অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নতুন চ্যালেঞ্জ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান

প্রকাশিত: ১২:০৭ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২১ বুধবার  

অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান

অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান

বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতে যাচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় "Building a fairer, Healthier world" অর্থাৎ একটি সুন্দর এবং সুস্থ বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা জানি যে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব স্বাস্থ্য খাতের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। আমাদের সারাবছর যেমন কিছু অসংক্রামক ব্যাধি থাকে সঙ্গে নানান ধরনের সংক্রামক ব্যাধি যা বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্ব একটি হুমকির সম্মুখীন করছে - যেমন কোভিড-১৯ সহ কয়েক বছর আগে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ইবোলা। একদিকে ধনী গরীবের বৈষম্য অন্যদিকে দারিদ্র্য গোষ্ঠী এই করোনাকালে আরো বেশি কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। গ্রামের অনেকেই আছেন যারা সঠিক পরিমাণে পুষ্টি পাচ্ছেন না এবং তাদের যে মৌলিক চাহিদা, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটাইজেশন ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ফলে মহামারী কালে তাদের কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস এমন সময় এসেছে যা বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যে আমারা পালন করতে যাচ্ছি সুতরাং আমাদের এই দিবসের যে প্রতিপাদ্য বিষয় তা হলো দেশের মানুষকে সচেতন করা, বিশ্ববাসীকে সচেতন করা। আমরা দেখছি যে অনেকেই আছেন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং ধনী গরীবের বৈষম্য বাড়ছে। আমরা এই অবস্থায় কোভিডকালে আজকের স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জগুলো থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি সেই বিষয়গুলো এই দিনটি উদযাপনে নতুন করে ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবারও বলছি যে কোভিড-১৯ কালে অনেকেই আছেন তারা হয়তো উন্নত জীবনযাপন করছেন যারা স্বাস্থ্য খাতের সমস্ত সু্যোগ সুবিধা ভোগ করছেন কিন্তু দেশের একটি বড় অংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছেন। তাদের যে স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক চাহিদা তা তারা ভোগ করতে পারছেন না, তাদের অপুষ্টি, তাদের মা ও শিশু স্বাস্থ্য, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের যে মৃত্যু হার এর সাথে বয়ঃবৃদ্ধ যারা আছেন তাদের যে স্বাস্থ্য খাতের সু্যোগ সুবিধা দেয়া দরকার তা দিতে আমরা পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছি না। 

এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয় এটি একটি গ্লোবাল সমস্যা। আমরা বাংলাদেশের সকল মানুষকে কোভিড-১৯ টিকাদানের আওতায় আনতে পারিনি খুব অল্প সংখ্যক লোককেই টিকাদানের আওতায় আনতে পেরেছি। যদিও আগামী ৮ ই এপ্রিল থেকে কোভিড-১৯ টিকা ২য় ডোজ শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা জানি ২০২০ সালের ৮ই মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয় এবং ১১ই মার্চ ২০২০ করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দেয় ও ১৮ ই মার্চ ২০২০ প্রথম বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আজ ২০২১, ৭ই এপ্রিল ৩৯৬তম দিনে এসে পৌঁছেছি। আমরা জানি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য নানাভাবে সংগ্রাম করছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যখাতের সকল সু্যোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অর্থাৎ ধনী গরীবের বৈষম্য ও সরকারি এবং বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য আমাদের দূর করা দরকার। আমাদের স্বাস্থ্যের যেমন উন্নতি দরকার, শিক্ষারও তেমন উন্নতি দরকার। কারণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধার উন্নতি প্রয়োজন। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করা দরকার। যদিও এর কিছুটা উন্নতি হয়েছে এরপরও বলবো এখনো আমরা পুরোপুরি উন্নতি করতে পারিনি। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। যদিও আমাদের সরকার বিভিন্ন ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু সেভাবে মানা হয়নি। প্রথম দিকে যে আতঙ্ক ছিল উদ্বেগ ছিল সেটির থেকে মানুষ নতুন সাধারণ জীবনে পদার্পণ করেছে ঠিক সেই সময় করোনা সংক্রমনের উর্ধ্বগতি মানুষকে আবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ঠিক সেই সময় আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করতে যাচ্ছি। এই দিবসের গুরুত্ব আবারও বলছি, আমরা যদি এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে চাই তাহলে এ বছরের যে প্রতিপাদ্য বিষয় সুন্দর ও সুষ্ঠু পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। সরকারের সাথে জনগণের  একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে পাশাপাশি চিকিৎসার যে মৌলিক চাহিদা তা সরকারকে পূরণ করতে হবে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক যে ব্যাধি সে বিষয়ে আরও ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি। 

আমাদের দেশের স্বাস্থ্যোর যে অবকাঠামো সেটা ভালো রয়েছে, আমাদের দেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি সেটি বিশ্বের রোল মডেল। আমাদের শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি তার যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়েছে, এমনকি আমাদের দেশে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী আসে তাদের শিশুদের সব ধরনের টিকা দেয়া ছিল না বরং আমাদের দেশে আসার পর আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের আমাদের দেশের শিশুদের মতো টিকা দিয়েছি। এতে করে বাংলাদেশ টিকাদানে একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের অন্যান্য যে চিকিৎসা সুবিধা যেমন হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা যা সারা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে পারিনি হয়তো মৌলিক কিছু চিকিৎসা দিচ্ছি কিন্তু সারা বাংলাদেশকে আমরা আধুনিক চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত করতে পারছিনা। এটি স্বাস্থ্য খাতের একটি চ্যালেঞ্জ। 

আমরা জানি যে স্বাস্থ্য রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর অনেক লোক হৃদরোগের কারণে মারা যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে এখনো উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, শ্বাসকষ্ট, কিডনী রোগ ও লিভারের রোগ এরকম আরো বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে কিন্তু কোন হেলথ ইন্সুরেন্স নেই তাই অনেকেই নিজের টাকায় আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না। পাশাপাশি আমাদের দেশের ঔষধের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হলেও দীর্ঘ মেয়াদি ঔষধ গ্রহন করতে অনেকেই নিজের টাকায় সক্ষম হচ্ছে না। এসব বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে আরো ভাবতে হবে। ২০২০ সালে করোনা আমাদের জীবন যাপনকে বদলে ফেলেছিল যে আমাদের আপনজনকেও শেষ বিদায়টুকুও দিতে সক্ষম হইনি। এটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টের বিষয়। যাদের আপনজন না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাদেরকে সহানুভূতি দেয়ার মত ভাষা আমাদের নেই। এখনো যদি আমরা এ বিষয়ে সতর্ক না হই তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আমাদের মৌলিক কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, হাঁচি কাশি শিষ্টাচার মানতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং বর্তমান সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনা ও লকডাউন মেনে চলতে হবে এবং সরকারকেও আরো বেশি সংখ্যক লোককে কোভিড ১৯ টিকার আওতায় আনতে হবে।

অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান: হল প্রভোস্ট ও অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।