অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

যার অভিনয়ে লুকিয়ে থাকতো হাজার অনভূতি

সাদ্দাম হোসেন, কলকাতা থেকে

প্রকাশিত: ১১:২৪ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ১১:২৪ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার

বিশ্বের কৌতুক জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকর্তা রূপে চার্লি চ্যাপলিনের ভূমিকা চিরস্মরণীয়; বিশ্বের চলচ্চিত্রে নতুন দিশা এবং দশা এনে দিয়েছিলেন। কৌতুকের মধ্যে দিয়ে সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা যে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, চার্লি চ্যাপলিন তাঁর রূপক হিসেবে বিশ্বের অন্যতম সৃষ্টি কর্তা ছিলেন। গোটা বিশ্ব তার মুখাভিনয় দেখে অভিভূত হয়েছে বারবার, আর তিনি পেয়েছিলেন এই আখ্যান যে তাঁর চার্লি কস্টিউম কথা বলতো আর দর্শকদের মনে চিরতরে এক গভীর জায়গা তাঁর। চার্লি চ্যাপলিনের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গিমা কথা বলতো যেমন তার হাটা ভঙ্গিমা, চোখের দৃষ্টিকোণ মুখের ভঙ্গিমা, আর এই কথোপকথনে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছানোর শক্তিশালী উপকরণ হিসেবে কাজ করতো। যেখানে কথা বা শব্দের কোনো প্রয়োগ নেই, চার্লি চ্যাপলিন সেইসব নির্বাক ছবি ভাষার ছোট পরিসর পেরিয়ে হয়েছে বিশ্ববন্দিত। হাত পা দিয়ে অভিনয়ের মধ্যে এক অভিনব মনোরঞ্জন এনে দিত দর্শকদের- কথায় আছে 'একটি ছবি হাজার শব্দের কথা বলে'। ঠিক তেমনই চার্লি চ্যাপলিনের মুখাভিনয় এর মধ্যে হাজারটা আবেগ অনুভূতি লুকিয়ে থাকত। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুখাভিনয় অভিনেতা হিসেবে মানুষের কাছে বিশ্বজুড়ে পরিচিত আছেন চার্লি চ্যাপলিন। তাঁর কর্মজীবন এবং ব্যাক্তিজীবন দুটোই মানুষেকে অনুপ্রাণিত করেছে, তিনি একটি সাধারণ পরিবার থেকে এসে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কর্মজীবনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছেন।
 
তিনি ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালউওর্থে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকে শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রঙ্গশালায় অভিনয় করে বেড়াতেন তিনি। নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয় চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা এমনকি পরিচালনার কাজ ও করতেন তিনি। চার্লি চ্যাপলিন তার অঙ্গ ভঙ্গিমায় এবং কস্টিং বিশেষ করে ঢিলেঢালা পোশাক, জোড়া ভ্রু এবং উনার প্রশস্ত মুখখানি এতটাই প্রখ্যাত, যে ওনার নাম বা ওনার ছবির নাম শুনলে সঙ্গে সঙ্গে ওনার এই চমকপ্রদ চেহারাটা মাথায় ভেসে উঠে আর ওনার এই চেহারা মনে হাস্যজ্ঞাপন করে। আর এই হাস্যরস প্রতিটা মানুষের মনে এক আরামদায়ক সুখ ও শান্তির প্রতীক চিহ্ন হিসেবে কাজ করে।

চার্লি তাঁর কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, উনার কাজ ও বাণী মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং শক্তি যোগায় জীবনের সমস্ত বাঁধাবিপত্তির সাথে লড়ে এগিয়ে চলার। উনি বলেছিলেন যে আমি বিশ্বাস করি, যেদিন আমি কোনো কাজ করবো না, সেদিনের রাতের খাবারটা আমার প্রাপ্য নয়।

চার্লির চলচ্চিত্রে দু'ধরনের ভাবনা কাজ করত; এক নিজের জীবন আর অন্যদিকে সমাজে থাকা মানুষের জীবন, দুই চিন্তাধারা মিলিয়েমিশিয়ে তিনি সাধারণভাবে গভীর বার্তা পেশ করতেন।

চার্লি চ্যাপলিন উনার মুখাভিনয় এবং কৌতুক অভিনয়ের জন্য সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে! তাঁর অভিনয়ের সাথে সাথে উনার কস্টিউম আজ এবং চিরকাল বিশ্ব বিখ্যাত থাকবে। তিনি চার্লি চাপলিন নামে বিশ্বে পরিচিতি পেলেও, পুরো নাম চার্লস স্পেন্সর চ্যাপলিন। চার্লি ১৯১৩ সালে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। নির্বাক এবং সবাক সব মিলিয়ে মোট ৮০ টির মত ছবি নির্মাণ করেন। তার তৈরি করা বিখ্যাত চলচ্চিত্র গুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- দ্য কিড, দা গোল্ড রাশ, সিটি লাইটস, সার্কাস,দ্য ওমেন ইন প্যারিস, মডার্ন টাইমস,মঁসিয়ে ভের্দু দ্য গ্রেট ডিক্টেটর, লাইমলাইট, দ্যা কিং ইন নিউ ইয়র্ক ইত্যাদি।এই চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি তৎকালীন সমাজের প্রাসঙ্গিক ঘটনা গুলোকে তুলে ধরেছিলেন যেমন দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ছবিটির মধ্যে দিয়ে এডলফ হিটলার কে ব্যঙ্গ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। শাসক শ্রেণিকে লাঞ্ছিত শ্রেণির কাছে হাস্যকর রূপে তুলে ধরেণ এবং সুনিপুণভাবে বুঝিয়ে দেন যে প্রতিবাদের স্পর্ধা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব। চার্লির বেশির ভাগ ছবি নির্বাক ছিল। সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে মঁসিয়ে ভের্দু (১৯৪৭), দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০), লাইমলাইট (১৯৫২) চলচ্চিত্র মধ্যে দিয়ে একজন শিল্পীর জীবনে ঘটে যাওয়া ব্যর্থতা ও যন্ত্রণাগুলো কে ফুটিয়ে তুলছেন এবং তার সবথেকে বড় উদাহরন ছিল লাইমলাইট ছবিটি। এই ছবিটি সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতের জন্য প্রখ্যাত অস্কার পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

আজকের কঠিন বাস্তব যেখানে প্রাণখোলা হাসি আনন্দের ভীষণ প্রয়োজন; এই গম্ভীর বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে করোনার মত মহামারী চারিদিক দুঃখ আর ত্রাসে ভরিয়ে রেখেছে, উনার এই নির্বাক চলচ্চিত্র এবং মূকাভিনয় সেখানে আমাদের আজকের দুশ্চিন্তামগ্ন জীবনে কৌতুক আর বিনোদনের যোগান দেয়। চার্লি চ্যাপলিন হলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা একধারে তিনি অভিনেতা, নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অন্যদিকে বিখ্যাত সুরকার হিসেবে অবিস্মরণীয় | অভিনয় জগতে প্রতিটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং জীবনে কে শিখতে ও অনুভব করতে সাহায্য করবে চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলো। তাঁর নক্ষত্র পতন ঘটে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে।

সাদ্দাম হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগ, নেতাজি নগর কলেজ, কলকাতা, [email protected]