অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ওয়েব সিরিজের হাইপ: দুই মাস্টারমাইন্ড প্রফেসর

রাজীব নন্দী

প্রকাশিত: ১০:০৫ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ১০:১৬ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

চলমান করোনা সংক্রমণে সমাজ অবরুদ্ধ। লকডাউনে গৃহবন্দি নিস্তরঙ্গ অবসাদের জীবন। বাইরে যখন ওত পেতে আছে করোনা ভাইরাস, তখন বন্ধ রেস্তরাঁ, সিনেমা হল। নেই নতুন সিনেমা, টিভি সিরিয়ালেও ভাটা। এই বোরিং কোয়রান্টিন কাটাতে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা নেটফ্লিক্স, হটস্টার, ইউটিউব, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই, আড্ডা টাইমসের বাজার বাজিমাত করা ওয়েব সিরিজ, সিনেমা ও ডকুমেন্টারি রিভিউ নিয়ে অপরাজেয় বাংলার নতুন এই আয়োজনে আপনিও সাথে থাকুন।

করোনাকালে গোটা বিশ্বের সিনেপ্রেমী মানুষ নাকি ডুব দিয়েছে ওয়েব সিরিজে। নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন অন্তত তাই বলছে। এর মধ্যে তুমুল আলোচনায় আছে দু’টি ওয়েবসিরিজ, যথা- La CaSa De PaPeL বা  Money Heist এবং Breaking bad। যদিও সিরিজ দু’টি প্রচারিত হয় করোনা সংক্রমণের বহু আগেই। কিন্তু লকডাউনে মানুষের গৃহবন্দী জীবনে এই দু’টি ওয়েব সিরিজ কিছুটা হলেও বিনোদন দিয়েছে। সম্প্রতি আমি দু’টি ওয়েব সিরিজই দেখে শেষ করেছি। সিরিজ দেখে শেষ করে রেশ থাকতে থাকতে দু’টি সিরিজের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ মাথায় দানা বাঁধছে। সেই ভাবনা শেয়ার করতেই ধারাবাহিক লেখার অবতারণা। আজ রইলো প্রথম পর্ব।

‘ব্রেকিং ব্যাড’ সিরিজটি সাম্প্রতিক লকডাউনে দেখছি, এখন শেষের পর্যায়ে আছি। ‘মানি হায়েস্ট’ দেখেছিলাম গত বছর (২০২০) লকডাউনে, করোনা সংক্রমণের শুরুতেই। দুই লকডাউনে দুই লম্বা সিরিজ (প্রায় ৯০ ঘণ্টা) শেষ করতে গিয়ে কিছুটা মিশ্র অনুভূতি হয়েছে। যদিও মানি হায়েস্ট সিরিজটি এখনো শেষ হয়নি। কারণ এর পঞ্চম বা শেষ পর্বের সিরিজের শুটিং এখনো চলছে, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ মুক্তি দেয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ‘মানি হায়েস্ট’ নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানো যাচ্ছে না আপাতত।

‘ব্রেকিং ব্যাড’র শুরুতে মারাত্মক বোরড ছিলাম। কোন সাসপেন্স নেই, স্লো একটি কাহিনী। এমনকি  ক্যারেক্টারগুলির মধ্যেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না তেমন কোন ইউনিকনেস। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালে বসে আমেরিকার প্রত্যন্ত এক অঙ্গরাজ্যের কাহিনী এটি। শুধুমাত্র একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই আগায় এই  সিরিজটি, ফলে কাহিনী যেন অহেতুক লম্বা হয়ে যায়। এমনকি এক-একটি দৃশ্যও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বড় ব্যাপ্তিজুড়ে দেখানো হয়েছে। ফলে যেখা‌নে ৫০ মিনিটের এক একটি এপিসোড, সেটিকে ছেঁটে ১৫ মিনিট করা যেতো আর এটা হলেই সিজনে হয়তো গতি আসতো।

এই সিরজটিতে দেখা যায়, এক্সপেরিমেন্ট করতে করতেই আমেরিকার এক কেমিস্ট্রি প্রফেসর নিষিদ্ধ মাদক (মেথ) তৈরি করলেন। এমনকি ধীরে ধীরে তিনি সেই মাদকের বিজনেসেও জড়িয়ে পড়ছেন। মূল চরিত্রটির নাম ওয়াল্টার হোয়াইট, সাথে তার এক শিক্ষার্থী জেসি পিন্কম্যান। ৫টি সিজনে মোট ৬২টি পর্ব, প্রতি পর্ব ৫০ মিনিটের করে। আমার কাছে মনে প্রথম তিন সিজন পর্যন্ত মনে হয়েছে এটি ওভার হাইপ একটি সিরিজ। এমনকি আমার যেসব শিক্ষার্থী ও ফেসবুক বন্ধুরা আমাকে ব্রেকিং ব্যাড দেখতে উৎসাহ দিয়েছে, তাঁদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে দেখলাম ওরাও খুব অলস সময় কাটাতে ভালোবাসে, তাই আমার হাতে যেহেতু এখন কিছুটা অলস সময়; আমিও ডুব দিলাম এই সিরিজে।

প্রথম দুইটি সিজনে সৃজনশীল কিছু পাইনি আমি, বরং 'মেথ' বানানোর মতো বারবার একটি জিনিসকেই বারবার সামনে এনে সিকোয়েন্স বড় করা হয়েছে। আরো একটি বিষয় আমাকে খুব হতবাক করেছে, ‘অপরাধী’ ধরার এত নিত্য-নতুন কৌশল আমেরিকায়, সেখানে একজন কেমিস্ট্রির প্রফেসর দিনের পর দিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেথ বানিয়ে পৃথিবীর মাদক ব্যবসার সমীকরণ বদলে দিচ্ছে, এটি কিছুটা বিরক্তিকর। কিন্তু চতুর্থ সিজনের পর আমার ধারণা ভুল হতে থাকে। একেবারে যাকে বলে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে সিরিজে ডুব দিতে হয়। মাদকের চোরাগলি পেরিয়ে বৈশ্বিক মাদক ব্যবসার ভিত নাড়িয়ে দেয়া একটি কাহিনীর সাথে পরিচিত হই। একজন সাধারণ ছা-পোষা জীবনের শিক্ষক, যার একটি সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে সুখে জীবন কাটানোর কথা, তিনি কেন এই পথে গেলেন? প্রফেসর ওয়াল্টারের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়লে পুরো সিজনের গতিমুখ পাল্টে যায়। ‘যেকোন মূল্যে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হবে’ এই ধারণাটি প্রফেসর ওয়াল্টারকে বদলে দিতে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে সিরিজ। প্রফেসর ওয়াল্টারন হোয়াইটের সাথে জুড়ে থাকে গবেষণা সহকারী জেসি পিংকম্যান, ওয়াল্টারের স্ত্রী স্কাইলার হোয়াইট, শ্যালিকার স্বামী শ্রেডার (যিনি আবার স্থানীয় মাদক নির্মূল কেন্দ্রের পুলিশ অফিসার!), আইনজীবী সল গুডম্যান এবং মাদক সম্রাট গুস্তাভো ফ্রিং। 

‘মানি হায়েস্ট’ সিরিজটি দেখার পর একবুক আশা নিয়ে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ দেখলে কিছুটা আশাহতই হতে হবে। কারণ, মানি হায়েস্টে পারস্পরিক কমিউনিকেশন স্কিলগুলো আপনাকে স্ক্রিন থেকে ঘাড় ফেরাতে দিবে না, টানটান উত্তেজনা আপনাকে এপিসোড শেষ হতে আরেক এপিসোডে নিয়ে যাবে । কিন্তু 'ব্রেকিং বেড' দেখতে দেখতে আপনি অনায়াসে ঘরের আরো দশটি কাজ করতে পারবেন। মানি হায়েস্ট সিরিজটি পুরো দুইবার দেখেছি, মনে হচ্ছে এই সিরিজে বুদ্ধির খেলা, নেতৃত্ব, পারস্পরিক যোগাযোগ কৌশল, রোমান্স, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, হিউমার সবকিছুর সন্নিবেশ রয়েছে। যা ব্রেকিং ব্যাডে আমি পাইনি। যদিও পাবো বলে কেউ আমাকে দোহাই দেয়নি বা পাওয়ার আশা করাটা বোকামি।

মানি হায়েস্ট সিরিজের মূল বক্তব্য- এক মাস্টার মাইন্ড প্রফেসর তার ৮ জন ছাত্র (সঙ্গী) নিয়ে দুর্ধষ দু’টি ডাকাতির অভিযান। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ডাকাতি। লুট হবে স্পেনের টাকশালের টাকা ও ব্যাংক অফ স্পেনের স্বর্ণ। যে প্রফেসরের মূল পরিকল্পনায় এই ডাকাতি নাম তার সার্জিও মারকিনা। সার্জিওর পর বার্লিন চরিত্রটির ক্ষিপ্রপ্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সিরিজের মুখ্য চরিত্ররা যথাক্রমে: প্রফেসর, লিসবন, টোকিও, হেলসিঙ্কি, রিও, নাইরোবি, স্টকহোল্ম, গান্দিয়া, আর্তুরো এবং বার্লিন। রুদ্ধশ্বাস দুটি ডাকাতি; একটি স্পেনের টাকশালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় টাকা চুরি এবং অপরটি হলো স্বর্ণ চুরি। স্পেনের রয়্যাল মিন্ট থেকে টাকা চুরি, যেন তেন অংক না, একে বারে ২.৪ বিলিয়ন নিয়ে পালিয়ে যাবে পুরো আট জনের দল! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সিরিজটি দেখতে দেখতে মনে হবে "ইশ ডাকাতরা যেন ঠিকঠাকভাবে চুরিটা করতে পারে।" ডাকাতির পুরো পরিকল্পনা প্রফেসরের হলেও তিনি নিজে কিন্তু ডাকাতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন না। বরং বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকে পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এবং তিনি অবিশ্বাস্যভাবে সফলও হন!

মানি হয়েস্ট এবং ব্রেকিং ব্যাড, এই দু’টি সিরিজই দর্শকদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ ফেলে। সেটি হলো- দর্শক হিসেবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বসলেও সিরিজে আপনি কোন না কোন ডাকাতের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়তে বাধ্য। প্রফেসর ওয়াল্টার যে মাদক বানাচ্ছে, আপনি তার প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য। কারণ, তার মাদক সাম্রাজ্যে ঢোকার একটি মানবিক কাহিনী আছে পেছনে। ঠিক একইভাবে প্রফেসর সার্জিও মার্কিনা কেন এভাবে ব্যাংক লুটের মতো কল্পনাবিলাসী অপরাধে পা দিলো, তার পেছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিদীপ্ত মানবিক কাহিনী। দুই প্রফেসরই আমেরিকা ও স্পেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

মানি হায়েস্ট শুধুমাত্র ক্রাইম জঁরার সিরিজ নয়, বরং ক্রাইমের পরতে পরতে রোমাঞ্চকর দু’টি অভিযান আর বুদ্ধিদীপ্ত কয়েকটি লড়াইয়ের গল্প। যদিও প্রফেসর সার্জিও মার্কিনার বিপরীতে প্রফেসর ওয়াল্টারকে নিষ্প্রভ মনে হয়। ওয়াল্টার যেন কামলাকাটা দিন মজুরের মত পুরো সিরিজে মেথ বানানোর মতো একঘেয়ে কাজ করে যায় দিনের পর দিন! কিন্তু প্রফেসর সার্জিও মার্কিনা সবাইকে এক করে ফেলতো, তিনি দলগত প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতো, ছিলেন যৌথতার বিশ্বাসী ছিলেন। একজন প্রফেসরের কি আসলেই তাই হওয়া উচিত? সমাজবিদ্যা বলছে, হ্যাঁ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে একজন প্রফেসর তার গোপন টিম নিয়ে হৈচৈ ফেলে দিবেন। প্রফেসর যেমন তার দলের সকল সদস্যের জন্য মাস্টারপ্ল্যান ঠিক করে রাখবেন, তেমনি দলের সদস্যরাও তার নেতৃত্ব মেনে চলবে। কিন্তু সমাজবিদ্যা যেমন একজন প্রফেসরকে যুথবদ্ধ করে তুলে তেমনি রসায়ন বিদ্যা একজন প্রফেসরকে অন্তর্মুখী করে তুলবে। ল্যাবে মনযোগ দিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ডুব দেয়াই একজন বিজ্ঞানীর কাজ। তাই প্রফেসর সার্জিওকে দেখি আমরা বুদ্ধির কৌশল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজপথে মানুষ নামিয়ে দিতে, বিপরীতে প্রফেসর ওয়াল্টারকে দেখি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি আরভি গাড়িকে চলমান ল্যাব-এ পরিণত করে সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়াতে। 

দুই প্রফেসরর অনেক অমিলের মধ্যে একটিই মিল পাওয়া যায়, তা হলো দুজনেই আত্মগোপনে থাকে পুরো সিরিজজুড়ে। প্রফেসর সার্জিও যেমন বলে- ‘যার হারাবার কিছু নেই, তার আছে জয় করার মতো দুনিয়া’ (ইতালির ফ্যাসিবাদ বিরোধী বামপন্থি আন্দোলনের পরিবারের সদস্য বলেই), তেমনি প্রফেসর ওয়াল্টারের শিক্ষা হলো এই ‘পরিবার সবার আগে’। দুই প্রফেসরই ঠিক কথা বলেন কিন্তু যেন একে অপরের বিপরীত শিক্ষা। তাই ওয়াল্টারকে আমরা একা হয়ে যেতে দেখি, আর সার্জিওকে দেখি সমাজে মিশে যেতে। পুরো মানি হায়েস্ট সিরিজে প্রফেসর সার্জিও মারকিনাকে দেখা যায় এমন একজন মানুষ হিসেবে যিনি নিঃসঙ্গতা ভয় পান, কিন্তু ব্রেকিং ব্যাডের প্রফেসর ওয়াল্টার সবসময় অন্তমুর্খি হয়ে থাকতে চান। সিরিজের চতুর্থ সিজন পর্যন্ত প্রফেসর সার্জিও মারকিনা টোকিওকে পেয়েছেন তার প্রিয় স্টুডেন্ট হিসেবে আর পুলিশ ইনসপেক্টর রাকেলকে পেলেন জীবনসঙ্গী হিসেবে। কিন্তু ওয়াল্টার? প্রফেসর ওয়ল্টারের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে বিজ্ঞান অনুসন্ধানে মগ্নতার পরিণাম হিসেবে আসে ব্যক্তিজীবনে দুঃসহ একাকীত্ম, ডিভোর্স!

প্রফেসর সার্জিও এবং প্রফেসর ওয়াল্টার, একজন সমরবিদ্যা ও অপরজন রসায়নবিদ্যার পল্ডিত। এরা শুধু জিনিয়াস নয়, রীতিমতো মাস্টারমাইন্ড। রসায়ন আর সমরবিদ্যা নয়, একটি যুদ্ধের সম্ভাব্য সকল পরিণতি ঠাণ্ডা মাথায় সুচারুভাবে সামাল দিতে ওস্তাদ তাঁরা।  রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়া দুটি সিনেমাটিক চরিত্র, বিশ্বের ওয়েবসিরিজ এবং টিভি সিরিয়ালের ইতিহাসে প্রভাববিস্তারকারী দুই চরিত্র।

রাজীব নন্দী: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।