অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

করোনা দেখালো অনেক, শেখালো আরও বেশি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৫:৩২ পিএম, ১৮ এপ্রিল ২০২১ রোববার   আপডেট: ০৫:০২ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২১ সোমবার

অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে বেঁধে মোটরসাইকেলে মাকে নিয়ে নলছিটি থেকে বরিশাল মেডিকেলের পথে ছেলে

অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে বেঁধে মোটরসাইকেলে মাকে নিয়ে নলছিটি থেকে বরিশাল মেডিকেলের পথে ছেলে

২০২০-২১ সাল, গোটা দুনিয়া ওলটপালট করে দেওয়া দুটি বছর। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমূল বদলে গেছে যাপিত জীবনের অনেক অভ্যাস। পরিবর্তন এসেছে প্রতিটি মানুষের জীবনে। জীবনে সচেতনতা ও মানবিকতার মাঝে এক দ্বন্দ্ব ঢুকে গেছে। কখনো তা সূক্ষ্ম কখনো তা বাস্তবতার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। মানবিকতা বজায় রেখে সচেতন হওয়া আর অতি সচেতনতার নামে অমানবিক হওয়া—দুটো বিষয় পরস্পর মুখোমুখি আজ।

'চালকের পিঠে বাঁধা অক্সিজেনের সিলিন্ডার, পেছনে বসে থাকা মাঝবয়সী নারীর মুখে অক্সিজেন মাস্ক'-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটি ছবি চোখে পড়তেই কৌতুহল জাগলো মনে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, করোনাক্রান্ত মাকে বাঁচাতে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে গামছা দিয়ে বেঁধে, পেছনে মাকে বসিয়ে মোটরসাইকেলে ঝালকাঠির নলছিটি থেকে বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসছিলেন ছেলে। 

এমন সময় পথচারীদের কেউ দৃশ্যটি মুঠোফোনে ধারণ করেন এবং ফেসবুকে পোস্ট দেন। দ্রুতই সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ে।

মুমূর্ষু মাকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দিতে না পেরে এবং গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স সংকটে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে মোটরসাইকেলে এভাবেই ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন ছেলে জিয়াউল হাসান।

জিয়াউল পেশায় ব্যাংকার, বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সূর্যপাশা এলাকায়। তার মা নলছিটি বন্দর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেহেনা পারভীন (৫০)। দিন দশেক ধরে জ্বরে ভুগছেন রেহানা পারভীন, এর মধ্যে নমুনাও দিয়েছেন পরীক্ষার জন্য। কিন্তু ফলাফল হাতে আসেনি। 

এর মধ্যেই গতকাল সকালে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ছেলে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে এনে মায়ের শ্বাসকষ্ট কমানোর ব্যবস্থা করলেও তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না জিয়াউল। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজের মোটরসাইকেলে মাকে হাসপাতালে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন।

গতকাল সন্ধ্যায় রেহানা পারভীনকে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।

জিয়াউল হাসান বলেন ' মায়ের অক্সিজেন স্যাচুরেশন নামতে থাকায় গতকাল দুপুর আড়াইটায় নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির চেষ্টা করি। মেডিকেল অফিসার ডা. মেহেদি হাসান মাকে সেখানে না রেখে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যেতে বলেন। অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য কোনো যানবাহন না পেয়ে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। আমার কাছে ঐ মুহূর্তে এর কোনো বিকল্প ছিল না। মাকে বাঁচাতে যা করা দরকার আমি তাই করতে পেরেছি বলে আনন্দ হচ্ছে।’

রাস্তায় প্রথমে মোটরসাইকেলটি আটকাতে সংকেত দিলেও এমন দৃশ্য দেখে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি বলেও জানিয়েছেন তিনি।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল গতবছরের একটি খবরের কথা। ‘মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব’—এ কথা বলে ৫০ বছর বয়সী মাকে শাল-গজারির বন শফিপুরের জঙ্গলে ফেলে যান তার সন্তানেরা। গর্ভধারিনী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সন্তানেরা এমনটা করেন। ঘটনাটি ২০২০ এর এপ্রিলে। 

 ঘটনার একদিন পর উপজেলা প্রশাসন তাকে বন থেকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠায় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। যদিও পরবর্তীতে পরীক্ষায় জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা মায়ের করোনা নেগেটিভ আসে।

খবরে এমনও এসেছে স্বাস্থ্যকর্মীর বাড়িতে ঢিল পড়ছে, ভাড়া না দিতে পারায় বাড়িওয়ালা বের করে দিচ্ছে ভাড়াটিয়াকে, হাসপাতালে বাবার লাশ রেখে ছেলেরা পালিয়ে যাচ্ছে। রাতের গভীরে নাম–পরিচয়হীন লাশ রাস্তায় পড়ে থাকছে। জানাজায় বা দাফনে আপনজন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবরের বাইরে আছে এমন বহু খবর।

তাহলে কি এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে করোনা মহামারি আমাদের অমানবিক করে তুলছে? অথবা আমরা আসলেই অমানবিক জাতি!

অবশ্যই না, এই ঘটনাগুলোর পেছনে কাজ করেছে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা।

কতো অস্থিরতা গেছে, যুদ্ধ গেছে এ দেশে। সবাই সবাইকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছে, মরেছে। এই আমরাই আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশীর মৃত্যু বা অসুখের খবর শুনলেই ছুটে যাই। হাসপাতালে স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। জানাজার মাঠে জায়গা পাওয়া যায় না।

কেননা আমরা হচ্ছি সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিরহে ‘মরি বাঁচি একসাথে’—এই মন্ত্রব্রতে দীক্ষিত জাতি। সচেতনতা ও মানবিকতা একসঙ্গে যদি থাকে,তাহলে কি করোনার সাধ্য আছে আমাদের পরাজিত করার!

আসুন সচেতন হই। হই মানবিক।