শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মহাকাশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র

শেখ আনোয়ার 

১৩:০৩, ৭ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১৩:০৭, ৭ অক্টোবর ২০২২

৭৫৬

মহাকাশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র

বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন-সভ্যতা অচল। মানব সভ্যতার বর্তমান অগ্রগতির যুগে বিদ্যুতের ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিদ্যুতের উপর এতোটাই নির্ভরশীল যে বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কিছুই করা যায় না। বিদ্যুৎ আমাদের বাতি জ্বালায়, পাখা ঘোরায়, কলকারখানার যন্ত্রপাতি চালায়। রেডিও, টেলিভিশন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, হিটার, ওভেন, রেফ্রিজারেটর, কম্পিউটার, এসি ইত্যাদি প্রযুক্তি উপকরণ ব্যবহার করা যায় বিদ্যুতের জন্য।

অবাক হলেও সত্যি! আমাদের দেশে একযুগ আগে বিদ্যুৎ প্রায় সবসময় থাকতো না। সন্ধ্যায় হারিকেন-মোমবাতি জ্বালিয়ে শিশুদের পড়তে হতো। তখন সারাক্ষণ লোডশেডিং হতো। দিন বদলেছে। প্রচলিত উপায়ে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ আমাদের চাহিদা পূরণ না করায় বর্তমানে পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা সরকার। তবে অতি সাম্প্রতিক বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতির কারণে সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সম্পূর্ণ ক্ষমতার দ্বারা উৎপাদন সম্ভব হয় না। কারণ চলমান জ্বালানি সংকটে যন্ত্র চালানোর সমস্যার জন্য কোনো কোনো সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। তখন প্রয়োজনের তুলনায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ফলে চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ শক্তি থাকায় সব জায়গায় একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। ফলাফল লোডশেডিং। বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে চিন্তার যেনো শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিদ্যুতের প্রচলিত উৎস বর্তমানে অপ্রতুল। তাই বিশ্বব্যাপি বিদ্যুতের অপ্রচলিত উৎস ব্যবহার এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাল উত্তীর্ণ হয়ে প্রয়োগের প্রচেষ্টা চলছে। এই অপ্রচলিত উৎসগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া একটি টেকসই উৎস হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা জানান।

এবার মহাকাশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মার্কিন নৌবাহিনীর একটি বিশেষ সোলার প্যানেল মহাকাশে সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। মহাকাশ থেকে সূর্যের যে শক্তি পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পৃথিবীতে পাঠানো যাচ্ছে। পেন্টাগনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাটিয়ে মহাকাশে পৌঁছে গেছে বিশেষ সৌর প্যানেলটি। প্যানেল থেকে ড্রোনের সাহায্যে একটি লুপ তৈরি করা হয়েছে। সে পথেই মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আসছে বিদ্যুৎ। পিআরএএম নামের এই প্যানেলে রয়েছে থার্মাল ভ্যাকিউম চেম্বার। যা বিদ্যুৎ শক্তিকে ধরে রাখতে পারে। এর আগে মার্কিন নভোচারীরা সিটি ইন স্পেস বা প্রথম আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন স্থাপনার অংশ হিসেবে দু’টো মডিউলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চল্লিশটি বিদ্যুতের লাইনের সংযোগ স্থাপন করেন। নাসার পরিকল্পিত সময়ের অনেক আগেই বিদ্যুতের এই সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হন নভোচারীরা। নাসার সবচেয়ে অভিজ্ঞ নভোচারী জেরি রস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। তাঁকে বিদ্যুতের তার এগিয়ে দিতে সহযোগিতা করেন জেমস নিউম্যান। নিউম্যান বলেন, হার্ডওয়্যারের কাজটা ছিল বাস্তবিক অর্থেই সুন্দর। 

পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ অ্যান্ডোভারের রোবট বাহুর শেষ প্রান্তে বসে মার্কিন মডিউল ইউনিটির তলদেশে কাজ শুরু করেন বিজ্ঞানী জেরি রস। পরবর্তীতে চল্লিশ ফুট ওপরে তুলে আনা হয়-কেবল সংযোগের জন্য। জেরি রস ও নিউম্যান মহাশূন্যে তাঁদের সাড়ে সাত ঘন্টা পদচারণার সময় চার ঘন্টায় দু’টো মডিউলের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ সম্পন্ন করেন। নভোচারী দু’জনের নিরাপত্তার জন্য এ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হয়নি। সংযোগ দেওয়ার পর ইউনিটের বিদ্যুৎ চালু হতে সৌরশক্তির দরকার হয়। এর কিছুক্ষণ পর নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ ইউনিটটির ভিতরে অবস্থিত কম্পিউটার ফ্যান ও হিটার চালু হয়ে যায়। ১৬ টি দেশের অর্থায়নে প্রথম আন্তর্জাতিক মহাকাশ বিদ্যুৎ স্টেশন স্থাপনের কাজ ছিলো এটি। বিজ্ঞানীরা এবার বলছেন, মহাকাশে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশনটি নির্মিত হলে এটি ভবিষ্যতের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হবে। এই বিশাল প্রকল্প নির্মাণে প্রায় ছয় হাজার থেকে দশ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানী পল জ্যাফে বলেন, তাঁদের উদ্ভাবিত ১২ বাই ১২ ইঞ্চির একেকটি বিশেষ সৌর প্যানেল একেক বারে দশ ওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ শক্তি স্থানান্তর করতে সক্ষম।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবিত ওই বিশেষ সৌর প্যানেল একটি এক্স-৩৭বি মনুষ্যবিহীন ড্রোনে পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানো হয়েছে দু’ হাজার কিমি. উপরে মহাকাশের নি¤œ কক্ষপথে। ‘পিৎজা বক্স’ আকারের এই সৌর প্যানেল একটি আইপ্যাড বা একই ধরনের ডিভাইস চালু রাখার জন্য মহাকাশে সফলভাবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, ফটোভোলটাইক রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যান্টেনা মডিউল বা পিআরএএম পরীক্ষা সফল হয়ে এটি বর্তমানে সঙ্গে থাকা আইপ্যাডের বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সৌর প্যানেলটির নতুন ভার্সনের উৎপাদিত বিদ্যুৎ মাইক্রোওয়েভে রূপান্তরিত করে পৃথিবীতে পাঠানো যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিজ্ঞানীরা। নাসার বিজ্ঞানীদের মতে, মহাকাশে তৈরি বিদ্যুৎ নিয়ে এমন কিছু ভিশন রয়েছে, সেখান থেকে বহু গিগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হবে পৃথিবীতে। এমনকি এতোটা পরিমাণ বিদ্যুৎ আনা যাবে, যা বড় একটি শহরের জন্য যথেষ্ট। 

ওয়াশিংটনে মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষণা ল্যাবে সৌর প্যানেল উদ্ভাবনের আরও উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। প্রচন্ড শক্তিশালী সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিও বেশ কিছুটা অংশ পৃথিবীতে ঢোকার আগেই বায়ুমন্ডলে বাঁধা পেয়ে ভাসতে থাকে। সেই রশ্মি আয়ত্তে এনেই নতুন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে বিশেষ এই সৌর প্যানেল। ভবিষ্যতের পৃথিবীর বিপুল বিদ্যুৎ শক্তির চাহিদা এভাবেই জোগান দেবে বিশেষ এই সৌর প্যানেল। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন মহাকাশ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমাদের জাতীয় গ্রীডে সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশও বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank