বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির মুক্তির ডাক
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির মুক্তির ডাক
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লাখো মানুষের পদচারণায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল শ্লোগানের শহর ঢাকা। রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে অপেক্ষা করছেন দশ লাখের বেশি স্বাধীনতাকামী মানুষ। শুধু একটা ঘোষণা বা ডাকের অপেক্ষায়, আগের দিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি উত্তেজনায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন- বঙ্গবন্ধু আজ কী বলবেন- কী নির্দেশ দেবেন জাতিকে! সাহসী বাঙালির একমাত্র ইচ্ছা চার অক্ষরের একটি প্রিয় শব্দ 'স্বা-ধী-না-তা' স্বাধীনতা! ১৯৭১ সালের এই ঐতিহাসিক দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।' রেসকোর্সে জনতার উদ্দেশ্যে দেওয়া জাতির পিতার এই কালজয়ী ভাষণে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি। এ ভাষণে বাঙালি হত্যা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের চিত্র ফুটে ওঠে। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, 'তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।' জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।
বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে যে কালজয়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, তার মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির মুক্তির ডাক। স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে তা একদিনে অর্জিত হয়নি। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ এর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দীর্ঘ বন্ধুর পথে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিকনির্দেশনা জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
তিনি বলেন, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ দিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চ দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীতে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। একইভাবে এ ভাষণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু পরাধীন বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নই দেখাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিশ্ব সভায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু যে ভাষণ দিয়ে তিনি নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, সেটি হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ। এটি তিনি ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ৭ মার্চের ভাষণদানকালে রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ লোক উপস্থিত হয়েছিল। মাত্র ১৯ মিনিটের জ্বালাময়ী ভাষণ শুধু সেদিনের মুক্তিপাগল মানুষকেই মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করেনি অনেকেই বলেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্মকেও দারুণভাবে নাড়া দেয়। এখনো তাঁর ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে শৃঙ্খল ভাঙার প্রেরণা জোগায়।
৬ মার্চ শনিবার মধ্যরাতে একজন ব্রিগেডিয়ার ধানমন্ডির বাসায় যান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বাণী পৌঁছে দেন। একদিকে ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন এবং টেলিপ্রিন্টারে বার্তা পাঠান শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। ঢাকার জিওসি জে. খাদিম হোসেন রাজা শেখ মুজিবুর রহমানকে সাফ জানিয়ে দেন, '৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা হলে সামরিক বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে জনসভায় হামলা চালাবে। এক কথায় ঢাকা ধ্বংস হয়ে যাবে, যেখানে শাসন করার কেউ থাকবে না। প্রয়োজনে জনসভায় বিমান হামলা করা হবে। উল্লেখ্য, ৭ মার্চের জনসভাকে লক্ষ্য করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে কামানটি স্থাপন করা হয়। ওইদিন একটি জলপাই রঙের হেলিকপ্টার সমাবেশে টহল দিয়েছিল। অন্য কথায়, শেখ মুজিব যদি সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জনসভায় নির্বিচারে গুলি চালাবে এবং এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যে শুধু হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষ নিহত হবে।
বঙ্গবন্ধু কী করবেন- একদিকে ছাত্রনেতাদের স্বাধীনতা ঘোষণার চাপ- অন্যদিকে জনগণের দাবি- একটু ভুল সিদ্ধান্তে জনগণের কতটা ক্ষতি বা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমনকি একটি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা যায়। ওই দিন ৭ মার্চ তাঁর ১০৪ ডিগ্রি জ্বর হয় এবং এই জ্বর নিয়েই তিনি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের অনেক দেশের উদাহরণ দিয়েছেন এবং একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার ভয়াবহ পরিণতির কথাও পরিবারকে জানিয়েছেন। সিদ্ধান্তহীনতার এই সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে অনেক উদাহরণ পেশ করলেন, তখন বঙ্গমাতা মহিয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেসা (বেগম মুজিব) বললেন, 'না, এটা করা ঠিক হবেনা। ছয় দফার মাধ্যমে তাঁদের নেতাকে হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে, এই ঘোষণা না তাদের অনেক ক্ষতি হতে পারে? পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার অপেক্ষায় আছে। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে; তারা এদেশের প্রিয় বাঙালি জাতিকেও ধ্বংস করবে।' বেগম মুজিবের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু নীরবে কিছুক্ষণ নীরবে পাইপ ধরে বসে থাকেন। বেগম মুজিব গৃহিণী হয়েও একজন মহান রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ছিলেন যিনি সবকিছু আন্দাজ করতে পারছিলেন।
বিকাল ৩.১৫ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এলে বাংলার দশ লাখেরও বেশি বীর জনতা তাদের প্রিয় নেতাকে করতালি ও বিকট শ্লোগানে স্বাগত জানায়। মঞ্চ থেকে মাইকে শ্লোগান দেন ছাত্র (ছাত্র) সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। অবিরাম ¯েøাগানে গর্জে ওঠে বাংলার আকাশ। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ আরও অনেকে।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢাকা বেতারে সরাসরি সম্প্রচারের কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপে সেদিন তা প্রচার করা যায়নি। তাৎক্ষণিক হরতালে ঢাকা বেতার স্থবির হয়ে পড়ে। পরে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পরের দিন সকালে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণ সম্প্রচার করতে বাধ্য হয়। সারা বিশ্ব কাঁপানো ভাষণে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রপাতের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্ন, হাজার বছরের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, যা ছিল বাঙালির মুক্তির দৃঢ় প্রতিশ্রæতি। বঙ্গবন্ধু দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ।' বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় এই ঐতিহাসিক ভাষণই স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ ভাগ্য সুস্পষ্ট হয়েছিল।
'প্রতিটি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং রাস্তাঘাট যা কিছু আছে - আমি যদি হুকুম দিতে না পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে ভাষণ দেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতাকামী জনগণকে দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমানের কূটনীতিক। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি একজন কূটনীতিকের মতো সবকিছুই প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গত ২৩ বছর বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা পরিকল্পনা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের বঞ্চনার কথা বলেছেন। অলিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মর্ম পাকিস্তানিরা বুঝতে পারেনি। তখন কিশোর ও ছাত্র হিসেবে সকলের একমাত্র দাবি ছিল স্বাধীনতা- আমরা অন্য কোনো ঘোষণা মেনে নেব না। মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের ‘জয় বাংলা’ বলে- যা আজকের পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ৮ মার্চ সোমবার প্রকাশিত ঢাকার 'দৈনিক ইত্তেফাক', 'দৈনিক পাকিস্তান', 'দৈনিক আজাদ', 'দৈনিক সংবাদ', 'দৈনিক সংগ্রাম', 'মর্নিং নিউজ' ও 'পাকিস্তান অবজারভার' পত্রিকার দিকে তাকালে বঙ্গবন্ধু 'জয় বাংলা'কে দেখা যায়। ৮ই মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের চির অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এদশের মানুষের কাছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ছিল দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কারণ এতে পাকিস্তানি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির জন্য জনগণকে লড়াই করার নির্দেশনা ছিল। ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ ভাষণই নয়, এটি জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ভাষণে রয়েছে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনগণের নির্দেশনা। ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের দুঃশাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের পাকিস্তানি শোষণ ও শাসন থেকে মুক্ত করার নির্দেশ দেন এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতির রূপরেখা দেন।
বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক লাভ এবং সামাজিক অধিকারের মধ্যে বিভাজন মোকাবেলা করেছিলেন এবং সমস্ত বাঙালির সাধারণ সংগ্রামের সাথে নিজেকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করে জনগণের প্রতি তার পাওনাকে সংযুক্ত করে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াইয়ের প্রতি তাঁর দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সেই বিন্দু থেকে, বক্তৃতাটি এক ব্যক্তি হিসাবে জড়িত সমস্ত দলের কাজকে সহজ করেছিল- যা আওয়ামী লীগকে প্রভাবিত করে, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের উপর প্রভাব ফেলে; নিরীহ বাঙালিকে গুলি করা আমাদের হৃদয়ে গুলি করার সমান।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন। মহান এ নেতার সে স্বপ্ন পূরণে আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা করেছেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা লেখেন, ‘শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রধান শিরোনাম ছিল এ রকম, ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন’।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ঐতিহাসিকগণ প্রতিনিয়ত ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণা করছেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর প্রায় সব কটিই ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অলিখিত। বঙ্গবন্ধু নিজেও জানতেন না যে, তিনি কী বলবেন বা কীভাবে শুরু করবেন।
বঙ্গবন্ধু স্টেজে উঠে যখন বক্তৃতা শুরু করলেন, মনে হলো তিনি যেন বাঙালি জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যটি রচনা করছেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালির শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য, যেটি বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে রচিত। যুগে যুগে সব সমাজের নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে উৎসাহ, উদ্দীপনা আর অনুপ্রেরণা জোগাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ