অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৭

খ ম হারূন

প্রকাশিত: ১২:২৫ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৮:০৬ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
 

[পর্ব-২৭]

২২ মার্চ ২০২১, দিল্লি থেকে সংযুক্তা চক্রবর্তী ফোন করে জানতে চাইলো মহসীন ভাইয়ের কথা। এস এম মহসীন। বললো, তাদের ছবির কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই প্যানডেমিকের মাঝেও ধীরে ধীরে তারা কাজ করছে। মহসীন ভাই কবে থেকে সময় দিতে পারবেন তা জানতে চায়। সাথে সাথেই আমি মহসীন ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করলাম। উনি ধরেই স্বভাবসুলভ হাসি। বললাম, ‘মহসীন ভাই দিল্লি থেকে ফোন এসেছে, আপনি কবে ওদের সাথে কথা বলবেন জানতে চাইছে।’ বললেন, ‘হারূন আমিতো এখন পাবনায়। একটা ছবির শ্যুটিংয়ে এসেছি। ফিরে এসেই ওদের সাথে কথা বলবো, তোমরা সাবধানে থেকো।’ মহসীন ভাই আবার স্যুটিং করছেন এই মহাদুর্যোগের মাঝে? ‘কি করবে বলো, কতোদিন আর ঘরে বসে থাকা যায়। তুমি চিন্তা কোরোনা, আমার অসুবিধা হবে না।’

এর আগে ২০১৯ এর আগষ্টে দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনে কর্মরত প্রেস মিনিস্টার ফরিদ হোসেন হঠাৎ ফোন করে আমাকে সংযুক্তা চক্রবর্তী’র সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফরিদ টেলিফোনে বলে, ‘ওরা একটা ছবি বানাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তিন বিপ্লবী বিনয়, বাদল, দিনেশের উপর। দিনেশ গুপ্ত মুখ্য চরিত্র। পরিচালক ভারতের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত একজন তরুন, কলকাতার মানস মুকুল পাল। সংযুক্তা ঐ টিমেরই একজন। মানসের বন্ধু, দিল্লিতেই থাকে। মানস আগামী মাসে ঢাকা যাবে ছবির লোকেশন দেখতে। স্ক্রিপ্টেরও কিছু কাজ বাকি। তুমি একটু সহযোগিতা করতে পারলে ভালো হয়।’ সেপ্টেম্বরে ছবির পরিচালক মানস মুকুল পাল তার সিনেমাটোগ্রাফার সহ ঢাকা আসেন। আমি তাদের অফিসার্স ক্লাব রেষ্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করে দেই। সেখান থেকে একটা মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, মুন্সিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, যশোর, সাতক্ষীরা ঘুরে বেড়ায়। যে সব জায়গায় বিপ্লবী দিনেশ গুপ্তের অবস্থান ছিলো ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে। তারা মহসীন ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়। মহসীন ভাইকে এই ছবির একজন কনসালটেন্ট হিসেবে রাখার ইচ্ছা পোষন করে। মহসীন ভাইও সম্মত হন। কথা ছিলো ২০২০ এর এপ্রিলে তাকে কলকাতা যেয়ে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। কিন্তু প্যানডেমিক শুরু হয়ে যাবার কারনে পরিকল্পনা মতো কাজ এগুলো না। মানস মুকুল অবশ্য নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। এখন আবার তিনি প্রডাকশনের কাজ শুরু করতে চান। 

কিন্তু এদিকে যা হবার তাই হলো। মহসীন ভাই পাবনায় তার শুটিং স্পটেই করোনায় আক্রান্ত হন। তারপর হাসপাতাল। তারপর চিরবিদায় ১৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে। পেলেন রাষ্ট্রীয় সম্মান- গার্ড অব অনার। 

একটা সময় ছিলো। ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী’ ছিলো আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল। ১৯৭৯ সালে যখন দিল্লি থেকে ঢাকা ফিরে আসি তখন সময় কাটানো এবং কাজে বা অকাজে আড্ডা দেবার জন্য যখন তখন হাজির হতাম শিল্পকলায়। বিটিভিতে প্রযোজক পদের চাকুরীর আবেদনপত্রও তৈরি করেছিলাম সেখানে বসে। শিল্পকলা একাডেমীর প্রধান আকর্ষণ তখন মহসীন ভাই। তিনি ১৯৭৭ এ এনএসডি থেকে ফিরে প্রথমে তার নিজ কর্মস্থল বাংলা একাডেমীতে যোগ দেন, তারপর ১৯৭৮ সালে শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যকলা বিভাগে উপপরিচালক পদে নিয়োগ পান। সে সময়ে নাট্যকলা বিভাগের পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও সংবাদ উপস্থাপক মজিবুর রহমান পাঠক। নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক। একই বিভাগের উপপরিচালক ছিলেন কবি আল মাহমুদ এবং সহকারী পরিচালক শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ। শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিলেন চারুকলা বিভাগের পরিচালক, আর উপপরিচালক ছিলেন শিল্পী সুবীর চৌধুরী। সঙ্গীত ও নৃত্য বিভাগের পরিচালক ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম সংগঠক শহিদুল ইসলাম এবং উপপরিচালক আমিরুল ইসলাম বুলবুল। 

আমার দু’জন বন্ধুও তখন শিল্পকলায় সদ্য যোগদান করেছেন। একজন বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী শফি কামাল এবং আরেকজন বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী বাবুল রশিদী। দুজনেই তখন সহকারী পরিচালক। সে সময় জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন এবিএম সালাহউদ্দিন। পরবর্তিতে এরশাদের শাসন আমলে পারফর্মিং আর্টস একাডেমী (যার নির্বাহী পরিচালক ছিলেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনেয়ার) বিলুপ্ত হয়ে যাবার পর সে প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা ও শিল্পীবৃন্দ এক সরকারি আদেশে যোগদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। সেই সময় জিনাত বরকতুল্লাহ ও ওস্তাদ ওমর ফারুক সঙ্গীত ও নৃত্য বিভাগে যোগ দেন।  

সুতরাং ঐ সময়ে শিল্পকলা একাডেমীর পরিবেশ ছিলো অনন্য সাধারন। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল পরিবেষ্টিত। ১৯৭৯ তে ঢাকা ফিরে কি করবো কিছুই জানিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যচক্র, সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমী আর মাঝে মাঝে শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরীতে অবস্থিত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাঈদ আহমদ এর অফিসে যেতাম। সঙ্গী হতেন সৈয়দ মহিদুল ইসলাম, যিনি ১৯৭৬ সালে এনএসডি থেকে তার ডিগ্রী সম্পন্ন করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ব্যতিক্রম’ নাট্য গ্রুপ। ১৯৭৯ সালে তিনিও দেশে ফিরে এসে ঢাকায় ‘ব্যতিক্রম’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। 

নাট্য নির্দেশক জামিল আহমেদও তখন ঢাকায় ফিরে এসেছেন। মহসীন ভাই আমাদের দু’জনকে নিয়ে বেশ কটি নাট্য ওয়ার্কশপের পরিকল্পনা করলেন। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে। ঢাকার বাইরে খুলনায় আমি দুটি ওয়ার্কশপ পরিচালনা করি, ঢাকাতে তো বেশ কয়েকটা। অনেক ক্লাসও নিতে হতো। কাজ ছাড়াও যখন তখন শিল্পকলায় উপস্থিত হতাম গরম সিঙারা আর চা খাবার প্রত্যাশায়। প্রথমেই ঢুকতাম মহসীন ভাইয়ের রুমে। এক এক করে হাজির হতেন বাবুল রশিদী, শফি কামাল, সুবির চৌধুরী। পরবর্তিতে যুক্ত হলেন গোলাম সারোয়ার ও উদয়ন বিকাশ বড়ুয়া। নাট্যাঙ্গনের অনেকেরই নিয়মিত আড্ডার স্থান তখন মহসীন ভাই এর কক্ষ। 

১৯৮৯ ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন বাংলা একাডেমীর বইমেলা ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যাই ‘শেষ নবাব’ সাইদ আহমদ এর সদ্য প্রকাশিত নাটক। দুটি বই সংগ্রহ করি। রাতেই বইটা পড়ে ফেলি। সিদ্ধান্ত নেই ‘শেষ নবাব’ মঞ্চস্থ করার। সকালে বিটিভিতে যাবার পথে মহসীন ভাইয়ের অফিসে গেলাম। তিনি তখন নাট্যকলা বিভাগের পরিচালক আর বাবুল রশিদী উপপরিচালক। মহসীন ভাই বইটির পাতা উল্টিয়েই আমাকে প্রস্তাব দিলেন ‘শেষ নবাব’ নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ কেন্দ্রিক প্রডাকশন করার। আমাকে বাজেট তৈরী করতে বললেন। বাবুল রশিদীর রুমে বসে প্রপোজাল ও বাজেট প্রস্তুত করে তা পরিচালক মহসীন ভাইয়ের হাতে দিয়ে দিলাম এক ঘন্টার মধ্যে। তিনি দেখে বললেন প্রস্তাব গ্রহনযোগ্য তবে টাকা পয়সা একটু কম করে খরচ কোরো। আমি বললাম, সে দেখা যাবে। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে একাডেমীর মহাপরিচালক আনিসুল হক চৌধুরীর রুমে গেলেন। অসাধারন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। পরবর্তিতে তাকে বিটিভির মহাপরিচালক হিসেবেও পেয়েছিলাম। মহাপরিচালক আনিসুল হক চৌধুরী আমাকে নাটকটি মঞ্চায়নের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করে প্রস্তাবটি হাতে হাতে অনুমোদন করে দিলেন। আরো বললেন, কোনো সমস্যা হলেই যেনো আমি সাথে সাথে তার কাছে চলে আসি।

পত্রিকা এবং বিভিন্ন নাট্যদলে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলী নির্বাচন করা হলো। তারপর চললো পাঁচ সপ্তাহের কর্মশালা। প্রতিদিন বিকেলে কর্মশালা শুরু হতো পাবলিক লাইব্রেরির একটি হলঘরে। প্রথম ক্লাস হতো ইয়োগা এবং বডি ফিটনেসের উপর। মহসীন ভাই শুধু অভিনয় নয়, তিনি  ইয়োগাতেও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। নিজে ইয়োগা করতেন এবং অন্যদেরও ধরে ধরে ইয়োগা করতে উৎসাহ দিতেন। কর্মশালার এক পর্যায়ে স্ক্রিপ্ট নিয়ে রিহার্সেল শুরু করা হলো। অংশগ্রহনকারীদের মধ্য থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী, সেট ডিজাইনার, লাইট ডিজাইনার, স্টেজ ম্যানেজার, সহ-নির্দেশক, সহকারী সঙ্গীত পরিচালক নির্বাচন করা হলো। ২৬ টি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমি প্রধান প্রশিক্ষক ও নির্দেশক। অন্যান্য প্রশিক্ষকবৃন্দ ছিলেন - নাট্যকার সাঈদ আহমদ, এস এম মহসীন, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, শর্মীলা বন্দ্যোপাধ্যায়, কামরুজ্জামান রুনু, গোলাম সারোয়ার ও আমিনুর রহমান নিঝু। 

‘শেষ নবাব’ নাটকে একটি মাত্র নারী চরিত্র ছিলো, ঘসেটি বেগম। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলো নাহিদ ফেরদৌস মেঘনা। সিরাজদ্দৌলা চরিত্রে তৌকির আহমেদ। তৌকির ও মেঘনা তখন ‘থিয়েটার’ গ্রুপের নাট্যকর্মী। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্রে - শাহজামাল তোতা (রাজবল্লভ), কাজী আমিনুর (জগৎশেঠ), জিয়াউল ইসলাম (মীর জাফর), ইকবাল হোসেন (রায়দুর্লভ), হাবিবুল ইসলাম হাবিব (মোহনলাল), আব্দুল বারেক মুকুল (মীর মার্দান), শহিদুল আলম সাচ্চু (রবার্ট ক্লাইভ), জিকরুল হাসান বাবলু (আয়ার কুট), জি এম ফারুক (কিল্ প্যাট্রিক)। এই নাটকের ওয়ার্কশপে যারা অংশগ্রহন করেছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই মঞ্চের নেপথ্যে সেট, লাইট, কসটিউম, প্রপস, মেকআপ, আবহ সঙ্গীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করেছিলো। যেমন- মনিরা বেগম মেমি, সাইফুল ইসলাম, নাফিসা জাহান, শওকত আরমান, তারেক মিন্টু সহ অনেকেই। আর নাটকের সহ-নির্দেশক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী সীনা আক্তার। 

১৯৮৯ সালের পলাশী দিবসে (২৩ জুন) নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয় শিল্পকলা একাডেমীর বিশাল অস্থায়ী মঞ্চে। দর্শক হিসেবে সেখানে অনেক গুণী ব্যাক্তিই উপস্থিত ছিলেন। 

আমি যখন এনএসডি’র ছাত্র, সে সময়ে ১৯৭৮ সালে সাঈদ আহমদ এসেছিলেন দিল্লিতে। তিনি তখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। এনএসডি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন আমাদের সাথে পরিচিত হতে। জামিল আহমেদ তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সে সময়ে হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন জামিল বিয়ে করে তার এক বছরেরে সিনিয়র মমতাকে। মমতা তখন এনএসডি থেকে গ্রাজুয়েশন করে ‘আকাশবাণী’তে চাকুরী পেয়েছে। বিয়ে করার পর তারা এনএসডি’র কাছাকাছি একটি আলাদা বাসা নেয়। জামিল ও মমতা সাঈদ আহমদ সহ আমাদের (তারিক আনাম, সালেক খান সহ বাংলাদেশের কয়েকজন) ত্রিভেনী কলাকেন্দ্রের ক্যাফেটারিয়ায় দুপুরে খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে খেতে খেতে সাঈদ ভাই তার আগামী নাটক লেখার প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন। তিনি মুলত সে সময় নবাব সিরাজদ্দৌলা’র উপর লেখা ইতিহাস, প্রবন্ধ, ছবি- এসব নিয়ে গবেষনা করছেন। 

সেই ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮, এই দশ বছরে তাঁর লেখা সম্পন্ন হয় এবং ১৯৮৯ সালের বইমেলাতে ‘শেষ নবাব’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী বইটি পুন:প্রকাশ করে আমার নির্দেশনার সকল তথ্য সহ। কবি শামসুর রাহমান ‘শেষ নবাব’ নাটক দেখতে এসেছিলেন। পরে তিনি একাডেমী কতৃক প্রকাশিত বইটির জন্য পাঁচ পৃষ্ঠার একটি মুখবন্ধ লিখেছিলেন নাটকটি সম্পর্কে। শামসুর রাহমান এর কিছু কথা এখানে উল্লেখ করলাম। “সাঈদ আহমদ তাঁর পূর্ববর্তী নাট্যকারদের পথ মাড়াননি। কোনো রকম বাহুল্য কিংবা ফ্যান্টাসিকে প্রশ্রয় দেননি। গিরীশচন্দ্র ঘোষ এবং শচীন সেনগুপ্ত উভয়েই সিরাজদ্দৌলার চরিত্রের গাম্ভীর্য পুরোপুরি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। কিন্তু সাঈদ আহমদ বাংলার শেষ নবাবের চরিত্রের গম্ভীর রূপটি সৃষ্টি করেছেন বিশ্বস্তভাবে, নাটকের কোনো অংশেই সিরাজদ্দৌলাকে লঘু কিংবা চটুল চিত্তের মনে হয়নি।” তিনি আরো বলেছেন “অপ্রয়োজনীয় চরিত্রগুলোকে ছেঁটে বাদ দিয়েছেন সাঈদ আহমদ। সে মাত্র একটি নারী চরিত্রের অবতারনা করেছেন ‘শেষ নবাব’-এ। ঘসেটি বেগম তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্বে অত্যন্ত জীবন্ত, শক্তিশালী চরিত্র, নাটকের জন্য অপরিহার্য।”

বইটিতে নাট্যকার সাঈদ আহমদ লিখেছেন, “কবিবন্ধু শামসুর রাহমান, আতাউর রহমান, আলী যাকের, সৈয়দ মহিদুল ইসলাম আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। হাবীব তানভীর (দিল্লি), নিউইয়র্কের পারফরমিং আর্টস জার্নালের সম্পাদকদ্বয় গৌতম দাশগুপ্ত ও বর্ণি মারাক্কা নাটকটি লেখার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল থিয়েটারের নির্বাহী পরিচালক আমার বন্ধু ডন মারফি আমাকে নানা পরামর্শ দিয়ে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।” তিনি আরো লিখেছেন, “১৯৮৯ সালে পলাশী দিবসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রযোজনা কেন্দ্রিক থিয়েটার ওয়ার্কশপে প্রথম মঞ্চায়িত হয় এই নাটক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশিষ্ট মেধাবী প্রযোজক খ ম হারূন ছিলেন সেই প্রথম মঞ্চায়নের সফল নির্দেশক।”

আমি সব সময় মনে করি ‘শেষ নবাব’ এর সফল মঞ্চায়ন এবং প্রডাকশন স্ক্রিপ্টটি বই আকারে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশ করার কৃতিত্ব কিন্তু সে সময়ের নাট্যকলা বিভাগের পরিচালক এস এম মহসীন এর। বইটি প্রকাশিত হবার পর তিনি একদিন আমাকে শিল্পকলায় আমন্ত্রণ জানিয়ে দুটি কপি আমার হাতে তুলে দেন। নিজ হাতে লেখেন, “রচনা যে কোন কর্মের মূল উৎস। তবে নাটকের ক্ষেত্রে রচনাকে যিনি মঞ্চরূপ দেন, তিনি নির্দেশক, তিনি রূপকার। ভূমিকা তাঁর হয়ে ওঠে অনন্য। তাই এক্ষেত্রে হারূনই প্রধানতম। একাডেমীর নাট্যকলা বিভাগের অশেষ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা তাঁর প্রতি।”

এস এম মহসীন যে দীর্ঘ সময় শিল্পকলা একাডেমীতে কাজ করেছেন, সব সময় চেষ্টা করেছেন নাটক নিয়ে বড় কিছু করতে। অত্যন্ত সৎ ও সহজ সরল জীবন যাপন ছিলো তাঁর বৈশিষ্ট। আজকে যে জাতীয় নাট্যশালা তৈরী হয়েছে তার প্রকল্প পরিচালক ছিলেন তিনি। বিশাল এক দায়িত্ব অত্যন্ত সততা ও সফলতার সাথে শেষ করে ২০০৫ সালে তিনি অবসর গ্রহন করেন। চাকরী থেকে অবসর নিলেও তিনি কখনো কাজ থেকে অবসর নেন নি। অভিনয় করে গেছেন বিভিন্ন নাটকে, চলচ্চিত্রে। ২০২০ সালে নাটকের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছিলেন তিনি। 

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১