অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

আনন্দ-বেদনার ঈদ

শারফিন শাহ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

প্রকাশিত: ১১:৪০ পিএম, ১৩ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৭:৩৬ পিএম, ১৪ মে ২০২১ শুক্রবার

মানুষে মানুষে যোগে, মমতার আলিঙ্গনে, সুন্দরের জয়গানে মুখর হয়ে আসে ঈদ। মুসলমানদের বৃহত্তম এই উৎসবকে ঘিরে প্রস্তুতির কমতি থাকেনা। ছোট, বড়, ধনী, গরিব,  শিক্ষিত, অশিক্ষিত, জ্ঞানী, মূর্খ সবাইকে সমানভাবে ছুঁয়ে যায় ঈদের আনন্দ। এই এবরোখেবড়ো সমাজে ঈদ আসে তার সাম্য ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে।

খুব ছোট্ট বেলায় আমি ছিলাম ঈদকাতর এক বালক। সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম কখন ঈদ আসবে। কখন নতুন কাপড় পরে মাঠে যাবো নামাজ পড়তে। কখন মজার মজার খাবার খাবো। কিন্তু বয়সটা যখন তরতর করে বেড়ে উঠতে লাগল ঈদের আনন্দটাও তখন ভিন্ন মাত্রা পেল। ঈদ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি দিল মনে। আদতে সবাই কি ঈদের আনন্দ সমানভাবে উপভোগ করতে পারে? সবাই কি ঈদের তাৎপর্য বুঝতে পারে? সবাই কি ঈদানন্দ ছড়িয়ে দিতে পারে?—এসব প্রশ্ন তাড়া করতে লাগল আমাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন লক্ষ করতাম জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত কিছু স্বপ্নচারী যুবকের ঈদ। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে পড়ুয়া বরকত ভাইয়ের কথা আজও মনে পড়ে। নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতেন। বাড়িতে দুই ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচও তার কাঁধে ছিল। প্রতি ঈদে সবাই যখন বাড়িতে চলে যেতো, হলগুলোতে যখন পিনপতন নীরবতা নামতো তখন দেখতাম তিনি টিউশনের বেতন পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন! আর বেতন পেয়েও মুখটা তার কালোই থাকতো। রোজাক্লান্ত শুষ্ক মুখে বকে চলতেন—‘শালা টাকাঅলারা টাকা না থাকার যন্ত্রণা কি বুঝবে? ঈদের আগে একটু বেশি দিলে কি তোদের ভান্ডার ফুরিয়ে যেতো?’ বরকত ভাইয়ের সমস্ত অবয়বে একটা হাহাকারের ছবি ফুটে ওঠতো। আমি ভাবতাম এরকম আরো অনেকের কথা। যারা গাধার মতো খেটে মরে। পরিবারকে, মানুষকে শুধু দিয়েই যায়, কিন্তু বিনিময়ে এদের কপালে জুটে শুধুই অবিচার। ঈদের আনন্দটাও বোধহয় তাই এই শ্রেণির কাছে অধরাই থেকে যায়!

মঞ্জু ভাই আর শিউলি ভাবির গল্প শুনেছিলাম এক বড় ভাইয়ের কাছে। দুজনেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়তেন। ছিলেন দম্পতি-শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, পড়াতেন এবং সংসারও করতেন। একবার ঈদের আগে আগে মঞ্জু ভাইয়ের টিউশনির টাকা পকেট মারা গেল। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কিন্তু তার ভরসা হয়ে দাঁড়ালেন শিউলি ভাবি। নিজের সব টাকা দিয়ে দিলেন স্বামীকে। খাঁটি ভালোবাসা সম্ভবত এভাবেই বিষাদের ওপর আনন্দ ছড়িয়ে দেয়!

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে ঈদের আগে বাড়ি যাওয়ার মধ্যে এক ধরনের বেদনা আছে। কি সেই বেদনা? সেই বেদনার নাম বেকারত্ব। আমাদের দেশটাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে পরিবারের বড় ছেলেদের ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয় অবিবেচকের মতো। পরিবারের কোন বড় ছেলে চাকরি না পেয়ে ঈদে বাড়ি গেলে পরিবার স্বাভাবিকভাবে নিলেও সমাজ নিতে অপারগ। কেউ বুঝেনা, বৈষম্যে ভরা এই দেশে সবার জীবনে চাকরি দ্রুত ধরা দেয় না। কেউ একটু পরে কেউ একটু আগে সফল হয়। অনেক বড়ভাইকে দেখেছি দিনরাত চাকরির জন্য খেটে মরছেন। কেউ চাকরি পাচ্ছেন কেউ পাচ্ছেন না। আমার এক সময়ের অত্যন্ত কাছের আইন বিভাগের তরিকুল ভাইকে দেখতাম বিরামহীন পড়ছেন আর নিজের জীবন নিয়ে বিষন্ন থাকছেন। ঈদের আনন্দ তাকে স্পর্শ করছে না। ঈদে তিনি বাড়ি যাচ্ছেন না। একদিন তিনি যখন জজ হয়ে গেলেন তখন ঈদে বাড়ি গেলেন! পরিবার, সমাজের রাজকীয় সংবর্ধনা পেলেন।

গত এক বছর ধরে মানবজাতি একটা অচিন্তনীয় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। করোনা ভাইরাসের মতো এক বিভীষিকাময় প্রাণঘাতী পরিস্থিতি কেড়ে নিয়েছে ঈদের সারস্বত আবেগ। একটি অদৃশ্য কণার কাছে মানুষের সকল দম্ভের পরাজয় হবে কেই বা ভাবতে পেরেছিল। এই ভাইরাস শুধু মানুষের জীবনই কেড়ে নেয়নি, চোখের সামনে নিয়ে এসেছে মানুষের সকল দীনতা, স্বার্থপরতা, লোভ, কপটতা, শয়তানি, মানুষে মানুষে কত বৈষম্য, কতো ভেদাভেদ তাও স্পষ্ট করে তুলেছে। এত বড় বিপর্যয়ের মুখেও প্রকৃত মানুষের দেখা খুব বেশি পাওয়া যায়নি। সিংহভাগ মানুষই পূর্বের মতো অর্থের পেছনে ছুটেছে! ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে তটস্থ রেখেছে! মানুষ আসলে এমনই অভিন্ন পদার্থে গড়া! 

এতকিছুর পরও ঈদ আসে। ঈদের আনন্দ মানুষকে জাগিয়ে তুলে। এই দিনে তাই সবকিছু ছাপিয়ে আনন্দটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের নবীজীও আনন্দটাকেই সবচাইতে বড় করে দেখতেন। তাই ঈদের দিনে যখন তরুণীরা নাচছিল, গাইছিল তিনি তা শুনে বললেন—'ছেড়ে দাও, ঈদের দিনে এমন আনন্দ হোক না!'(সূত্র: ঈদ মোবারক, ড. এনামুল হক রচনাবলী, চতুর্থ খন্ড,বাংলা একাডেমি)। নবীজী নিজে ঈদের আনন্দ সবাইকে নিয়ে করতেন। যারা নিরাহার, জীর্ণ পোশাকে ঈদ করতেন তাদের তিনি খাবার ও পোশাক দিতেন। রাসূলের ঈদ নামক গল্পে ড. এনামুল হক  এমনটাই জানাচ্ছেন। আমরা চাই আমাদের জীবনে রাসূলের ঈদ নেমে আসুক। সবারই কণ্ঠে বাজুক নজরুলের ‘ঈদ মোবারক’ কবিতার কয়েকটি লাইন—

"ঈদ্-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পিয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও পিয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার।"