বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নারীবিহীন অদ্ভুত দেশ অ্যাথনাইট!

শেখ আনোয়ার

১৭:০৭, ১৮ জুন ২০২১

আপডেট: ১৭:১২, ১৮ জুন ২০২১

২৩৭২

নারীবিহীন অদ্ভুত দেশ অ্যাথনাইট!

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে নারী পুরুষের একসঙ্গে পথচলা। একসঙ্গে জীবন গড়া। নারী কিংবা পুরুষ কেউই এককভাবে সমাজ জীবন কিংবা সংসার পালন, কল্পনা করা যায় না। কোন ব্যক্তির জীবনে নারী নেই, এমন ঘটনা অহরহ ঘটলেও একটি দেশের ভূখন্ড, মানচিত্র, পতাকা, জনগণ সবই রয়েছে কিন্তু কোথাও কোন নারী নেই। এমনটাও কি সম্ভব? 

এমন দেশটি কোথায়?
জী হ্যাঁ। এই সময়েও পৃথিবীতে নারীবিহীন জীবন-যাপন করে বিশ্বের একটি দেশের মানুষ। দেশটির নাম অ্যাথনাইট প্রজাতন্ত্র। গ্রীসের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের শহর সালোনিকি থেকে চার’শ কিলোমিটার পূর্বে এজিয়ান সাগরের বুকে রয়েছে পয়ষট্রি কিলোমিটার দীর্ঘ ও ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত দ্বীপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপদ্বীপ এটি। দ্বীপটির বুক জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু উঁচু-নীচু পাহাড়। পাহাড়গুলো প্রকৃতপক্ষে ৩৩৫ বর্গ কিলোমিটার বা ১৩০ বর্গমাইল এলাকা বেষ্টিত। এই পাহাড়গুলোকে বলা হয় পবিত্র পাহাড়। নাম মাউন্ট অ্যাথোস। এই পাহাড়ের উত্তর সমুদ্রপৃষ্ট থেকে দু’হাজার মিটার উঁচুতেই এই অ্যাথনাইট প্রজাতন্ত্রের অবস্থান। অ্যাথোস দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণে বড় বড় পাথরের উপর নির্মাণ করা হয়েছে খ্রীষ্টান গির্জা। এসব গির্জায় উড়ছে তাদের জাতীয় পতাকা। বর্তমানে এখানে ৫৪ জন পুরোহিতের ঘর রয়েছে। এগুলো সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার উপরে অবস্থিত। 

নারী সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ
ইউরোপ তথা বিশ্বের যাজক শাসিত একমাত্র বড় এলাকার এই দেশটিতে নারী সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি পর্যটকদের সঙ্গে মাদী জীবজন্তু নেওয়াও নিষিদ্ধ। এক হাজার ষাট সালে প্রণীত এক আইন বলে, সেখানে কোনো মহিলা বসবাস করতে বা প্রবেশ করতে পারে না। ওই আইনে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে ‘নো উইমেন্স অ্যালাউড।’ এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে কোনো মহিলার পায়ের ছাপ পড়েনি। এই দ্বীপের আশেপাশেও কোন নারী প্রবেশ করতে পারেনি। শুধু নারী কেনো? কোনো পুরুষ পর্যটকের সঙ্গে যদি মাদী কুকুর বা মাদী বিড়াল থাকে তাহলে সে পর্যটকের ভাগ্যে ওই দেশ সফরের অনুমতি মিলবে না। আইন এমনই কঠোর। ওই আইনের কারণেই সেখানে কোনো গাভী বা ছাগী নেই। ফলে গবাদি পশুর দুধ খেতে চাওয়া সেখানে আকাশ কুসুম কল্পনা। তবে দ্বীপ জুড়ে অনেক বিড়াল দেখা যায়। জানা যায়, অনেক সৌখিন পর্যটক শখ করে বিড়াল সঙ্গে করে নিয়ে যান। আবার কেউবা পুণ্যের আশায় ওখানে বিড়াল রেখে চলে আসেন। তবে সবই পুরুষ বিড়াল। বিড়ালগুলো অবশ্য ওখানে থেকে বেশ কাজের কাজই করছে। দ্বীপের ধারি ধারি ইঁদুর ধরে খেয়ে দেশটির উপকার করছে।

নারী নিষিদ্ধ কেন? 
ড. গ্রাহাম স্পীক রচিত দশম শতাব্দীর প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ ‘মাউন্ট এথোস: রিনুয়াল ইন প্যারাডাইজ’ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে, ‘গির্জা পরিবেষ্টিত দ্বীপটির আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। ক্যাথলিক ও অর্থডক্স বিশ্বাস মতে, মেরি পবিত্র আত্মার অলৌকিক শক্তি দ্বারা কুমারী অবস্থাতেই সন্তানের জন্ম দেন। যীশুর মা হওয়ার জন্য তিনি দৈবভাবে নির্বাচিত হন। কুমারী মা মেরীকে যখন বের করে দেওয়া হয়, তখন তিনি সেন্ট জনকে সঙ্গে নিয়ে জপ্পা ও সাইপ্রাস হয়ে জাহাজে করে লাজারাস যাচ্ছিলেন। জাহাজটা এখানে এসে নষ্ট হয়ে যায়। নাবিকরা নোঙ্গর করতে বাধ্য হন। কুমারি মাতা মেরি তখন এই দ্বীপের এই স্থানটায় একটু নেমে এদিক-সেদিক ঘুরে দেখেন। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মা মেরি আনন্দ ও গর্বে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে তিনি প্রার্থনা করেন- ‘এই দ্বীপ যেনো তার সন্তানের বাগান হয়। এই পুরো দ্বীপটি যেনো কেবলমাত্র ছেলে যীশুর জন্য উৎসর্গ হিসেবে দিয়ে দেওয়া হয়। এই দ্বীপে নারী হিসেবে তিনি ছাড়া তারপরে আর কোন নারীর পদচারণা যেনো না হয়।’ সঙ্গে সঙ্গে দৈববাণী শোনা যায়, ‘এই স্থানটি তোমার বংশের উত্তরাধিকারের জন্য বাগান করে দেওয়া হলো এবং এখানকার বাসিন্দাদের সব নিরাপত্তা আমি দেবো।’ সেই থেকে এই দ্বীপটির নাম হয় ‘গার্ডেন অব দ্য মাদার অব গড।’ আর সেই থেকে মাদী পোষা জীবজন্তু আনা নিষেধ। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৪শ শতাব্দীতে এখানকার গির্জাগুলো প্রতিষ্ঠা করেন পুরোহিত স¤্রাট দিয়োনাইসিয়াস। তিনি এসব গির্জা বাইজেন্টাইন স্টাইলে নিজেই নির্মাণ করেছেন। তবে গির্জার রাশিয়ান কিছু পুরোহিতের ভাষ্য: ‘এগুলো সবই সার্বিয়ানরা প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলো।’ 

কিভাবে বেঁচে থাকে ওরা?
মহিলারা প্রবেশ করতে পারে না শুধু তাই নয়। দেশটির আরও অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রাজনীতি চর্চা নেই। নয়’শ পুরোহিতের হাতে দেশ পরিচালনার ভার। পণ্য সামগ্রী কেনা বেচা হয় না। তাই দোকান পাটেরও কোনো বালাই নেই। গীর্জাগুলো সরবরাহ করে বাসিন্দাদের জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু। সবাই সেখানে গীর্জা প্রশাসনের অধীন। রয়েছে ২০ টি গির্জা। গীর্জায় লাইব্রেরীতে রয়েছে ৮০৪ টি পান্ডুলিপি এবং ৪ হাজারের অধিক মুদ্রিত বইপত্র। এখানে ১১ শ’ শতকের পুরনো পান্ডুলিপিও রয়েছে। সম্প্রতি সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এখানে এখনো মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট তো দূরে থাক টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ নেই। সারাদেশে মোটর গাড়ি রয়েছে মাত্র একটি। গান গাওয়া, গান শোনা, বাজনা বাজানো নিষিদ্ধ। বাসিন্দাদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দেন গীর্জার পুরোহিত। কারও ওপর দায়িত্ব বর্তায় কৃষি কাজের। তারা চাষাবাদ করে, ওষুধী গাছ লাগায়, গির্জায় বাগান করে। কারও ওপর দায়িত্ব পরে কাপড়-চোপড়, পোষাক-আশাক বানানোর। কারও কাজ শুধু মদ তৈরি করা। প্রতিদিন বিকাল ৪ টায় সকলে মিলে এক ঘন্টার জন্য প্রার্থনায় সমবেত হয়। দিনের শেষ খাবার গ্রহণ করে সাড়ে ৬ টায়। তারপর পরের দিনের কাজের প্রস্তুতি নিয়ে চলে যায় যার যার বাড়ি-ঘরে। বাসিন্দাদের অধিকাংশই নিরামিশাসী। তবে মাছ শিকার নিষিদ্ধ নয়। 

কতটা শান্তির দেশ? 
গ্রীস, সাইপ্রাস, রাশিয়া বা আশপাশের অন্যান্য দেশ থেকে জন্মদাতা পিতা-মাতার সম্মতিতেই গীর্জার তত্ত্বাবধানে শিশুদের নিয়ে আসা হয় এখানে। তাই এখানকার বাসিন্দারা কেউ বুঝতে শেখার পর আর কখনো মেয়েদের মুখ দেখার সুযোগ পায় না। গীর্জা থেকে তারা শিক্ষা নেয়, শান্তি, ধৈর্য্য ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। সুদীর্ঘকাল ধরে বাসিন্দারা এই বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করে আসছে। এতোসব অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য সত্বেও এখানকার বাসিন্দারা দারুণ সুখী। তারা বলেন যে, এখানে খাদ্য বস্ত্রের অভাব নেই। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কি জিনিস মানুষ জানে না। এখানে যুদ্ধ নেই, রাজনীতি, সন্ত্রাস নেই। এখানে শুধুই শান্তি। এই তো বেশ আছি। শান্তিতেই আছি।

আপনি কি যেতে চান?
বর্তমানে গীর্জা প্রশাসন বাসিন্দাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভবিষ্যত নিয়ে বড়ই চিন্তিত। এখানে কৌতূহলী পর্যটক, গবেষক, বিজ্ঞানীদের আগমন ও সঙ্গে করে নিয়ে আসা রোগ-ব্যাধির কাছে বাসিন্দাদের পরাজিত হতে হচ্ছে। তাই এখন কেবলমাত্র সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটকদের প্রবেশ ও পর্যটন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আপনি কি দেশটি বেড়াতে যেতে চান? তাহলে দেশটির ট্যুরিস্ট বিভাগে আপনার পাসপোর্টের ১টি জেরক্স কপি আগে-ভাগে জমা দিতে হবে। প্রতিদিন কেবল ১শ জন ধার্মিক ও ১০ জন সাধারন পুরুষ পর্যটক দ্বীপের ২০ টি গির্জার একটিতে মাত্র তিন রাত থাকার অনুমোদন পান। প্রিন্স চার্লস এর আগে দেশটি পরিদর্শন করেছেন। দ্বীপটিতে কিছু রাশিয়ান পুরোহিত বসবাস করে। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লামিদির পুতিন এথেন্স ও গ্রীস সফর শেষে দেশটি সফর করেছেন।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank