শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কারা?

ওমর তাসিক, সাংবাদিক ও লেখক

১৮:৫২, ২৩ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৮:৫৪, ২৩ অক্টোবর ২০২১

১০৪২

পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কারা?

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতবর্ষকে নিজের পদানত রেখে শোষণ করার জন্য “Divide and Rule” পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল যার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিলো ধর্ম। তারা এই উপমহাদেশে নানান ধর্মের সহঅবস্থানকে বিভাজিত করে অপশাসনের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ও ইংরেজরা ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশ ভাগ করে দিয়ে যায়।

১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলেও পাকিস্তান সৃষ্টির ২৪ বছর পর ধর্মের ভাগাভাগি থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠী এদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করার নানান পাঁয়তারা করেই চলেছে। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে ধর্ম পরিচয়ের উর্ধ্বে থেকে জাতীয়তাবাদের মূল পরিচয়ে পরিচিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের চার মূল নীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মূল কারণ ছিলো এদেশে কেউ যাতে ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে অথবা কেউ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে হানাহানির বীজ বপন না করতে পারে।  একজন উদারচিন্তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক হিসেবে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ধর্মীয় সন্ত্রাস একবার শুরু হলে তা এই সমগ্র অঞ্চলকেই অশান্ত করে তুলবে। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এখন ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ধর্মীয় নির্যাতনের ঘটনা প্রায়শঃই ঘটছে। এসব ঘটনা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে আর তা সহিংসতায়ও রূপ নিচ্ছে। 

এখন প্রশ্ন হলো কেনো বাংলাদেশে এসব ঘটনা ঘটছে আর কারাই বা এসব ঘটাচ্ছে? 

এই কেনোর উত্তর খুঁজতে গেলে দূটি বিষয় সামনে আসে, প্রথমতঃ কোনো একটি গোষ্ঠী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা থেকে রাজনৈতিক ফয়দা লোটার চেষ্টা করছে, দ্বিতীয়তঃ এধরণের ঘটনা ঘটার পর রাজনৈতিক কারণে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হয়নি, সেকারণেই অপরাধীরা আশকারা পাচ্ছে। 

এর বাইরেও কি কিছু রয়েছে? রয়েছে কি ভৌগলিক সীমারেখার বাইরের বড় কোনো সমীকরণ? সেটাও কিন্তু আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তা কিছু থেকে থাকলে- আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের কাদা ছোড়াছুড়ি, দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের পারস্পরিক দোষারোপের প্রচেষ্টা আর রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক বাক্যবাণ চলতে থাকলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তা বের করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে একের পর এক হিন্দু বৌদ্ধদের মন্দির,মণ্ডপে হামলা অথবা বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং নানান নির্যাতনের ঘটনায় আপাত দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তি বা স্থানীয় গোষ্ঠী জড়িত থাকলেও এসবের মাস্টার মাইন্ডের হিসাবটা খুব সরল কি? হতে পারে- এর পেছনে অবশ্যই গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। কারণ সময় বয়ে চলার সাথে সাথে আমরা দেখেছি- এই উপমহাদেশে এখন যেমন মুসলমান উগ্রবাদ বেড়েছে তেমনি হিন্দু ও বৌদ্ধ উগ্রবাদও সীমাহীনভাবেই বেড়েছে। বর্তমানে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে মুসলমানদের উপর অত্যন্ত ভয়াবহ নির্যাতন শুরু হয়েছে, তা আমরা আঞ্চলিক খবরাখবরে স্পষ্টতই জানতে পাই। যার প্রতিফলন বাংলাদেশে পড়া অস্বাভাবিক নয়! 

দেশের ভেতরে পরমত অসহিষ্ণু ও সংঘাতময় রাজনীতিতে সরকারে থাকা রাজনৈতিক শক্তি ভাবছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য প্রতিপক্ষ এধরণের হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আর বিরোধীরা ভাবছে তাদের দমন পীড়ন  আর সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা আড়াল করতে এধরণের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। 

কিন্তু রাজনীতির এই কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যে থাকলে, এর বাইরের আরো বড় কোনো পক্ষ থেকে থাকলে তা তলিয়ে দেখার সুযোগটা কমে যায়। দোষারোপের রাজনীতি চলতে থাকলে এধরণের নোংরা ঘটনা কখনোই বন্ধ করা যাবে না।

আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি মুসলমান প্রধান দেশ আর এদেশে ধর্মীয় অবমাননার সামান্য কোনো ঘটনার গুজব ছড়াতে পারলেই কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এতোটুকু দ্বিধা করবে না।

প্রতিবেশী দেশের বর্তমান রাজনীতিটাও কিন্তু সম্পুর্ণ ধর্মভিত্তিক, সেটাও বিবেচনা থেকে সরিয়ে রাখলে চলবে না। কারণ সেদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে ভোটের ব্যবসার এক বিরাট উপকরণ হিসেবে বাংলাদেশ কখনো কখনো গুরুত্ব পায়। আর সে কারণে সে দেশের কিছু জাদরেল নেতার বাংলাদেশকে ঘিরে ধর্মভিত্তিক উস্কানীমূলক মন্তব্য আমরা প্রায়শঃই শুনি। 

আমরা জানি, আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন বেশ ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে। এর উন্নয়নের সব সূচক এবং এর সহনশীল পররাষ্ট্রনীতি এদেশকে এমনিতেই এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। তাই এমনিতেই এদেশের শত্রু জন্মেছে। 

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও, আগেই বলেছি, সেদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের আগমন ঘটেছে।  দেশটির অন্যতম ডানপন্থী ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর আঁতুরঘরে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বি জে পি ) এখন সেদেশ শাসন করছে। আর এস এস তথা বিজেপি ভারতে মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছে যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে বাধ্য। ভারতীয় নেতা ও মন্ত্রী অমিত শাহ, শিলাদিত্য দেব ও সুব্রামনিয়ম স্বামী বাংলাদেশি মুসলমানদের উইপোকা আখ্যা দিয়ে এমন কথাও বলেছে যে ভারতের উচিত বাংলাদেশ দখল করে নেয়া। এধরণের মন্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।

ফলে ভারতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মনস্তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়ে দিলে চলবে না। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে এপর্যন্ত নানান সহিংসতায় ১০ হাজারের বেশী মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে নৃশংসতার অল্প কিছু নিদর্শন দিলেও বলতে হয় ১৯৮৩ সালে আসামে ১৮০০ মুসলমান হত্যা, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় ৯০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়, ২০০২ সালে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব মুসলিম নিধন অভিযানে ২ লক্ষ লোক বাস্তুচ্যুত হয় ও ২ হাজার মুসলমান হত্যা করা হয়, ২০১৩ সালে মুজাফফরনগর সহিংসতায় ৫০ হাজার মুসলমান বাস্তুচ্যুত হয় ও ৪২ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়, ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গায় ৫৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং হাজার হাজার মুসলমানের সর্বস্ব লুট করে নেয়া হয়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আসামে শিব মন্দির বানানোর জন্য পুলিশ সরাসরি মুসলমানদের উপর গুলি করে তাদের বাস্তুচ্যুত করে ও দুজন কে মেরে ফেলে। গতকাল ত্রিপুরায় মসজিদে আগুন দেয়াসহ মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি লুট করা হয়। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা কারোরই জানা নেই। 

অন্যদিকে বাংলাদেশ সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেছে, এদেশে হিন্দুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। ২০১১ সালে এদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিলো ৮.৪ শতাংশ, ২০১৪ -২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০.৭ শতাংশ এবং বর্তমানে সেই সংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি।  

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানকে সবসময় কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করে। বাংলাদেশ সব সময়ই ভারতের সৎ প্রতিবেশী হিসেবে নিষ্ঠাবান রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারত যেমন তার প্রধান শত্রু পাকিস্তানের ৪ হাজার কিলোমিটার বিপদজনক সীমান্তের হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে  রক্ষা পেয়েছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সহজ যোগাযোগ সৃষ্টি তথা ঐ অঞ্চলের ভয়াবহ বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশ অত্যন্ত সক্রিয় ভুমিকা রেখে তা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করেছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকার ভারতীয়  বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে ভারতকে এক বিরাট স্বস্তির জায়গা উপহার দিয়েছে। 

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে সব সময়ই অত্যন্ত স্বচ্ছ। কিন্ত ভারতের আর এস এস তথা বিজেপি এখন হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্বকেই তাদের রাজনৈতিক পূঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে তা না হলে বাংলা আসাম ত্রিপুরা উড়িস্যায় তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। 

বাংলাদেশে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে যেসব হামলার ঘটনা ঘটছে সেগুলোর পেছনে এসব অপরাজনীতির ভূমিকা থাকার সন্দেহটি কোনোভাবেই ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এদেশের উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য বেদীতে কোরান রাখার মতো জঘন্য কাজে মাদকাসক্ত ভবঘুরেদের ব্যবহারকে স্রেফ দেশীয় ষড়যন্ত্রে সীমাবদ্ধ রেখে ভাবলে তা ভুল হতেও পারে। সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে। 

তবে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এমন প্রচেষ্টাতেও বিনষ্ট করা সম্ভব নয়, তা আরও একবার প্রমানিত। কারণ এবারের ঘটনার পরেও হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। সরকার ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছে তাতে বোঝাই যায় যে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। 

ওমর তাসিক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank