বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ফুর্তিবাজ সিন্দুঘোটক

শেখ আনোয়ার

১৫:৪৬, ২৮ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১৫:৪৯, ২৮ অক্টোবর ২০২২

১২০৯

ফুর্তিবাজ সিন্দুঘোটক

এক প্রকারের জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর নাম সিন্ধুঘোটক। বিজ্ঞানী আর গবেষকরা আদর করে নাম দিয়েছেন ‘অডোবেনাস রোসমারাস’। চেহারাটা ফুর্তিবাজ টেকো ভদ্রলোকের মতো। সিন্ধুঘোটকের মুখে হাতির দাঁতের মতো দীর্ঘ দাঁত রয়েছে। এছাড়া এদের মুখে রয়েছে গোঁফ। গোটা দেহ মোটা থলথলে। বিশাল দাঁত, গোঁফ আর বাদামি চামড়া দেখে সিন্ধুঘোটকদের সহজেই চেনা যায়। ইংরেজীতে এদের নাম ওয়ালরাশ। 

স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি এই সিন্দুঘোটক। এদের বাস উত্তর মেরুর কাছাকাছি উত্তর মহাসাগর এবং উত্তর গোলার্ধের মেরু-সন্নিহিত অঞ্চলে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় পুরুষ সিন্ধুঘোটকের ওজন সাড়ে চার হাজার পাউন্ড বা দু’ হাজার কেজি পর্যন্ত হয়। গায়ে-গতরে বিশাল একেকটি পুরুষ সিন্ধুঘোটক স্ত্রীদের চেয়ে আরও অনেক বড় হয়। সাত থেকে এগার ফুট লম্বা হয়। সাধারণ একটি শিশু সিন্ধুঘোটকের ওজন কত? শুনলে চমকে উঠতে হয়- শিশুর ওজনই পঞ্চাশ থেকে সত্তর কেজি! বলা হয়ে থাকে, প্রাণীদের মধ্যে কেবল হাতি সীল মাছের ওজনই সিন্ধুঘোটকের চেয়ে বেশি।

সিন্ধুঘোটক অগভীর সমূদ্রে বাস করে। সামুদ্রিক এই প্রাণীটির অর্ধেক সময় কাটে পানিতে। বাকি অর্ধেকটা ডাঙ্গায়। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় এরা সমুদ্রের বরফের মধ্যে কাটায়। এদের প্রধান খাদ্য হলো শামুক ও ঝিনুক। এরা দীর্ঘজীবী সামাজিক প্রাণী। প্যাসিফিক সিন্ধুঘোটকদের দেখা মেলে রাশিয়া আর আলাস্কায়। এমনিতে চেহারা-সুরতে খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে প্যাসিফিক সিন্ধুঘোটকরা আকারে একটু বড় হয়ে থাকে। উত্তর কানাডা থেকে শুরু করে গ্রিনল্যান্ড পর্যন্ত দেখা যায় আটলান্টিক সিন্ধুঘোটকদের। সাধারণত কম পানির জায়গায় বেশি সময় কাটালেও খাবার খোঁজে পানির তিনশ’ ফুট নিচে পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। আর পানির তলায় ডুবে থাকতে পারে আধ ঘণ্টার মতো। 

গবেষকদের ধারণা, এদের রক্ত আর পেশির মধ্যে অক্সিজেন জমিয়ে রাখার কাজ সহজ। পানির নিচে ডাইভ দেওয়ার সময় সেগুলো কাজে লাগায়। তাই একই আকৃতির একটি স্থলের স্তন্যপায়ী প্রাণীর দ্বিগুণ বা তারও বেশি রক্ত থাকে এদের শরীরে। শামুক ছাড়াও এদের পছন্দের খাবার তালিকায় রয়েছে শেলফিস (শক্ত খোলসযুক্ত সামুদ্রিক প্রাণী), মাছ এমন কি সিল মাছও এরা খায়। আবার মৃত হাঙরও খায় কখনো কখনো। এদের শত্রæদের মধ্যে রয়েছে কিলার হোয়েল আর মেরু ভালুক। অবশ্য এসব প্রাণীও সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক সিন্ধুঘোটকদের কম ঘাঁটায়। শিশু সিন্ধুঘোটকরাই তাদের পেটে যায় বেশি। সিন্ধুঘোটক ঘুমায় ডাঙায়। কখনো টানা আঠার থেকে উনিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটায়। অবশ্য সাগরে থাকা অবস্থায় আবার তিন-চার দিন না ঘুমানোর রেকর্ডও রয়েছে। বুনো অবস্থায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছরের মতো বাঁচে একেকটি সিন্ধুঘোটক। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, গোটা দুনিয়ায় আড়াই লাখের মতো সিন্ধুঘোটক রয়েছে। শীতের দেশের প্রাণী হিসেবে সিন্ধুঘোটকের পরিচিতি রয়েছে। প্রচন্ড শীতল আবহাওয়ায়ও দিব্যি টিকে থাকতে পারে ওরা। এমনকি হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস পয়ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে ওরা। সিন্ধুঘোটকদের শরীরের পুরু চর্বির স্তর এদের ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচায়।

আগেই বলা হয়েছে, বরফের রাজ্য আলাস্কাতে বেশি দেখা যায় সিন্ধুঘোটক। এই আলাস্কাতেই ঘুরাঘুরি করে মানুষরূপী আজরাইল! সিন্ধুঘোটকের নিষ্ঠুর মানুষ নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নির্বিচারে হত্যা করছে নীরিহ প্রাণী সিন্দুঘোটক। উত্তর মেরুর কাছাকাছি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও খাদ্যাভ্যাসে সিন্ধুঘোটকের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। আলাস্কার পশ্চিম উপকূলের অধিবাসী ও বাইরের কিছু লোক সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয় সিন্ধুঘোটক শিকারে।

সিন্ধুঘোটকের এমনিতে অনেক দাঁত থাকলেও দু’টো দাঁত অন্য সব দাঁতকে ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণেই আরো বেশি বিখ্যাত ওরা। এ ধরনের দাঁত তিন ফুটের মতো লম্বা হয়। বিশাল এই দাঁত কিন্তু খাবার খুঁজতে কিংবা খাবার টুকরো করতে ব্যবহার করে না সিন্ধুঘোটকরা। অবশ্য বরফ ভাঙতে এগুলো প্রয়োজন হয় তাদের। আবার কোনো মেয়ে প্রাণীকে নিয়ে যখন দু’টো পুরুষ সিন্ধুঘোটকের লড়াই বাধে, তখনো ব্যবহার করে এই দাঁত। আবার এই দাঁত দু’টোই সিন্দুঘোটকের সবচেয়ে বড় শত্রæ। এছাড়া চামড়া আর চর্বি তো রয়েছেই। দীর্ঘকাল ধরেই আদিবাসীরা সিন্ধুঘোটক শিকার করে খায়। সিন্ধুঘোটকের মাংস, চর্বি, দাঁত, এবং অস্থিকে আদিবাসীরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। উনিশ ও বিশ শতকে চর্বি ও দাঁতের জন্য সিন্ধুঘোটকদের বাণিজ্যিকভাবে শিকার করা শুরু হয়। আদিবাসীরা এতদিন প্রায় নির্বিচারে হত্যা করেছে আলাস্কান সিন্দুঘোটক। ফলে সিন্ধুঘোটকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। 

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সিন্ধুঘোটকের সংখ্যা বাড়লেও আটলান্টিক সাগরে সিন্ধুঘোটকের সংখ্যা এখনও বাড়েনি। ফলে সারা পৃথিবীতে সিন্ধুঘোটক এখন বিলুপ্ত প্রায় এক প্রাণী। ইদানীং অবশ্য সরকারি হস্তক্ষেপে এই নিষ্ঠুরতা কিছুটা কমেছে। কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়নি। সরকার নির্বিচারে এবং ব্যাপক সিন্ধুঘোটক নিধন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আদিবাসী সংগঠনগুলোর চাপে সরকার আইন শিথিল করতে বাধ্য হয়। আদিবাসীদের বক্তব্য, এটি তাদের ঐতিহ্য। তাদের ন্যায্য অধিকার এবং সংস্কৃতির অংশ। তাই শুধু আদী অধিবাসীরাই সিন্ধুঘোটক হত্যা করার অধিকার রাখেন। তবুও শুধু খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কিংবা নিজেদের প্রয়োজনে জুতো, জ্যাকেট ইত্যাদি তৈরির জন্য। তারপরও বহু আদিবাসী এখন সিন্ধুঘোটকের ছায়াটিও মাড়ায় না, ভয়ে। শুধুমাত্র সরকারী গ্রেফতারের ভয়ে। তাই বলে সিন্ধুঘোটকের বিলুপ্তি ঠেকানো যাচ্ছে না। গোপনে গোপনে চলছে নিধন। মানুষের লোভ যে বড় সাংঘাতিক! আলাস্কায় এক আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে এ কাজে। তাদের কাজ হচ্ছে দাঁত দু’টোর বদলে নেশার দ্রব্য, প্রধানতঃ কোকেন এবং হেরোইন সরবরাহ করা। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank