শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সামান্য স্বাস্থ্যবিধিতে ‘অসামান্য ফল’

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

১২:২৫, ৫ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ১৩:১৮, ৫ এপ্রিল ২০২১

৮৯৫

সামান্য স্বাস্থ্যবিধিতে ‘অসামান্য ফল’

আজ থেকে দ্বিতীয় দফা ‘লকডাউনে’ গেছে দেশ। এবার এক সপ্তাহের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। প্রথমবার কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় লকডাউন শব্দের যোগ না রেখে ছিল ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা। এরপর সরকারের সেই সাধারণ ছুটির সময়ে স্থানীয় প্রশাসন এলাকাভিত্তিক লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছিল। সরকারের সাধারণ ছুটির সেই ঘোষণার স্থায়িত্ব ছিল টানা ৬৬ দিন। এবার করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় সরকারি প্রজ্ঞাপনে লকডাউন শব্দের যোগ না থাকলেও জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে লকডাউন শব্দের ব্যবহার করেছেন। তবে প্রাথমিকভাবে এর মেয়াদ মাত্র সাতদিন; অর্থাৎ ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই লকডাউনের স্থায়িত্ব যে বাড়বে সেটা বলাই বাহুল্য।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর শনাক্তের সংবাদের পর ওই মাসের ২৩ তারিখে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ওই সাধারণ ছুটির সময় দেশের সকল অফিস আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। যানবাহন চলাচলে ছিল নিষেধাজ্ঞাও। এরপর সরকারের বিবেচনায় পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদে আস্তে আস্তে বাকি সব খুলতে শুরু করে। এক বছরের বেশি সময় ধরে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে পড়েছিল সেগুলো এখনও বন্ধ রয়েছে। আগামী মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিচ্ছে সে হিসেবে এটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে যে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এখানে গণপরিবহন পুরোপুরিভাবে বন্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। তবে কলকারখানা, অফিস আদালত খোলার রাখার যে কথা বলা আছে তাতে করে মানুষ কীভাবে তার কর্মস্থলে যাবে এনিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। এখানে সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনার কথা বললেও এটা বাস্তব ক্ষেত্রে কি সম্ভব? সারাদেশের কয়টা প্রতিষ্ঠানের পরিবহন ব্যবস্থাপনা রয়েছে এনিয়ে সরকারের কাছে কী তথ্য আছে কে জানে! এমন অবস্থায় মানুষ কীভাবে কর্মস্থলে যাবে? পায়ে হেঁটে?

করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছে সেগুলো যৌক্তিক বলে ধরে নিলেও গণপরিবহন বন্ধের যে সিদ্ধান্ত এটা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। গণপরিবহন ব্যবহার মানুষ শখে করে না, করে প্রয়োজনে। মানুষের কর্মস্থলে আসাযাওয়া ক্ষেত্রে এই গণপরিবহন মুখ্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু সীমিত পরিসরে হলেও কর্মস্থল চালু রেখে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে যুক্তি থাকতে পারে কি? এটা আদতে পরস্পরবিরোধী এক নির্দেশনা। এখানে সরকার প্রতি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কর্মীদের অফিসে আনা-নেওয়ার কথা বলছে, শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার শর্তে শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজ চালু রাখার কথা বলছে অথচ বাস্তবতা বিবেচনায় সকল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মীদের জন্যে পরিবহন ব্যবস্থা রাখা বেশ ব্যয়সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এখানে সরকার কি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনোধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা করবে? করার কথা না যদিও তবু প্রশ্নটা রাখছি মূলত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে। এক্ষেত্রে দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রেখে আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থাধীনে স্থানীয় পর্যায়ের পরিবহন চালু রাখার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেত।

লকডাউন কার্যকর করতে এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে সরকার সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসনকে ভূমিকা পালনের নির্দেশনা দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা প্রশাসনের কিছু উদ্যোগ হয়ত দেখতে পারব, তবে এই উদ্যোগ কতখানি কার্যকর হয় সেটা মূলত নির্ভর করবে ব্যাপক ও সার্বক্ষণিক তদারকির মাধ্যমে। দেশের মানুষ এমনিতেই করোনাকে পাত্তা দিচ্ছে না। এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর লকডাউন কতখানি কার্যকর করা সম্ভব এটাও বলা যাচ্ছে না। গতবারের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছে প্রশাসন কঠোর না হলে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানে না। প্রশাসনের লোকজন যখন লাঠি হাতে নিয়েছে তখনই আস্তে আস্তে মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা বেড়েছে। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে বাকি সবগুলো খুলে দেওয়া হলে আগের চাইতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে মানুষ। মাস্ক পরিধানের বিষয়টি প্রায় ভুলতে বসেছিল মানুষ, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত থেকেছে সবজায়গায়।

করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহারের করার বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত হলেও মাঝে করোনার প্রকোপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মাস্কের বিষয়টি অবজ্ঞা করে গেছে। ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ স্লোগানের প্রচার হলেও এটা স্লোগান হিসেবেই থেকে গেছে। দপ্তরে-দপ্তরে এই স্লোগান সম্বলিত ফেস্টুন-স্টিকার সাঁটানো হয়েছে কিন্তু তার কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। যে সকল দপ্তরে এই স্টিকার ঝুলছিল সেখানকার দায়িত্বশীলদেরও মাস্কবিহীন থাকতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনের লোকজন, জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশকেই মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায়নি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি। মাঝেমাঝে কিছু জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও সেগুলো প্রতীকী অর্থেই পরিচালিত হয়েছে। বলা যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ উপযোগী হয়ে যাওয়ার পর পরই দিনকার সেইসব অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। এসব অভিযান মানুষের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। একটা বিশাল সংখ্যক অসচেতন মানুষের মধ্যে এই প্রতীকী প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কারণে সুফল পাওয়া যায়নি। ফলে করোনার বহুল সংক্রমণ ফিরে এসেছে, এবং সেটা আগের চাইতে আরও বড় আকারে।

এবার করোনার সংক্রমণ যে হারে বেড়েছে-বাড়ছে সেটা আগে কখনই লক্ষ্য করা যায়নি। রোববার পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯ হাজার ২৬৬ জন; আক্রান্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৪ জন; এবং সুস্থ হয়ে ওঠেছেন ৫ লাখ ৫২ হাজার ৪৮২ জন। সরকারি এই হিসাবের বাইরে সংক্রমণ-মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে নমুনা পরীক্ষায় এখনও আমরা অর্ধকোটির ঘরও ছাড়িয়ে যেতে পারিনি। রোববার পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৫টি। এরবাইরে লক্ষণ থাকলেও অনেকেই করোনা পরীক্ষা করেনি, সংখ্যায় এটা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে নিশ্চিতভাবেই। এভাবে কত লোক যে বিনা পরীক্ষায় থেকে গেছে কিংবা পরীক্ষার আগেই মারা গেছে সে হিসাবও আসছে না সরকারিভাবে। ফলে ধারণা করা যায় কাগজেকলমে যে হিসাব সে হিসাবের কয়েকগুণ বেশি লোক সংক্রমিত হয়েছে, মারাও গেছে এবং একইভাবে করোনা জয় করে ফিরেও এসেছে।

এই যে ফের কঠোর নিষেধাজ্ঞার নামে লকডাউনে গেল দেশ তার কারণ হুট করে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া। সরকারি তরফে বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরার নির্দেশনা দেওয়া হলেও মানুষ এটা পাত্তা দেয়নি। ‘করোনায় কিছুই হবে না, করোনা আমাদের ধরবে না’ এমন অদ্ভুত চিন্তাসক্ত মানুষ পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে ফেলেছে। করোনা প্রতিরোধী টিকা দেশের আসার পর থেকে আরও বেশি বেপরোয়া মানুষ। অনেকেই টিকা গ্রহণে অনাগ্রহ দেখালেও এই টিকা আসার পর দেশ থেকে করোনা নির্মূল হয়ে গেছে এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে নিমজ্জিত ছিল, এখনও আছে অনেকেই। অথচ করোনার টিকা নিলে করোনার সংক্রমণ হবে না এমনটা কোনো দায়িত্বশীল মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। বরং টিকা গ্রহণের পরও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনার সংক্রমণ হতে পারে বলেও জানানো হয়েছিল। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল গণমাধ্যমে, যেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘করোনার টিকা নিয়েও আক্রান্ত’ এবং ‘করোনার টিকা নিয়েও মৃত্যু’ বিষয়ক সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। এসব শিরোনাম করোনার টিকার কার্যকারিতার বিষয়টিকে অযৌক্তিকভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের যেখানে দায়িত্বশীল হওয়ার কথা ছিল সে রকম দায়িত্বশীলতা আমরা দেখাতে পারিনি।

যাই হোক, করোনার বিস্তার ঠেকাতে এবার সরকার নানা বিধিনিষেধ দিয়েছে। এক সপ্তাহ চলবে এই নিষেধাজ্ঞা। এই সপ্তাহ পর কী প্রভাব পড়ে সেটাই দেখার বিষয়। এই এক সপ্তাহসহ পুরোটা সময় আমাদের মাস্ক পরিধান করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া বিকল্প নাই। এই স্বাস্থ্যবিধি আমাদের স্বার্থে, জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করেই। সামান্য একটা মাস্ক, সামান্য কিছু সামাজিক দূরত্ব পালন, সামান্য কিছু স্বাস্থ্যবিধি আমাদের জীবনে অসামান্য অবদান রাখতে পারে। আসুন বড় কিছু জন্যে আমরা ‘ছোট কিছু’ মেনে চলি।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank