অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

রসিক নজরুল 

শারফিন শাহ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮ পিএম, ২৪ মে ২০২১ সোমবার   আপডেট: ১০:১০ এএম, ২৫ মে ২০২১ মঙ্গলবার

নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলে জনমনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার একটা প্রয়াস লক্ষ করা গেলেও তিনি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন দিলখোলা, কোমল ও রসিক। ঘরোয়া আড্ডায়, সাহিত্যের তর্কসভায় কিংবা গানের জমজমাট আসরে তাঁর রসগল্প রামগরুরের ছানার মুখেও এনে দিতো হাসির রেখা। তাঁর মতো মানুষের কাছ থেকেই এজন্য আমরা শুনতে পাই—'আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!'

নজরুলকে ঘিরে বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণা ও গবেষণাপত্রে রসিক নজরুলের খোঁজ মেলে। জানা যায়, নজরুল সওগাত পত্রিকায় 'চানাচুর' শিরোনামে একটি দারুণ রম্য সিরিজ লিখতেন। আর মোহাম্মদী পত্রিকায় লিখতেন 'কাতুকুতু' শিরোনামের সিরিজ। কবি ও রম্যকার তারাপদ রায় তার নজরুল স্মৃতিচারণা 'দে গরুর গা ধুইয়ে'-এ জানান, 'নজরুলের অপ্রকাশিত ব্যঙ্গ রচনা' নামে একটি বইও বেরিয়েছিল ড. সুনিল কান্তি দে'র সম্পাদনায়। যা অনেকেরই অজানা। নজরুল কী পরিমাণ রসবন্ত ছিলেন তা তাঁর 'চানাচুর' রচনার একটি চুটকি থেকেই অনুভব করা যায়—এক বাবার কাছে পাড়ার লোকেরা নালিশ করল, আপনার পুত্র যাকে তাকে শালা ডাকছে! বাবা ছেলেকে শাসিয়ে বললেন, তুমি নাকি যাকে তাকে শালা ডাকছ? পুত্র বলল, কোন শালা তোমাকে একথা বলল?

এরকম বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায় নজরুলের জুড়ি ছিলনা। যে কারও সাথেই তাঁর আলাপ শেষে রসালাপে রূপ নিতো। শান্তি নিকেতনের অধ্যাপক ও লেখক নন্দগোপাল সেনগুপ্তের সঙ্গেও তেমনটা ঘটেছিল। নন্দগোপাল ছিলেন নজরুলের একনিষ্ঠ ভক্ত। সময় পেলেই তিনি নজরুলের ডেরায় ঢুঁ মারতেন, আড্ডা আর গানে মশগুল হতেন। এরই ফোঁকরে কখনো নজরুল খুলে দিতেন তাঁর রসের ঝাঁপি। নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা ছিলেন বৈদ্যকন্যা। নন্দগোপালও ছিলেন বৈদ্য। এ নিয়ে স্ত্রীকে কৌতুক করে নজরুল বলতেন, গোপাল তোমার ভাই, তাহলে বলতো আমার কে? 
নজরুলের উপদেশেই কোন এক বিখ্যাত নেতার লেখা (মাওলানা আকরম খাঁ) মহম্মদ জীবনী পড়েছিলেন নন্দগোপাল। পড়ার পর তিনি নজরুলকে বলেছিলেন, 'অত বড় পণ্ডিত, শেষে কিনা অমন কাঠমোল্লা হলেন?
উত্তরে নজরুল হো হো হেসে বলেছিলেন, কাঠ না, কাঠ না না, অকাঠ মোল্লা। রাজনীতি রে ভাই, রাজনীতি মানুষকে এমন টেনে নামায়! 

সওগাত পত্রিকার সঙ্গে নজরুলের সাহিত্য জীবনের অনেকটা সময় জড়িত। এ পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর সৃষ্টিসত্তার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। সওগাতের সান্ধ্য আড্ডায় নজরুল ছিলেন মধ্যমণি। ফান, পান আর গানের ত্রিমাত্রিক আবহে নতুন মাত্রা পেতো ওই আড্ডা। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের 'সওগাত যুগে নজরুল' গ্রন্থে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কে না জানে নজরুল চা ও পান একটু বেশিই খেতেন। তাই সওগাত অফিসে ও দুটো জিনিস সবসময়ই থাকতো। নজরুল চা এলেই চিৎকার করে বলে উঠতেন, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে।’ এটা ছিল নজরুলের একটা কমিক গানের শিরোনাম। তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে কটাক্ষ করে তিনি এ গান লিখেছিলেন।

একসময় সওগাত মাসিক কলেবর থেকে বার্ষিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। এই খবর শুনে আচমকা সওগাত মজলিসে নজরুল বলে বসলেন, ‘দশ মাস মাসিক বেরিয়ে এখন বার্ষিক বেরোচ্ছে!’

একদিন মফস্বলের কোনো এক গ্রাম ঘুরে এসে সওগাত পত্রিকার মজলিসে বসে নজরুল জোরে হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ‘আল্লারে, বিল্লা এক্করে হাল্ দিয়া উৎকা মাইরা বাইরে পইড়্যা গেছে। আমি জমাইছি মেকুরডা চাইয়া দেহি বিল্লিডা।’ ঘরশুদ্ধ লোক হেসে অস্থির। পরে জানা গেল গ্রামে গিয়ে তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে নাকি রাতে এক কাণ্ড ঘটেছিল। জানালা দিয়ে একটি বিড়াল অন্য একটি বিড়ালকে তাড়া করে লাফ দিয়ে বাইরে গিয়ে পড়েছিল। কী হলো ভেবে বাড়ির একটা লোক গ্রাম্য ভাষায় এই কথাগুলো বলছিল। আর নজরুল তার হুবহ বয়ান করলেন।

পান, গান ও চা নিয়ে নজরুলের আরও কাহিনি আছে। তাঁর একটি বিখ্যাত পানপাত্র ছিল (যেটাকে তিনি নিজেই ‘পানের সিন্দুক’ আখ্যা দিয়েছিলেন)। এই পানপাত্রে একশত পান থাকতো। লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে একসাথে তিন-চারটা পান মুখে পুরতেন আর পিকদানিতে পানের পিক ফেলতেন। একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলের পান খাওয়া দেখে তাঁকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল বললেন, ‘জ্বি না, আমি বেশ্যাসক্ত!’ নজরুলের এমন উত্তর শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। পরে নজরুল ব্যাখ্যা করলেন, পান একটু বেশি খাই তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ  বেশি+আসক্ত=বেশ্যাসক্ত!

নজরুলের গান রচনা আর রেকর্ডের আঁতুড়ঘর ছিল কলকাতার বিষ্ণু ভবন। সেখানে রিহার্সেলস রুমে চা সাপ্লাই করতেন সুধীর নামে এক ব্যক্তি। তার প্রতি হুকুম ছিল প্রতি আধ ঘণ্টা পর পর কবির সামনে ‘হাফ কাপ চা’ রেখে যাওয়ার। এই চায়ের রূপ দুধের স্বল্পতার কারণে কালচে-লাল রঙা ছিল, তাই কবি এর নাম দিয়েছিলেন ‘সুধীর বাবুর বদরক্ত!’

একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডে গান দিতে এলেন এক লোক। লোকটিকে নজরুলের কাছে পাঠানো হলো তার গানের দৌড় পরীক্ষা করার জন্য। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন এবং গান শুরু না করে কথা শুরু করলেন। কার কাছে গান শিখেছেন, কবে তার গান শুনে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতখানি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি। মাঝে একবার কবিকে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, ‘আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবী রাগের গান শুনেছেন? শোনেননি বোধহয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে।’ এইভাবে লোকটি গান না গেয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল। নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।’ ‘কী বললেন?’ ভদ্রলোকটি নজরুলের কথায় বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। নজরুল বললেন, ‘না না অন্য কিছু মনে করবেন না, দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে ‘জানোয়ার’ শব্দটি প্রয়োগ করেছি!’ লোকটি হাঁ করে বসে রইল।

নাম ও নামকরণ নিয়ে নজরুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কিছু হিউমার ছিল। তিনি Aristocrate-এর বাংলা করেছিলেন, ‘আড়ষ্টকাক!’ যারা বক্তৃতা দিতে ভালোবাসতেন তাদের বলতেন, ‘বখতিয়ার খিলজী’, কোনো কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে তিনি বলতেন, ‘জানে দেও কন্ডাক্টর’। তখনকার নূর লাইব্রেরির মঈনুদ্দীন হোসেনকে তিনি বলতেন, ‘রয়টার’। কারণ, হোসেন সাহেব যেকোনো খবর সবার আগে কলকাতার সব পত্রিকা অফিসে দিয়ে আসতেন। নজরুলের বন্ধু ‘মোসলেম ভারত’-এর আফজাল-উল-হককে তিনি ডাকতেন ‘ডাবজল’ বলে। ‘শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাসকে তিনি বলতেন, ‘সজনে ঘণ্ট খাস’। মোহাম্মদী ও সওগাতের দ্বন্দ্ব যখন চরমে, নজরুলকে মোহাম্মদী যখন ‘আজাজীল’ আখ্যা দেয়, তখন নজরুল আকরম খাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘বাগরম খাঁ’। মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে তিনি ডাকতেন ‘বুড়ো’ বলে। কারণ তিনি যুবক হয়েও বুড়োদের মতো যুক্তি-তর্ক ছাড়া কথা বলতেন না। বিজলী ধর নামে কবির এক ভক্ত অটোগ্রাফ নিতে এলে তিনি লিখে দিলেন ‘বি-জলি’। আসলে ‘বি-জলি’ এই কথাটি ইংরেজিতে লিখলে অর্থ হয়, Be jolly অর্থাৎ  হাসিখুশির মধ্যে থাকো!

বাংলা ভাষার অপমান কবি সইতে পারতেন না কোনভাবেই।একজন অ-বাঙালি ভদ্রলোক কবির খুব ভক্ত ছিলেন। কবিকে তিনি অনেক সময় অনেকভাবে সাহায্য করতেন। কোনো একদিন কলকাতায় কবির বাড়িতে কয়েকজন অভ্যাগতর সঙ্গে কবি গল্পগুজব করছেন। সেই অ-বাঙালি ভদ্রলোকও ছিলেন। একসময় তার সাথে কবির হিন্দি বনাম বাংলা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছিল। ভদ্রলোকটি হিন্দি ভাষার জন্য ওকালতি করছিলেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, ‘যাও! যাও! তোমাদের হিন্দি ভাষা তো কুকুর বেড়ালের ভাষা!’ শুনে ভদ্রলোকটি একটু ক্ষুণ্ন হয়ে বলে উঠলেন, ‘কেঁও?’ অমনি কবি বলে উঠলেন, ‘ওই দেখ কুকুরের ডাক ডাকলে!’ ভদ্রলোকটি কবির কথায় রাগ না করে হেসে বললেন, ‘হুয়া হুয়া!’ কবি বললেন, ‘ওই দেখ শিয়ালের ডাক ডাকলে, আমি ঠিক বলিনি?’ উপস্থিত সকলেই এই রসালাপে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লেন।

এমনই রসিক মানুষ ছিলেন নজরুল। যার জীবনে দুঃখ-কষ্টের অভাব ছিল না, আবার হাসি-ঠাট্টারও অভাব ছিল না। বুদ্ধদেব বসু যথার্থই বলেছিলেন, 'কণ্ঠে তাঁর হাসি, কণ্ঠে তাঁর গান, প্রাণে তাঁর অফুরান আনন্দ —সব মিলিয়ে মনোলুণ্ঠনকারী এক মানুষ।'

তথ্যসূত্র:
১.অতীত দিনের স্মৃতি, আব্দুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
২.সওগাত যুগে নজরুল, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
৩. সাহিত্য সংস্কৃতি সময়, নন্দগোপাল সেনগুপ্ত। 
৪. নজরুল স্মৃতি, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
৫. আমার যৌবন, বুদ্ধদেব বসু 
৬. সমকালে নজরুল ইসলাম, মুস্তফা নূরউল ইসলাম