফেন্ট রোডের দোতলা বাসাটাতেও যেতাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে  সোফায় দেখা যেতো আব্বু আর কাকুরা বসে থাকতেন, মিটিং করতেন। জাহানারা ফুপু এসে কথা বলতেন। বেশিক্ষণ বসতে না পারলে বেডরুমে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে আসতেন মিটিংয়ে। আমি যে দিন গেছি,  ঘরে যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন নানা কথা হতো তাঁর সঙ্গে। তার বেশিরভাগই ছিল বাচ্চাদের কথা আর শিক্ষকতার কথা। আমাদের বাড়িতে মিটিং হলে আম্মু ফুপুর জন্য পিসপাস (মুরগী আর সবজি ঘুটে দেয়া পোলাওর চালের নরম খিচুড়ি) রান্না করে দিতেন। সেটা খুব সময় নিয়ে তিনি খেতেন। তবু কখনো হতাশ হতে দেখিনি তাঁকে। শরীরে কর্কট রোগের সাথে যুদ্ধ আর বাইরে যুদ্ধাপরাধীদের নির্মূলের যুদ্ধ সমানে চালিয়ে গেছেন শহিদ জননী। সারাদেশে চলতে থাকে সভা, পদযাত্রা, মানববন্ধন, ঢাকায় সংসদ অভিমুখে যাত্রা হয়। সংসদে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় কার্যকর করার আবেদন জানানো হয়। পদযাত্রায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে আহত করে জাহানারা ইমামসহ অনেককে। 

তিন
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ গণ-আদালতের প্রথম বার্ষিকীতে আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ গণ-আদালতের দ্বিতীয় বার্ষিতীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তায় বিশাল সমাবেশে কবি সুফিয়া কামাল জাহানারা ইমামের হাতে গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট তুলে দেন। সেদিন আমরা টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশে এসেছিলাম। মনে আছে, সেদিন পথে আমার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাই খালি পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দিয়েছিলাম। এই সমাবেশে দূর থেকে জাহানারা ফুপু, সুফিয়া কামাল নানি, আব্বু আর সবাইকে স্টেজে দেখে কেমন স্বর্গীয় দৃশ্য মনে হচ্ছিল। সবার বক্তৃতার পরে রিপোর্ট তুলে দেয়ার সময় কেন যেন খুব কান্নাও পেয়েছিল। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল জল।

এ সমাবেশের পর পরই জাহানারা ইমাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমেরিকায় সন্তানের কাছে যান চিকিৎসার জন্য। সেখানে মিশিগানের ডেট্রয়েটের সাইনাই হাসপাতালে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেন। বাঙালির দুর্ভাগ্য শহিদ জননী অনন্তলোকে যাত্রা করেছিলেন দেশদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে।

তবে শহিদ জননীরা কখনোই হারিয়ে যান না। তাঁদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বহন করে তাঁদের প্রজন্ম। ২০১৩ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আমরা দাঁড়াই শাহবাগে। শহিদ জননীর বিশাল প্রতিকৃতি আর বিশাল একটি লাল-সবুজ পতাকা শাহবাগে জ্বলজ্বল করে আমাদের যোগায় প্রেরণা আর সাহস। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা থেকে শুরু করে একে একে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রায় এবং রায় কার্যকর করা হয়। সেই বিচার কার্যক্রম এখনও চলছে।

জাহানারা ইমাম বাঙালির সেই বাতিঘর যাঁকে দেখে আমরা পাড়ি দেবো সকল দুঃসময়। আজ তাঁর এই বিরানব্বইতম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে আনত শ্রদ্ধা জানাই। তাঁকে স্মরণ করে তাঁরই শরণ নেই আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহসে বুক বাঁধি।

সঙ্গীতা ইমাম: লেখক, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank