বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

১২:৪১, ৬ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১৩:৩০, ৬ আগস্ট ২০২১

১২৮৭

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা

বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই গড়ে ওঠে ভিন্ন এক মানসজগত
বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই গড়ে ওঠে ভিন্ন এক মানসজগত

এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়--
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥

বর্ষাতেই তিনি মিশেছিলেন বেশি। বর্ষার রূপ-গন্ধ-ছন্দ তিনিই আপমর বাঙালির মনমননে গেঁথে দিয়ে গেছেন। গত শতকের এমনই এক শ্রাবণ দিনে তিনি চলে যান। ক্যালেন্ডারের হিসাবে সে দিনটি ছিল ২২ শ্রাবণ।

'হায় এ কী সমাপন!

অমৃতপাত্র ভাঙিলি,

করিলি মৃত্যুরে সমর্পণ..হায় এ কী সমাপন!'

আশি বছর আগের এই দিনে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর যে ঠাকুরবাড়িতে বাংলার ও বাঙালির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়, সে বাড়িতে তার প্রয়াণ ঘটে। 

হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন ।

বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই গড়ে ওঠে ভিন্ন এক মানসজগত। রবীন্দ্রমানসের রূপ সর্বজনীন, ব্যাপকতা বিশ্বজনীন এবং তা সবসময় সমসাময়িক। সব বয়সের জন্য নতুন উপলব্ধির। তাই রবীন্দ্রনাথ সবার হয়েছেন, পেয়েছেন পূর্ণতা।

মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ্‌দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম   রিমিঝিম   রিমিঝিম॥

বাংলা সঙ্গীতের ধারায় সবচেয়ে শক্তিমান হিসেবে যদি একক কোনো ব্যক্তির কথা বলতে হয়, তবে নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে সাবলীল। নিজের মনের ও অচিন পাখির খোঁজে নিমগ্ন হতে চাইলে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতাই সবচে বড়ো আশ্রয়। 

আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে ।।
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে ।।

সাহিত্য কি- তা না বোঝা মানুষও কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানটি ঠিকই প্রাণে তুলে নেন। তাই অন্যান্য সৃষ্টি কর্মের মধ্যে গানই তাকে আপন করেছে, দিয়েছে ভালোবাসার আসন।তিনিই একমাত্র কবি, যিনি দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা।

ছিলো মনও তোমারি প্রতিক্ষা করি
যুগে যুগে দিন ও রাত্রি ধরি,
ছিলো মর্ম বেদনাঘন অন্ধকারে
জন্ম জন্ম গেল বিরহ শোকে..
বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২ কি ১৪ বছর বয়সে প্রথম গান রচনা করেন, আর তাঁর জীবনের শেষ গানটি ছিলো তাঁর নিজের জীবনেরই শেষ জন্মদিন উপলক্ষে লেখা, ‘হে নূতন, দেখা দিক’ গানটি। সেটি ছিলো ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস।

দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর;
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি’
ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী বাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম;—
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।

রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছেন ৮০ বছর, কিন্তু এর মধ্যে কাজই করেছেন ৬৪ বছর। আর এই সময়কালে বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে তিনি বাঙালির মানসজগতের দিগবলয় বদলে দিয়েছেন। কী গল্পে, কী উপন্যাসে, কী কবিতায়, কী সঙ্গীতে, কী নাটকে, কী চিত্রকলায় - তিনি পথ করে করে হেঁটেছেন।   

রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাঁর নতুন বৌঠানের (কাদম্বরী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী) ছিল অবদান বিশাল। শেষ বয়সে এসে তিনি যখন নতুন বৌঠানের স্মৃতিচারণ করতেন, তখন তা হয়ে উঠত বাঙময়।

'যাহার লাগি চক্ষুবুজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি 
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

ঠাকুর পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তানটি একজন কবির পাশাপাশি একজন জমিদারও ছিলেন। বরেন্দ্রভূমির এক বৃহৎ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে তার জনহিতৈষি কর্মকান্ড দিয়ে তিনি বরণীয় হয়েছিলেন।

বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ১৮৯১ সাল থেকে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনা শাজাহাদপুর, নওগাঁ,নাটোরে ও ওড়িশায় জমিদারিগুলো তদারক শুরু করেন কবি। ঠাকুর পরিবারের প্রায় প্রতিটি সন্তানই কৃতি ও সফল হলেও, পারিবারিক ব্যবসায় কেউই সেভাবে ধরে রাখতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপরেরই বাবার ভরসা ছিল বেশি।

শিলাইদহের মানুষ, প্রকৃতি, লালন আর পদ্মার ঢেউ তার কবিজীবনে বিশেষ অবদান রাখে। এখানকার জমিদারবাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন।

কৃষ্ঞকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে।
কালো? তা সে যত কালোই হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

যদিও জীবনের উপসংহারে আত্মোপলব্ধি থেকে তার মনে হয়েছে তার একটাই পরিচয়, শুধু কবি।

১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এশিয়ায় প্রথম নোবেল জয়ী তিনি।  
কবি রচিত গানের সংখ্যা দুই হাজার। অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেন। তার সমগ্র গান ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে রয়েছে।

জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩টি, ছোটগল্পের বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মত্যুর পর ৩৬ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া ১৯ খণ্ডের রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র’। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মের সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তি নিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে।

বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,

করুণা তব অবিশ্রাম জনমে মরণে ॥

স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,

কত সান্ত্বন করো বর্ষণ সন্তাপহরণে ॥

জগতে তব কী মহোৎসব, বন্দন করে বিশ্ব

শ্রীসম্পদ ভূমাস্পদ নির্ভয়শরণে ॥

তার নিজস্ব শিক্ষাচিন্তার ভিত্তিতে শান্তিনিকেতনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃতির কাছাকাছি আদর্শ পরিবেশের মধ্যে শিশুদের বড়ো করে তুলতে হবে। প্রাচীন ভারতের আশ্রমিক শিক্ষার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। তাই শিক্ষার্থীদের শান্তিনিকেতনে রেখে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা  থেকেই ২০ বিঘা জমি নিয়ে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে
কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে
কী হবে গতি, বিশ্বপতি, শান্তি কোথা আছে
তোমারে দাও, আশা পূরাও, তুমি এসো কাছে

এখানে রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর পাঁচজন ছাত্র নিয়ে ব্ৰত্মচর্যাশ্রম’নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ধাপে ধাপে এই শান্তিনিকেতনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন।

এক শ’ দুই বছর আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন; স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ববিবেক। ৫৮ বছর বয়সি সাহসী কবি সেদিন আমাদের শুনিয়েছিলেন মুক্তির মন্ত্র; শুদ্ধ প্রত্যয় নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উদ্দীপনা দিয়েছিলেন।

 যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক,    আমি তোমায় ছাড়ব না মা!

 আমি    তোমার চরণ--

মা গো, আমি   তোমার চরণ করব শরণ

আর কারো ধার ধারব না মা ॥

বিত্ত, বৈভব আর প্রাচুর্যের স্বাচ্ছন্দ্য রবীন্দ্রনাথকে কখনোই মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। সৃষ্টিবোধই বরাবর দ্ব্যার্থহীন থেকেছে তাঁর কাছে। তাই তিনি চিরদিনের, চিরপথের রবি !

আমার    প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের   বাতাসটুকুর মতো।
সে যে    ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে--
ফুল      ফুটিয়ে গেল শত শত।
সে       চলে গেল, বলে গেল না-- সে   কোথায় গেল ফিরে এল না।
সে       যেতে যেতে চেয়ে গেল    কী যেন গেয়ে গেল--
তাই     আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে।


 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)

আরও পড়ুন

Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
বিশেষ সংবাদ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত