অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পাবনার তাঁতপল্লীতে শ্মশানের নিরবতা 

রিজভী জয়, পাবনা

প্রকাশিত: ০১:২৪ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ০১:২৮ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

করোনা সংকটে টানা লোকসানে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে পাবনার তাঁত শিল্প। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ তাঁতকল। রমজানের ঈদ সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টাও পণ্ড হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধে। বেকার হয়ে পথে বসার উপক্রম এর সাথে সংশ্লিষ্ট মালিক শ্রমিকদের।

তাঁতীরা জানান, পাবনার তাঁতে বোনা শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা বেচাকেনার সবচেয়ে বড় মৌসুম রমজানের ঈদ। কয়েক মাস আগে থেকে এ সময়টির জন্য উৎপাদন করেন তারা। গত রমজানে লকডাউনে পণ্য বিক্রি না হওয়ায় লোকসান হয়েছে। 

করোনাকালে উৎপাদিত কাপড়ের দাম না বাড়লেও, কয়েকগুণ বেড়েছে রঙ, সুতা ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম। এরপরেও, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রমজানের ঈদ টার্গেট করে ব্যাংক, এনজিও ও মহাজনের ঋণে পণ্য উৎপাদন করেছিলেন তাঁত মালিকেরা। তবে ফের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় হারাতে হচ্ছে সর্বস্ব।

তাঁতবোর্ড সূত্রে জানা যায়, পাবনায় প্রায় আড়াই লাখ তাঁত রয়েছে। লোকসানে অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সচল রয়েছে মাত্র এক তৃতীয়াংশ। তাঁতী ভেদে ১-২টি থেকে শুরু ৫০টি তাঁতও রয়েছে। সদর উপজেলার জালালপুর নতুনপাড়া, দোগাছি, ভাড়ারা, গঙ্গারামপুর, বলরামপুর, মালঞ্চি, কুলুনিয়া, খন্দকারপাড়া, বেড়া উপজেলার কৈটলাসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁত পল্লী রয়েছে। এসব তাঁত কারখানায় প্রায় দেড় লাখ পুরুষ ও নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। পরোক্ষভাবে আরও প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ জনবল এ শিল্পের সাথে জড়িত।

সরেজমিনে সদর উপজেলার জালালপুর তাঁতপল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে লকডাউন ঘোষণায় তাঁতপল্লীগুলোতে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। অথচ প্রতিবছর রমজান মাসে রাত দিন খট খট শব্দে চলে তাঁত, দম ফেলার ফুসরত থাকেনা তাঁতীদের।

পাবনা জেলা তাঁত সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নান চৌধুরী জানান, চলমান সর্বাত্মক বিধিনিষেধের কারণে কারখানা খোলার অনুমতি থাকলেও, বন্ধ রয়েছে পোশাকের দোকান ও বিপনী বিতান। অর্ডার বাতিল করেছে বড় কোম্পানিগুলো। পাইকার না আসায় বেচাকেনা নেই হাটে বাজারেও। ফলে, পুঁজি সংকটে বন্ধ অধিকাংশ তাঁতকল।কর্মহীন অলস সময় কাটছে শ্রমিকদের। এমন পরিস্থিতিতে ক্রমাগত লোকসান আর চতুমুর্খী ঋণের চাপে ধ্বংস হয়ে যাবে এই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প।

আব্দুল মান্নান আরো জানান, গত ৬ মাসে সুতার দাম বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। পঞ্চাশ কাউন্টের সুতার দাম ছিল ১৩ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। ঠিক একইভাবে দাম বেড়েছে ৬০ কাউন্ট, ৭০ কাউন্ট, ৭২ কাউন্ট বা ৮০ কাউন্টের সুতার।

তারা জানান, স্বাভাবিকভাবেই লুঙ্গি ও শাড়ির উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে অন্যদিকে সুতার দাম যে পরিমাণে বেড়েছে সে অনুপাতে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানো যায়নি। ফলে লভ্যাংশ থাকছে না আর থাকলেও তা এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালানোর মতো যথেষ্ট নয়। তাঁতীদের আশা ছিলো ঈদের বেচাকেনায় হয়তো কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু,গতবছরের মতো এবারও আমাদের পথের ভিখিরি বানিয়ে ছাড়বে। গত ৫০ বছরেও এমন পরিস্থিতি দেখিনি।

তিনি আরও জানান, সুযোগ সন্ধানীদের কারসাজিতে গত বছর সরকারের দেয়া প্রণোদনা পাননি অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি তাঁতী। চলমান পরিস্থিতিতে তাঁতবোর্ডের পরিচয় পত্রের ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তার দেয়া হলে প্রকৃত তাঁতীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।

ক্ষুদ্র তাঁত মালিক আবু শামা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার লাভ করে প্যাটে (পেটে) দিবের পারতিছিনে। বাড়ি-গর বেচি দিলিও দিনা শোদ অবিনানে। সরকার যা ট্যাকা দেয়, তা তো চোর চুট্টায় খায়া ফালায়। আমরা দরিদ্র ও পতন অয়া গেচি।

পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, করোনা দূর্যোগের ক্রান্তিকালে ক্ষুদ্র ও মাঝারী তাঁতী ও শ্রমিকরা বড় ধরণের সংকটে পড়েছেন। সর্বাত্মক বিধিনিষেধে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহণে কোন বাধা নেই, কিন্তু বিপননে সমস্যা হওয়ায় তাদের লোকসান হচ্ছে। তাঁত সমিতিতে সমন্বয়হীনতা থাকায় গত বছর সরকারের দেয়া প্রণোদনাও অনেকে পাননি। চলমান পরিস্থিতি উত্তোরণে তাদের সব ধরনের সহযোগীতা করা হবে।