বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১ || ১২ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

লকডাউনে বিপদের বন্ধু

শেখ আনোয়ার

১২:৩৮, ৬ জুলাই ২০২১

আপডেট: ১৪:২৪, ৬ জুলাই ২০২১

৭১৭

লকডাউনে বিপদের বন্ধু

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বাংলাদেশে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকের মৃত্যু হয়েছে। আবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। করোনার মেয়াদ কতদিন, সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নন। বিজ্ঞানীরাও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। কোথায় গিয়ে থামবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এই অদৃশ্য শত্রুকে মারার ওষুধ মানুষের অজানা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট করোনায় ভ্যাকসিনেও ভরসা নেই। তাই একে মোকাবিলা করার একমাত্র জানা পদ্ধতি হলো- লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা।’

ভয়াবহ ডেল্টা করোনার বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশেও এখন কঠোর লকডাউন চলছে। লকডাউনের বিধিনিষেধ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সবাই এখন ঘরে বন্ধী। স্মার্টফোনের স্ক্রীনে কতক্ষণ আর আটকে রাখা যায় ছোটদের? ধরা যাক, ঘরের ছোট শিশুটি হৈ হুল্লোড় করতে গিয়ে হঠাৎ করে আঘাত পেলো। হাত পায়ের চামড়াও ছিলে গেলো অনেকখানি। অন্যরা যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ঠিক তখন ঘটে গেলো এই হরিষে বিষাদ। ক্ষতস্থান থেকে তখন অনবরত রক্ত ঝরছে। শিশুর মা অল্পতেই ভীষণ নার্ভাস হয়ে যান। তিনি তো বাচ্চার শরীরে রক্ত দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। ভরা করোনার এই সময়ে আশেপাশে কোথাও কোনো ডাক্তার নেই। পরিবারের কেউ বুঝে উঠতে পারছেন না কি করবেন। শিশুর মা’র কান্না শুনতে পেয়ে পাশের বাড়ির ছেলে দৌঁড়ে এলো। আইস ব্যাগে বরফ ভর্তি করে মাথায় চাপ দিয়ে প্রথম রক্ত পড়া বন্ধ করলো। তারপর ক্ষতস্থানে অ্যাণ্টিসেপ্টিক লাগিয়ে তুলো দিয়ে ঢেকে ড্রেসিং গজ দিয়ে সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর হাতে পায়ে যেখানে চামড়া ছিলে গেছে সে জায়গাটা ভালো করে পরিষ্কার করে অ্যাণ্টিসেপ্টিক লাগিয়ে তুলো দিয়ে ঢেকে টেপ দিয়ে আটকে দিলো। 

করেনায় ঘরে বসেও এরকম দূর্ঘটনায় পড়তে পারেন আপনি কিংবা আপনার আত্মীয় অথবা প্রতিবেশী যে কেউ। তাই হাতের কাছে যদি একটা ফার্স্ট এইড বক্স থাকে তবে ডাক্তার না পেলেও প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু আপনি ঘরে বসেই করতে পারেন।  আসুন জেনে নেওয়া যাক করোনায় ঘরের বিপদের বন্ধু ফার্স্ট এইড বক্স তৈরি করতে কি কি দরকার।


 
অবশ্যই যা লাগবে
প্রথমেই দরকার একটা বাক্স। প্রাথমিক চিকিৎসার সব সরঞ্জাম এক সঙ্গে রাখতে হলে এটা প্রয়োজন। ঘরে অব্যবহৃত মাঝারী সাইজের যে কোনো বাক্সকেই আপনি এ কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। প্লাষ্টিক কিংবা কাঠ যে কোনো কিছু দিয়ে হতে পারে। ঘরে পুরনো ব্রিফকেস কিংবা মেয়েদের পুরনো বিউটি বক্সকেও একাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইচ্ছে করলে মিস্ত্রি দিয়ে বানিয়েও নিতে পারেন। আজকাল ফার্স্ট এইডের সরঞ্জাম রাখার জন্য এক ধরনের বাক্স কিনতেও পাওয়া যায়। চাইলে সেটাও কিনতে পারেন।
 
কি কি রাখবেন?
দশ সে.মি. আকারের জীবাণুমুক্ত ড্রেসিং গজ। এটা দিয়ে ক্ষতস্থান ঢেকে রাখা যায়। দুই ইঞ্চি বা পাঁচ সে.মি. প্রস্থের রোল করা ব্যান্ডেজ গজ। এটা লাগবে ক্ষতস্থান বা ড্রেসিং বেধে রাখার জন্য। এছাড়াও পরিস্কার তুলো। আঠা যুক্ত টেপ। এর কাজ হচ্ছে ক্ষতস্থান বা ড্রেসিং আঠা দিয়ে আটকে রাখা। জীবাণুরোধী দ্রবণ।  যেমন- হেক্সিসোল, ডেটল, স্যাভলন ইত্যাদি। ছোট কাচি। এটা ড্রেসিং গজ ইত্যাদি কাটার জন্য দরকার। ব্লেড অথবা পরিস্কার ছোট ছুরি। যদি সাপে কাটে কিংবা পাগলা কুকুর কামড় দেয় তবে চামড়া চিড়ে বিষ রক্ত বের করার কাজে লাগবে। চিমটা। ত্বকে পোকা মাকড়ের হুল বিধলে অথবা কাঁচের টুকরা ঢুকে গেলে তা এটা দিয়ে বের করা যায়। থার্মোমিটার। রোগীর দেহের তাপমাত্রা মাপার জন্য প্রয়োজন হয়। টিংচার আয়োডিন কিংবা স্পিরিটের বোতল। ক্ষতস্থান জীবানুমুক্ত করার কাজে লাগবে। ওষুধি সাবান। ক্ষতস্থানের ময়লা পরিস্কারের কাজে লাগবে। 

আরও যেসব রাখতে পারেন
ক্যালামাইন লোশন। প্রখর রোদে ত্বক ঝলসে গেলে কিংবা পোকা কামড়ালে অথবা ফুসকুড়ি হলে এটা ব্যবহার করা যায়। কিছু ওষুধ রাখতে পারেন যেমন- প্যারাসিটামল, ডিসপ্রিন। জ্বর কিংবা মাথা ব্যথা কমাবার জন্য। অ্যাণ্টাসিড। অ্যাসিডিটি কমাবার জন্য।  হিস্টাসিন। অনবরত নাক দিয়ে পানি ঝরতে থাকলে তা কমিয়ে দেয়। পেপস কিংবা ম্যাটসিল্স লজেন্স। খুসখুসে কাশিতে গলায় আরাম পাবার জন্য। খাবার স্যালাইন।  শরীরে পানি শূন্যতা, ডায়রিয়া, ডিহাইড্রেশন হলে তা দূর করার জন্য। ক্ষত পোড়া ইত্যাদি ঘা শুকাবার মলম যেমন- নিউবেক্রীন, বার্নল, স্যাভলন ক্রিম ইত্যাদি। এছাড়া সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা মাথা ব্যথা করলে মালিশ করে লাগাবার জন্য মুভ, ভিক্স কিংবা ভেপোরাব, ঝান্ডু বাম, ম্যানথল ইত্যাদিও রাখতে পারেন। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। এটা ত্বক এবং ক্ষতস্থানের ময়লা পরিস্কার করে এবং সামান্য মাত্রায় রক্তপাতও কমাতে সক্ষম। মেডিসিন ড্রপার। চোখে কানে কিংবা অন্য কোথাও ওষুধের ফোটা ঢালতে এটা কাজে লাগবে। আইসব্যাগ। শরীরে অতিরিক্ত তাপমাত্রা কমাতে -এর ভেতর বরফ ভরে রোগীর গায়ে লাগাতে পারেন। সিরিঞ্জ। যদি ইনজেকশান পুশ করার প্রয়োজন হয় তাহলে এটা প্রয়োজন। তবে ইনজেকশান পুশ করার নিয়ম ভালোভাবে জানা থাকা দরকার। যারা ইনজেকশন পুশ করতে পারেন কেবল তারাই এটা রাখবেন। মনে রাখবেন সিরিঞ্জ একবার ব্যবহার হলে তা ফেলে দিতে হয়। কোনো ক্রমেই তা পুনরায় ব্যবহার করতে যাবেন না। চুম্বক। যদি চোখে লোহা জাতীয় কোনো জিনিস ঢুকে যায় তবে এটা দিয়ে তা বের করতে পারবেন। বøাড প্রেশার মাপারযন্ত্র। যারা ব্লাড প্রেশার মাপতে পারেন কেবল তারাই এটা রাখবেন। ডিস্টিল্ড ওয়াটার। ক্ষতস্থানের ময়লা ধুয়ে ফেলার কাজে এটা ব্যবহার করলে ভালো হয়। একটা টর্চ কিংবা ম্যাচ বাক্স। 

কোথায় পাবেন?
প্রাথমিক চিকিৎসার সব সরঞ্জাম এক সাথে পেতে চাইলে আপনি যেতে পারেন মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে মেডিক্যাল স্টোর গুলোতে। এছাড়াও যে সব সায়েণ্টিফিক স্টোর আছে সেখানে কিংবা প্রেসক্লাবের সামনে তোপখানা রোডে বিএমএ ভবনে যেসব মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির দোকান রয়েছে সেখানেও পেতে পারেন। এমনিতে সাধারণ ওষুধের দোকানগুলোতে ওষুধ-ট্যাবলেট, গজ, টেপ, অ্যাণ্টিসেপ্টিক, তুলো খাবার স্যালাইন ইত্যাদি পেয়ে যাবেন। 

কত খরচ পড়বে?
একটা ফার্স্ট এইড বক্স বানাতে কতো খরচ পড়বে তা নির্ভর করছে আপনি কি-কি উপকরণ রাখবেন তার উপর। ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র ছাড়া মোটামুটি বিশ থেকে পাঁচশত টাকার মধ্যে আপনি একটি ফার্স্ট এইড বক্স বানাতে পারেন।

সাবধানের মার নেই
প্রাথমিক চিকিৎসার প্রত্যেকটা সরঞ্জাম পরিস্কার ও জীবাণুমুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক। মাঝে-মাঝে বাক্স খুলে ওষুধগুলো পরীক্ষা করা উচিত। যদি দেখেন কোনো বোতলের পদার্থ ঘোলাটে কিংবা রং বদলে গেছে তবে বুঝে নেবেন এটা নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে এগুলো  ফেলে দেবেন। খেয়াল রাখবেন- ছুরি, বেøড ইত্যাদিতে মরিচা ধরলো কীনা। প্রত্যেক ওষুধের গায়েই মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার তারিখ লেখা থাকে। সেটা অবশ্যই খেয়াল করবেন। কাজটা দু’তিন সপ্তাহ পর-পর করতে পারলে ভালো। অন্তত মাসে একবার অবশ্যই করা উচিত। তা না হলে প্রয়োজনের সময় দেখা যাবে এটা নেই তো ওটা ফুরিয়ে গেছে। তখন আপনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন। ফার্স্ট এইড বাক্সে কখনোই তালা লাগাতে যাবেন না যেনো। কারণ বিপদ তো বলে কয়ে আসেনা। বিপদের সময় এমনিতেই মানুষের সাধারণ কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে যায়। তখন হয়তো দেখা যাবে আপনি চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে আপনার প্রাথমিক চিকিৎসার পুরো আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যাবে।
 
প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান সবারই থাকা দরকার। এজন্য বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। অনলাইনের অ্যাপেও পাওয়া যায় গাইডলাইন। আপনি সেগুলো সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। করোনা গেলে সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে গেলে কিংবা পিকনিকে গেলে জামা-কাপড়, খাবার-দাবার, কোকের ক্যান, ক্যামেরা ইত্যাদির সঙ্গে এখন থেকে একটা ফার্স্ট এইড বক্স নিতে ভুলবেন না কিন্তু। কারণ বিপদ বলে কয়ে আসেনা।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank