অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪

খ ম হারূন

প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, ১ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৬:২৭ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
 

[পর্ব-২৪]
 

আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের আলোচিত অনুষ্ঠান ‘আইন আদালত’- সে প্রসঙ্গে আমার লেখাটি গত পর্বেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয় উপস্থাপক রেজাউর রহমান, যিনি অনেক গবেষনা, পরিশ্রম আর সাহসী পরিকল্পনা নিয়ে ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠানটি নির্মাণ করতেন, আমার লেখাটি তার চোখে পড়ে। লেখাটি পড়ে তিনি মন্তব্য করেছেন “খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যাক্তিত্ব খ ম হারূন তার ধারাবাহিক আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্র’র এই পর্বে বাংলাদেশ টেলিভিশন এর ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সোনালী অধ্যায়ের এক অসামান্য রূপকার। তার সত্যনিষ্ঠ লেখা আমাকে অভিভূত ও কৃতজ্ঞ করেছে।”

রেজাউর রহমান ১৯৯১ সালে শুধুমাত্র ‘আইন আদালত’ এর কারনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তার সেই সাহসী দিনের কথা, নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হবার কথা, দেশ ছাড়ার কষ্টের কথা, নতুন করে পথ চলার কথা জানতে তার সাথে যোগাযোগ করি। তাকে কিছু প্রশ্ন করি। দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর তাকে শুরু করতে হয়েছিলো আর এক সংগ্রামী জীবন। কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে নতুন করে আবার আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে হয়েছে। নানারকম কাজ করে টিকে থাকতে হয়েছে সেখানে। তিনি এখন কানাডার একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি। অনেক সমাজকল্যাণ মূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত। শত ব্যস্ততার মাঝে তিনি তার সেই সব দিনের কথা লিখে জানিয়েছেন আমার প্রশ্নের উত্তরে। 

খ ম হারূন: আপনি বিটিভির জন্য পাঁচ বছর ‘আইন আদালত’ এর মতো একটি সাহসী অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানটি যখন প্রচার হতো তখন সকলেই অনুষ্ঠানটি নিয়ে আলোচনা করতো, প্রশংসা করতো। আপনি কিভাবে প্রেসিডন্ট এরশাদের শাসনামলে এতো সাহসী হতে পেরেছিলেন?

রেজাউর রহমান: আমরা মধ্যে একটি সহজাত নির্ভীকতা আছে, যা সত্য তা আমি নিঃসংকোচে ও নির্দ্বিধায় বলি। মানুষ তখনি আপোষ করতে থাকে বা দুর্বল হতে থাকে যখন সে তার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট হয়। শুধু প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে নয়, কোনো সরকারের আমলেই আমি কোনো সুবিধা নেইনি। ফলে কারো সামনেই আমার দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ ছিল না। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে কবি, লেখক, সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ, ব্যাবসায়ী, বিশিষ্টজনসহ অনেকেই তার অনুগ্রহে সরকারি প্লট নিয়েছেন, ব্যবসা নিয়েছেন, ব্যাঙ্কঋণ নিয়েছেন আবার তার পতনের পরে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছেন। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও বিশিষ্ট ব্যাক্তির তালিকায় আমি কোনো প্লট নেইনি। সারা বাংলাদেশে আমার মাত্র একটি স্থাবর সম্পত্তি, হাউজ বিল্ডিংয়ের ঋণে আমার বাবার তৈরি করা একটি তিনতলা বাড়ির দুতলার মালিক আমি, আর কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি আমার নেই। দেশে একটি মাত্র ব্যাঙ্ক একাউন্ট ছিল যাতে দেশ ছাড়ার সময় কয়েক হাজার টাকা ছিল, আর কোনো একাউন্ট নেই। এর ফলে আইন আদালত অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আমার হারানোর কোনো কিছু ছিল না, দেয়ার ছিল অনেক কিছু। প্রেসিডেন্ট এরশাদ, তার সরকার আর গোয়েন্দা বাহিনী আমার সব খবর জানতো  তারা জানতো এই মানুষটি বিক্রি হবে না।

যখনই টেলিভিশনে আমাকে বলা হতো যে কোনো একটি বিষয় প্রচার করার অসুবিধা আছে বা প্রচার করা যাবে না তখনই আমি প্রশ্ন করতাম "কেন?" যদি বলা হতো "উপরের নির্দেশ আছে " আমি প্রশ্ন করতাম " উপরটা কে? পরিচয় দিন, আমি কথা বলবো"।  কখনো কখনো এই "উপরের নির্দেশ" ছিল অজুহাত মাত্র, তার মানে সরকারের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য অহেতুক বাধা সৃষ্টি করা। আবার কখনো কখনো সত্যিই উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা বাধা সৃষ্টি করতেন। আমি সব সময়ে এই ধরণের ব্যাক্তিদের মুখোমুখি হয়ে তাদের নিদের্শ বা ইচ্ছা চ্যালেঞ্জ করেছি এবং যুক্তি দিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি।

১৯৮৫ তে ঢাকার পেশাদার হত্যাকারীদের একটি দলের গোপন আস্তানায় গিয়ে আমরা তাদের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি যেখানে তারা পুলিশের একাংশের সাথে তাদের সহযোগিতা ও তাদের বিপুল অংকের ঘুষ দেয়ার ব্যাপারটি প্রকাশ করে। বিটিভির এক কর্মকর্তা আমাদের না জানিয়ে  বিষয়টি তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানালে  তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায় এবং অনুষ্ঠানের প্রচার বন্ধ রাখে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি জানতে পারি যে অনুষ্ঠানটির টেপ প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল আতিকুর রহমানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এর পরেই জেনারেল আতিকের অফিস থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে জানানো হলো যে, তিনি তার অফিসে প্রাতরাশের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন এবং সেই সময়ে তিনি আমার উপস্থিতিতে প্রতিবেদনটি দেখবেন। তখন দেশে সামরিক আইন চলছে  যা সম্পূর্ণভাবে অসাংবিধানিক এবং একজন আইনজীবী হিসেবে আমি এই শাসনের বিরোধী, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমার কোনো ক্ষমতা নেই যে ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠান আমি ইচ্ছা করলেই প্রচার করতে পারবো। নির্ধারিত দিনে মনে ক্ষোভ নিয়েই জেনারেল আতিকের সাথে দেখা করতে গেলাম।  তিনি  উষ্ণভাবেই আমাকে অভ্যর্থনা করলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রশংসা করলেন তার পরে বললেন যে, পুলিশের কাছ থেকে আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাছে আমার প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ গেছে এবং প্রেসিডেন্ট তাকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে বলেছেন। আমরা একটা ছোট মিলনায়তনে চা খেতে খেতে অনুষ্ঠানটি দেখলাম, আমাদের পিছনে কিছু তরুণ অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ হলো। জেনারেল আতিক অত্যন্ত ভদ্র ও সৌম দর্শন মানুষ। কিন্তু তার মুখ তখন খুব গম্ভীর, কিছুক্ষন চিন্তা করে তিনি অনুষ্ঠানটি আবার দেখতে চাইলেন, দ্বিতীয়বার দেখার পরে তিনি শুধু বললেন " Lets go to my office” । আমি একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিলামI।

তার অফিস যাওয়ার পরে তার প্রথম প্রশ্নই ছিল "How did you do this dangerous program? They are professional killers, they could have killed you!" তিনি বললেন প্রতিবেদনটি  দেখে তিনি খুবই অভিভূত কিন্তু এটি  প্রচারিত হলে পুলিশ আর সরকারের মধ্যে বিরোধ দেখা দেবে তারা সরকারের সাথে আর সহযোগিতা করবে না। টেনশন বাড়বে, সরকারের বদনাম হবে। আমি উত্তর দিলাম পুলিশের মধ্য যারা সৎ তাদের জন্য দেশ টিকে থাকে। অসৎদের জন্য নয়। সুতরাং অসৎদের সহযোগিতা সরকার কেন প্রত্যাশা করবে?  তা ছাড়া আমি যা দেখাবো তা গোপন কিছু নয়,  জনগণ ঠিকই এই ঘটনা জানে, গোপন করলে কোনো লাভ নাই বরং সরকারকেই তারা এই কাজের দোসর ভাববে। তিনি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন "আমি আপনার সদিচ্ছা উপলদ্ধি করতে পারছি, এই অনুষ্ঠানটি যাবে। কোনো সমস্যা হলে আমি দেখবো"। তখন একজন সামরিক অফিসার নিজ দায়িত্বে সত্যের পক্ষে যে দৃঢ়  অবস্থান নিয়েছিলেন পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে অনেকেই তা নেননি।

আর একবার তথ্যমন্ত্রী আনোয়ার জাহিদ টিএন্ডটির কয়লা কেলেঙ্কারির উপরে ‘আইন আদালত’ এর একটি প্রতিবেদন প্রচার নিষিদ্ধ করে দেন। তার সাথে আলোচনা করে যখন কোনো লাভ হলোনা তখন আমি প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে দেখা করে বিষয়টি তুলে ধরি এবং তাকে দুর্নীতির দালিলিক প্রমান দেখিয়ে বলি যে এই অনুষ্ঠান বন্ধ করলে মানুষ ভাববে যে এই দুর্নীতির সাথে টিএন্ডটির কতিপয় কর্মচারী নয় পুরো সরকার জড়িত, তা না হলে সরকার কেন এটি বন্ধ করছে?  তিনি আমার সামনে ফোন উঠিয়ে আনোয়ার জাহিদ কে তিরস্কার করে বললেন "কেন আপনি এই অনুষ্ঠান আটকিয়েছেন? এটা কি কোনো স্টেট  সিক্রেট, এটা  একটা ক্রাইম যেটা এক্সপোসড হওয়া দরকার"। আনোয়ার জাহিদ এই অপমান কখনো ভুলেননি।

খ ম হারূন: হঠাৎ করে আপনি ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে ‘আইন আদালত’ তৈরী করা বন্ধ করে দেন। সেটা কি আপনার নিজের ইচ্ছায় নাকি অন্য কোনো কারণ ছিলো? 

রেজাউর রহমান: অনেকেই হয়তো অবাক হবেন জেনে যে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময় যখন সামরিক সরকার ছিল তখন অনুষ্ঠান করতে যত বাঁধার মুখোমুখি হয়েছি তারচেয়ে বেশি বাধা বা সেন্সরশিপ এসেছে বেসামরিক সরকারের সময়। কারণ তখন নানা ধরণের সুযোগসন্ধানী মানুষ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুষ্ঠানের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। সংসদ সদস্য মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নানা বিষয়ে বাঁধা সৃষ্টি করতে থাকে এদের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে বার বার সরকার প্রধানের কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর যেহেতু তার ক্ষমতা তখন একটি রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভরশীল ছিল, তাকে আরো অনেক বেশি আপোষ করে চলতে হচ্ছিলো I বলা চলে যে, প্রেসিডেন্ট এরশাদের কারনে নয় কিন্তু তাকে খুশি করার জন্য কিছু সুবিধাবাদী মানুষ অনুষ্ঠানটির উপর এতো ঘন ঘন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে যে অনুষ্ঠানটি আর অব্যাহত রাখা যায়নি।

কয়েকটি উদাহরণ দিলে আপনারা বুঝতে পারবেন। আমি বোমাবাজদের উপরে একটা তদন্ত প্রতিবেদন করেছিলাম, এই প্রতিবেদনে কিভাবে ভারত থেকে বিস্ফোরক চোরাপথে বাংলাদেশে ঢুকছে ও সন্ত্রাসীরা বোমা বানিয়ে কিভাবে তা পাইকারি হারে সব জায়গায় বিক্রি করছে তা দেখাই। এর সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধী চক্রের নেটওয়ার্ক ও তাদের ভবিষৎ পরিকল্পনার ভয়াবহতা তুলে ধরি। আমি যখন অনুষ্ঠানটি সম্পাদনার জন্য টেলিভিশনে উপস্থিত তখন হঠাৎ করে বিটিভির তৎকালীন মহাপরিচালক যিনি একজন বিখ্যাত মানুষ স্বয়ং সম্পাদনা কক্ষে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করলেন যে, প্রচারের অযোগ্য একটি ভয়াবহ অনুষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে। তিনি অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ দেখে বললেন, "এই প্রতিবেদন দেখে তরুণরা বোমা বানানো শিখবে। সরকার ক্ষিপ্ত হবে"।  আমি তাকে বললাম, "আমরা তো কোথাও কিভাবে বোমা বানানো হয় সেই বিষয়ে কোনো কিছুই দেখাচ্ছি না। বোমা বিষ্ফোরণের দৃশ্য ও এর ভয়াবহতা দেখিয়েছি যাতে এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠে"।  তখন অনুষ্ঠান সম্পাদনার দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি বললেন, "স্যার বড়ই গাছে যে পোলাপান ঢিল মারে ওরা কি স্যার আমাগো প্রোগ্রাম দেইখা হেইটা শিখছে না এমনিই শিখছে , তা হৈলতো স্যার নাটক ও দেখান যাইবো না"। এরকম একটি সরল সত্য কথা সেই অতি উৎসাহী কর্মকর্তার মুখ বন্ধ করে দিলো, আমরা অনুষ্ঠান প্রচার করলাম। সরকার কিছুই বললো না। আর একবার এক প্রযোজক যিনি নাটকের জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং সবাই তাকে প্রগতিশীল বলে মনে করতো, তিনি আইন আদালত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে দায়ের করা মামলা নিয়ে কথা বলার বিষয়ে আপত্তি তুললেন। বললেন এখানে রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনার কি দরকার সরকার বিরক্ত হতে পারে। আমি তাকে বললাম এই বিষয়ে লিখিত নোট দিয়ে আমাকে জানাতে, তিনি দ্রুত তার আপত্তি প্রত্যাহার করে নিলেন।  

ঢাকার খামার বাড়িতে কৃষি গবেষণাগারে একজন পরিছন্নতা কর্মীকে হত্যা করে তার লাশ গুম করা হয়। প্রভাবশালী মহলের চাপে পুলিশ ওই প্রতিষ্ঠানের সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আমরা একটি প্রতিবেদন তৈরী করি। প্রভাবশালী কর্মকর্তারা টেলিভিশনে এসে অনুষ্ঠানটি প্রচার না করার জন্য টেলিভিশনের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে তদবির করতে থাকে। আমি অনুষ্ঠান প্রচারের সিদ্ধান্তে অনড় থাকি। কিন্তু প্রচারের আগে দেখা গেলো কেউ সেই টেপ মুছে ফেলেছে। এটা যে একটি অন্তর্ঘাতমূলক কাজ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বিটিভি এর রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপর হয়নি। এইভাবে আরো অনেক বাধা বিপত্তি ও সেন্সরশিপের কারণে আমি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।

এ কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে যে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার জন্য আমি খালেদা ফাহমি, মুস্তাফা কামাল সৈয়দ, প্রযোজক আলিমুজ্জামান দুলু, মাহবুবুল আলম ও খ  ম হারূন সহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের  অকুন্ঠ ও সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। তাদের অমূল্য সাহায্য ছাড়া ‘আইন আদালত’ নির্মাণ করা কখনোই সম্ভব হতো না। 

খ ম হারূন: ‘আইন আদালত’ বন্ধ করে আপনি বাংলাদেশে আইন পেশায় মনোযোগী হন এবং ‘অধিকার ট্রাস্ট’ গঠন করেন। এ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।  

রেজাউর রহমান: ‘আইন আদালত’ করার সময় আমি স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধের মধ্যে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলাম কারণ আমাকে সব সময় সতর্ক থাকতে হতো যাতে আমার মক্কেলের মামলার বিষয় আইন আদালতে প্রচার না পায়  আর অনুষ্ঠানে প্রচারিত কোনো বিষয়ে আমি যেন ফি এর বিনিময়ে মামলা না লড়ি  কারণ তাহলে সেটা শুধু স্বার্থের সংঘাতই হবে না সেটা হবে পেশাগত অসদাচরণ। ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠান চলাকালে ১৯৮৫  সনের ৬ জানুয়ারী  আমি মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘অধিকার ট্রাস্ট’ গঠন করি। 

আইন আদালতের মূল প্রযোজক আলিমুজ্জামান আমৃত্যু অধিকার ট্রাস্টের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতিত ও অসহায় মানুষকে তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য বিনামূল্যে আইনগত সাহায্য দেয়া, আমাদের স্বেচ্ছাসেবী আইনজীবীরা তাদের আইনি পরামর্শ দিতেন ও তাদের জন্য আদালতে কেস লড়তেন যা আইন আদালত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করা যেত না। এ ছাড়াও আমরা শিশু শ্রমিক ও ছিন্নমূল শিশু কিশোরদের জন্য প্রতিষ্ঠিত "শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের" প্রস্তাবক পরিকল্পক ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। এই বিদ্যালয়গুলো নির্মাণ ও এর পরিচালনার ব্যায়ভার বহন করতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরবর্তীতে সরকার এই স্কুলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পথকলি ট্রাস্টের হাতে ন্যস্ত করে। বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদকে স্বীকৃতি দেয় ও তার বাস্তবায়ন করে সে বিষয়ে ইউনিসেফের সাথে ‘অধিকার ট্রাস্ট’ ও আমি ব্যক্তিগত ভাবে কাজ করি ও স্বীকৃতি আদায়ে সফল হই।

বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে অনেক শিশু বন্দি ছিল যাদের জন্ম হয়েছিল কারাগারে অথবা যারা তাদের মায়ের সাথে কারাগারে এসেছিলো, মা যখন বিচারাধীন বা দণ্ডিত আসামি এরাও তখন বিনা দোষে বন্দি! ‘অধিকার ট্রাস্ট’ ও আমি এই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য ও শিশুদের কারাগারের বাইরে কোনো শিশু আবাসে যেমন এস ও এস শিশু পল্লীতে রাখার জন্য জনমত সৃষ্টি করতে থাকি। একই ভাবে সরকারের কাছে দাবি জানাই, এক পর্যায়ে আমি প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে দেখা করে অভিযোগ করি যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যান মন্ত্রণালয় এই ঘোরতর অন্যায়ের সাথে জড়িত এবং এই অন্যায়ের প্রতিকারের  যে কোনো উদ্যোগ তারা ব্যাহত করছে। তার কাছে সব প্রমান তুলে ধরার পর তিনি কারাগার পরিদর্শন করে আমার অভিযোগের সত্যতার প্রমান পান এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী অবিলম্বে শিশুদের কারাগারের বাইরে নিরাপদ শিশু নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।

খ ম হারূন: হঠাৎ করে আপনি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ১৯৯১ সালে কানাডা চলে যান। কি এমন ঘটনা ঘটেছিলো যে আপনাকে দেশ ছাড়তে হলো? 

রেজাউর রহমান: ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠান  অভাবনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করলেও আমার জীবন খুবই বিপদসংকুল হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বরিশালের কুখ্যাত ডাকাত কুদ্দুস মোল্লা জেল থেকে পালিয়ে যায় ও পরে  মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে  বীর প্রতীক উপাধি পাওয়ার পরেও  সে  অপরাধ জগতে ফিরে যায় আর ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশ্যে বরিশালে দুই ভাইয়ের চোখ সুই আর চামচ দিয়ে উপরে ফেলে কারণ তাদের বাবার অভিযোগের কারণেই কুদ্দুস মোল্লার জেল হয়েছিল। দীর্ঘ নয় বছর মামলা চলার পরে আদালত কুদ্দস মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কুদ্দুস মোল্লার পৃষ্ঠপোষক ছিল একজন শক্তিশালী  রাজনীতিবিদ যিনি পরে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। এই চোখ তুলে ফেলার ঘটনায় তার অংশগ্রহণের অভিযোগ থাকলেও তার সরকার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়। এরশাদ সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কুদ্দুস মোল্লার মুক্তির জন্য জোর তদবির শুরু হলে বিষয়টি আমি ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠানে প্রচারের উদ্যোগ নেই আর তখনই এই রাজনীতিবিদ অনুষ্ঠানটির প্রচার বন্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। তিনি প্রথমে নির্লজ্জ্বভাবেই মোটা অংকের ঘুষ সাধেন। আমার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাখানের জবাবে তিনি মারাত্মক পরিণতির ইঙ্গিত দেন। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হওয়ার পরে আমি বিটিভির ঠিকানায় একটি ঘাতক চক্র থেকে বেনামি চিঠি পাই যেখানে তারা জানায় যে একজন ব্যক্তি আমাকে হত্যা করার জন্য তাদের কে ভাড়া করেছিল, প্রস্তুতিতে হিসেবে তাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে এনে রাখা হয়, তারা আমাকে হত্যার জন্য পরপর দুবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। প্রথমবার পিজি হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নেমে আমি যখন পত্রিকা কিনছিলাম তখন উৎসাহী লোকজন আমাকে ঘিরে ধরলে তারা গুলি চালাতে ব্যার্থ হয়।  এর পরে কমলাপুর স্টেশনের কাছে আর একবার চেষ্টা করেও তারা জনগণের কারণে ব্যর্থ  হয়। এরপরে পরবর্তী সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য হলে অবস্থানের সময় তারা আমার টিভি রিপোর্টিং দেখে আমাকে হত্যা করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাদের ভাষায় তাদেরও একটা নীতি আছে, তাই তারা আমার মতো একজন মানুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত বাতিল করে অগ্রিম বাবদ নেয়া টাকা ফেরত দিয়ে দেয় আর আমাকে জানায় যে অন্তত তাদের দিয়ে আমার কোনো ক্ষতি কখনো হবে না।

ঢাকায় একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদের সহযোগিতায় এক বিশাল অপরাধী চক্রের বিভিন্ন যানবাহন বিশেষ করে টেম্পো শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে কয়েকটি টিভি রিপোর্টিং দেখিয়ে আমি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিপদজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করি, আমার বাসায় ককটেল নিক্ষেপ ও ক্রমাগত হত্যার হুমকি দেয়ার কারণে আমি অনুমোদিত আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে বাধ্য হই ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিই।

কিন্তু আমার দেশ ছাড়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে যে ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠানের জন্য যাদের অপরাধ উন্মোচিত হয়েছে বা স্বার্থের ক্ষতি হয়েছে, এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তারা আমার উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নানা কৌশল ও পদক্ষেপ নিতে থাকে। আইন আদালতের পরেও আমি সমাজ গঠনমূলক কাজ অব্যাহত রাখি। ঢাকা জেলা প্রশাসন আমাকে অবৈতনিক বেসরকরি জেল পরিদর্শক নিয়োগ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাকে, প্রখ্যাত ফুটবলার সালাহউদ্দিন ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ডক্টর মিজানুর রহমান শেলী কে পথকলি ট্রাস্টের ট্রাস্টি নিয়োগ করে। সরকার, প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস, সাংবাদিক নইমুল ইসলাম খান ও আমি সহ আরো কয়েকজন কে জাতীয় দুর্যোগ প্রতিরোধ ও জনসংখা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য নিয়োগ করে কিন্তু হঠাৎ করে ৯০ সনে একটা মহল আমাকে এরশাদের দালাল বলে অপপ্রচার শুরু করে কিন্তু বাস্তবে আমি তখন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা, তার প্রয়াত স্বামী ওয়াজেদ আলী মিয়া আর অন্য দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রিয়ভাজন ও আস্থাভাজন। তারা ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠানই  খুব পছন্দ করতেন এবং আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘এখনই সময়’ পত্রিকাও পছন্দ করতেন। আমি সবার সংবাদ নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ করেছি। ১৯৮৮ সালে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের এরশাদ বিরোধী স্কেচ "দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে" ছাপার পরে আমাদের সকল সংখ্যা হকারদের কাছ থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো আর প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমাকে দুঃখ করে বলেছিলেন "আমি এখনই সময়ের মতো পত্রিকা থেকে এটি আশা করিনি।  আমি বলেছিলাম "সম্পাদক হিসেবে আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে,  আপনি বা আপনার দল একটা প্রতিবাদ দিলে তো আমরা ছাপতাম"।

ঢাকার ধোলাই  খাল এলাকায় পথকলিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি অতিথি হিসিবে উপস্থিত ছিলাম, প্রেসিডেন্ট এরশাদ এই স্কুলটির উদ্বোধন করেছিলেন। আমি ইচ্ছা করেই শেষের সারিতে বসে সব কিছু লক্ষ্য করছিলাম হঠাৎ শুনলাম প্রেসিডেন্ট এরশাদ মাইকে বলছেন "পথকলি একটি মহৎ উদ্যোগ আর এটি প্রতিষ্ঠার জন্য যার অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ আমি তাকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই- তিনি আপনাদের সবার প্রিয় রেজাউর রহমান"।  এর পর তিনি  আমাকে মঞ্চে আহ্বান করেন, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি খুব বিচলিতবোধ করি। কারণ আমি তখন ‘জনতার সামনে’ অনুষ্ঠানটি নির্মাণ করছি আর সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছি। এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে একই মঞ্চে দাঁড়ালে লোক আমাকে ভুল বুঝতে পারে, কারণ আমি যে বার বার শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার সাথে অনুষ্ঠানটির বিষয়ে সাক্ষাৎ করছি আর আলোচনা করছি সাধারণ মানুষ তো আর সেটা জানেনা। কিন্তু নিয়তি বলে কথা, যা হবার তা হবে কে আর রোধ করবে, আমি মঞ্চের দিকে যাচ্ছিনা দেখে প্রেসিডেন্ট সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা এসে বললো "প্রেসিডেন্ট আপনাকে ডেকেছেন, প্লিজ চলুন"। তারা ভিড় সরিয়ে আমাকে সামনে নিয়ে এলো, আমি মঞ্চে উঠলাম, সবাই খুব হাত তালি দিলো, অনেকে চিৎকার করে বললো " আইন আদালত" "আইন আদালত " আমি মুচকি হাসলাম। কিন্তু একটা অজানা আশংকা আর অস্বস্তিতে মন ভরে উঠলো। রাতের সংবাদে স্কুলের খবরটি প্রচারের সাথে আমি দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া পেলাম। কেউ ফোনে এই মহৎ কাজের জন্য প্রশংসা করলেন, কেউ দুঃখ করে বললেন শেষ পর্যন্ত আমিও বিক্রি হয়ে গেলাম। আমি এক মারাত্মক সমস্যায় পড়লাম। পরের দিন বাসায় ফুলের মালা আর তোড়া নিয়ে নানা ধরণের মানুষ উপস্থিত। বিষন্ন বদনে কয়েকজন এসে একান্তে জানালো যে আমাকে তারা যে কি ভালোবাসতো, কি শ্রদ্ধা করতো, আর সেই আমি কি না এরকম একটা মানুষের সাথে হাত মিলালাম! আমি তাদের কে যতই বলি আমার কোনো স্বার্থ নাই, তাদের মুখ দেখে মনে হয় তারা আমার আচরণে গভীর দুঃখ পেয়েছে। এই প্রথম আমি রাজনীতি কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।    

আমি থাকতাম ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে , এই এলাকায় আমার বিপুল জন সমর্থন থাকলেও রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত একটি অপরাধী চক্র যারা সায়দাবাদ টার্মিনাল থেকে জোর করে চাঁদা উঠতো, হরতালের সময় যানবাহনে আগুন দিতো, যাদের হাত থেকে গরিব রিক্সাওয়ালা, বেবিট্যাক্সিওয়ালার পর্যন্ত রেহাই পেতোনা। যাদের বোমাবাজি আর গোলাগুলিতে মানুষ মারা যেত আমি তাদের প্রকাশ্য বিরোধিতা করি। দিনের পর দিন আমার চোখের সামনে অসহায় মানুষের আর্তনাদ আর কান্না দেখে আমি বলি যে, সন্ত্রাস দিয়ে হরতাল পালন অপরাধ, এই বিষয়ে আমি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণদের উদ্দেশে এলাকায় বক্তব্য রাখি। এরপর পরেই সেই গোষ্ঠীটি আমাকে এরশাদের দালাল বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। ১৯৯০ এর ৪ ডিসেম্বর রাত আটটার দিকে আমার পাড়ার কয়েকজন তরুণ এসে আমাকে অনুরোধ করে যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি যেন নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যাই কারণ আমার বিরোধী গোষ্ঠীটি আমার বাসায় হামলার পরিকল্পনা করছে। আমি তাদের কে বলি  আমি যেহেতু কোনো অন্যায় করিনি আর যেহেতু এলাকাবাসী প্রায় সবাই আমার পক্ষে আছে আমি কেন মাথা নিচু করে এলাকা ছেড়ে যাবো! এর মধ্যে অনেকে এসে বললো আমি যেন এলাকা না ছাড়ি কারণ তারা আমার নিরাপত্তার জন্য বাসার পাহারায় থাকবে।  রাত ১০ টার  খবরে প্রেসিডেন্ট এরশাদের  পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো আমি ভাবলাম যাক এবারে সংঘাত বন্ধ হলো। কিন্তু ঠিক রাত এগারোটায় আমার বাসার কাছে কয়েক ট্রাক ভর্তি প্রায় ৩০০ মানুষ হাজির হলো আমি পরে শুনছি এরা শ্রমিক যাদেরকে যাত্রাবাড়ীর বাইরে থেকে আনা  হয়েছিল। তারা আমার বাড়িতে প্রথমে ইট পাটকেল মারতে লাগলো। এদের নেতৃত্বে ছিল আমার বিরুদ্ধ গোষ্ঠী, আমি আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে আক্রমণ না করার জন্য দুতলার বারান্দা থেকে হ্যান্ড মাইকে আহবান জানালাম। আমার পরিচয় দিলাম,  বললাম আমি দেশের মানুষের জন্য, তাদের জন্য কত কাজ করেছি আর আজ আমার ও আমার পরিবারের উপর এই হামলা কেন? কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম যে উত্তেজিত জনতা আমাকে চেনে না। সেই আলো অন্ধকারে কাকে তারা আক্রমণ করছে জানেনা, আমি পরে শুনেছি যে তাদের বলা হয়েছিল একটা বাসা লুট করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে, তাই তারা এসেছিলো। কার বাসা এটা তারা  জানতোনা। আক্রমণকারীরা যখন বাসার কলাপ্সিবল গেটে ধাক্কা দিতে থাকে   তখন আমার মা ও স্ত্রী সুরমা আমাকে বাসা ছেড়ে পাশের বাড়িতে চলে যেতে বলে। আমি বলি যে আক্রমণকারীরা বাসায় ঢুকলে কাউকে জীবিত রাখবে না। তার   চেয়ে আমি বাসার গেট ভাঙাটা ঠেকানোর চেষ্টা করি আর তোমরা চলে যাও। সুরমা আমাদের দুই সন্তান সৌম্য ( ৫) আর প্রিয়তি ( ৪ ) কে ঘুম থেকে উঠিয়ে পাশের বাসায় আশ্রয় নেয়, আমার মা বাসা ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। আমার বড় ভাই তার পরিবার নিয়ে তিন তলায় থাকতেন, তিনিও বাসা ছেড়ে চলে যান। আমি আমার পিস্তলটি পকেটে নিয়ে যখন বাড়ির গেটে যেয়ে দাঁড়াই তখন বাড়ির কেয়ারটেকার, ড্রাইভার ও আরো কয়েকজন আমাকে বাসা ছেড়ে, পেছনের বাসায় চলে যেতে বলে কারণ তখন যে কোনো মুহূর্তে গেট ভেঙে যেতে পারে ,আমি গেটের বাইরে হিংস্র মানুষগুলোর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি একবার ভাবলাম যে, আমার পকেটে থেকে পিস্তল বের করে ফাঁকা গুলি করি অথবা সরাসরি গুলি করি কিন্তু হঠাৎ আমার বাবার কথা মনে পড়লো, তিনি খুবই দক্ষ ও সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি বলেছিলেন উত্তেজিত বিপুল জনতার উপরে কখনো গুলি চালাতে নেই। তাতে কারো না কারো প্রাণ তো যাবেই তার চেয়ে কৌশলগত পশ্চাদপসারণ ভালো, গুলিবর্ষন হচ্ছে নিজেকে রক্ষার সর্বশেষ পন্থা। আমি খুব দ্রুত চিন্তা করলাম, ভাবলাম আজ যদি এখানে আমার গুলিতে কেউ মারা যায় তাহলে সেই অপরাধটি হয়তো শহীদের মর্যাদা পাবে, তার স্মরণে একটা শহীদ মিনার হবে, আমার প্রতি কত বড় অন্যায় করা হলো কেউ আর সেটা বলবে না। আর আমি কখনোই হয়তো আমার বাসায় ফিরতে পারবো না। হঠাৎ গেটের বাইরে পরপর দুটো স্ফুলিঙ্গ দেখলাম। তার পরেই গুলির শব্দ, কেউ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করলো। কিন্তু দুটোই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়, আমি বুঝলাম আমার হাতে আর সময় নেই, আমি পাশের বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে পাড়ার পরিচিত  দুজন এসে বললো অন্য বাসায় আশ্রয় নিতে কারণ আক্রমণকারীরা আমাকে সেখানে খুঁজতে পারে। অন্য বাসা থেকে দেখলাম আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, আগুনের শিখা তিনতলা পর্যন্ত ছুঁয়েছে। আমার মা  তখন বাসায়, আমি আমার আশ্রয়দাতাদের কয়েকজনকে বললাম আমার মা, স্ত্রী ও সন্তানদের খোঁজ নিতে।  কিছুক্ষন পরে জানতে পারলাম মা কোরান শরীফ হাতে নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন আর হাত তুলে মোনাজাত করছেন।  মা আমাকে পরে চোখের পানি ফেলে বলেছিলেন, "হে আল্লাহ তুমি আমার নিরপরাধ সন্তান ও তার পরিবার কে রক্ষা করো। সেতো কোনো অন্যায় করেনি তাহলে কেন এই অবিচার, হে আল্লাহ যারা এই অন্যায়ের মদদদাতা তাদের শাস্তি না দেখিয়ে তুমি আমাকে পৃথিবী থেকে তুলে নিও না"।

উল্লেখ্য, এই আক্রমণে জড়িত প্রধান পরিকল্পনাকারীরা সবাই পরবর্তীতে লাঞ্চিত হয়েছে আর কয়েকজন অপঘাতে মারা গেছে। এই আক্রমণে আমার প্রচুর মূল্যবান কাগজপত্র নষ্ট হয় ও অন্যান্য সম্পদ নষ্ট হয়। বাসার নিচে ছিল অধিকার ট্রাস্টের অফিস যা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। বাসায় রাখা তিনটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এর পরে আমি বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকি। সেই সময়ে সুরমা ও বাচ্চারা আমার মা ও ভাইবোনেরা আমার সাথে এসে দেখা করতো, আমরা একসাথে আর থাকতে পারিনি। হঠাৎ ১৯৯১ এর জুন মাসে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের এক অফিসার আমার বাসায় যোগাযোগ করে তার সাথে যোগাযোগ  করতে বলে।  আমি ফোন করলে তিনি আমাকে বলেন যে আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে এবং তিনি বিষয়টি তদন্ত করছেন। আমি তার কথায় খুবই অবাক হই এবং বলি এই ধরণের অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট, তিনি বললেন আপনি নির্দোষ হলে তো আর ভয় নেই তদন্ত রিপোর্ট আপনার পক্ষেই যাবে। তিনি আমাকে দেখা করার দিন ও তারিখ ঠিক করে দিলেন।  আমার স্ত্রী আমাকে বার বার সতর্ক করলো আমি যেন না যাই কারণ তার মনে হচ্ছে এটি একটি ষড়যন্ত্র , আমি তার কথা মানতে রাজি হলাম না আমি বললাম আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। সারাদেশের মানুষ জানে আমি কত ঝুঁকি নিয়ে সত্যের জন্য ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠান করেছি আর আজ যদি আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাই তাহলে ভাববে আমি দুর্নীতিবাজ। ও আমাকে আবারো মানা করলো আমি শুধু বললাম, তোমার অফিসের গাড়িটা পাঠিয়ে দাও। আমি ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে যেয়ে সরাসরি তৎকালীন ডিবি প্রধানের রুমে ঢুকে করমর্দন করে চেয়ারে বসে পড়লাম।  তিনি যেন স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে আমি এতটা সাহস নিয়ে মাথা উঁচু করে তার সাথে দেখা করবো। তিনি খুব বিরক্তি নিয়ে আমাকে বলেলেন Who asked you to sit down,  আমি বিস্মিত হয় বল্ললাম Did you expect me to ask for your permission? Why?    তিনি  বললেন,  “আপনি জানেন  আমি কি করতে পারি? এরশাদ দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলোনা?  তার মতো আপনাকে  একটা বেআইনি অস্ত্র ধরিয়ে এখনই  ছবি তুলে জেলে ঢুকায়ে দিতে পারি , আইন আদালত করার সময় আমাদের বহু জ্বালিয়েছেন, আমাদের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেছেন আর এখন? এখন আপনার টিভি ক্যামেরা কোথায়?  আমি বললাম "একজন সম্মানিত  মানুষ হিসেবে আর একজন সম্মানিত মানুষের কাছ থেকে আমি ভালো ব্যবহার আশা করি"। 

ডিবি প্রধান একজন অফিসারকে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার রুমে নিয়ে যেতে বললেন। একপর্যায়ে অফিসারকে বললাম  “আমি কখন যেতে পারি?” সে কৌতুক করে বললো "কে বললো আপনি যেতে পারবেন"। আমি তখন আমার নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হলাম, আমি বুঝলাম এরা প্রতিশোধ নিতে সংকল্পবদ্ধ, আমি আমার স্ত্রীকে একটা ফোন করতে চাইলে তিনি নিষেধ করলেন। আমি বললাম "আপনার নিশ্চয়ই স্ত্রী ও সন্তান আছে,  আমি আমার  স্ত্রীর গাড়ি নিয়ে এসেছি,  কিছুক্ষনের মধ্যে আমার দুটি ছোট বাচ্চার স্কুল ছুটি হবে, আমি গাড়িটা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে ওকে জানাতে চাই"। তিনি সতর্ক করলেন আমি যেন অন্য কিছু না বলি। কিন্তু আমি কথার শেষে বললাম  "সুরমা, আমি ডেটাইনেড”, আর তখনি তিনি ফোনটা কেড়ে নিয়ে রেখে দিলেন এরপরে বারান্দায় একটা ভাঙা চেয়ারে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলেন।  খবর পেয়ে আমার মা ও ভাইয়েরা দেখা করতে এলেন।  মা বললেন  "কোনো চিন্তা করোনা বাবা, তুমি সৎ ও সাহসী বাবা মায়ের ছেলে, তোমার বাবাও পুলিশ অফিসার ছিল আর এরাও পুলিশ, এরা অন্যায় করছে কিন্তু সত্যের জয় হবে"।  মা বাইরে থেকে খাবার এনেছিলেন তাই খেলাম কারণ এরা এক গ্লাস পানিও দেয়নি। আমি অফিসারদের ওয়াকিটকির কথোপকথন থেকে বুঝতে পারছিলাম পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বা প্রশাসনের আর কেউ আমাকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলোনা। তারা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। আর তিনি সেই মুহূর্তে পল্টনে জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন বলে আমাকে ডিবি অফিসেই আটক করে রাখা হয়েছিল। আমাকে মুক্ত করার জন্য সুরমা তখন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, ও তখন ফাইসন্স এ কাজ করে। ফাইসন্সের কর্মকর্তাদের নিরলস চেষ্টার ফলে আমি মুক্তি পাই। পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলের নির্দেশে আমাকে মুক্তি দিলেও তিনদিন পরে আবার ফিরে আসতে  বলা হয়।

কানাডায় জুলাই মাসে হিউমান রাইটস কোর্সে অংশ নেয়ার জন্য আমার আমন্ত্রণ ছিল। আমি তখনি সিদ্ধান্ত নিই যে কানাডায় চলে যাবো। আমি ছাড়া পাওয়ার পরের দিনই ভারতের ভিসা করি ও বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাই। সেই সময়ে আমার মা সাথে ছিলেন। বাংলাদেশ সীমান্তে পুলিশ, ইমিগ্রেশন অফিসার, কাস্টমস অফিসার তারা আমি কি ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করছি তার কিছুই জানতো না। তারা আমাকে দেখে উৎফুল্লিত হয়ে উঠলো। আমাদের চা, নাস্তা খাইয়ে সমাদর করে অস্থির করে তুললো। কারো কারো ‘আইন আদালত’ এর এক একটি ঘটনা মনে এতো দাগ কেটে ছিল, তারা ক্রমাগত উৎসাহ  নিয়ে প্রশ্ন করছিলো। আর আমি তখন সীমান্ত পার হওয়ার জন্য অধীর হয়ে উঠছিলাম। এর পরে বাংলাদেশ ইমিগ্রশনের দুজন অফিসার মা আর আমাকে ভারতীয় ইমিগ্রশনে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন  "ইনি রেজাউর রহমান, আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত মানুষ, সারাদেশ তাকে চেনে, ভালোবাসে"। ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিসাররা খুব উষ্ণভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন আর তাড়াতাড়ি ইমিগ্রেশন করে দিলেন, এর কিছুদিন পরে আমি দিল্লি থেকে কানাডার ভিসা নিয়ে কানাডায় চলে আসি। পরবর্তীতে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে না কোনো মামলা দায়ের হয়েছে না কোনো অন্যায় কাজের জন্য আমাকে দায়ী করা হয়েছে। 

খ ম হারূন: আপনি যে সময়ে বিটিভিতে অনুষ্ঠান করতেন সেই সময় (১৯৮০-৯০) এবং বিটিভির বর্তমান সময় (২০১০-২০২০) সম্পর্কে কি বলবেন? দুটি সময়ের মধ্যে কি কোনো তুলনা চলে? 

রেজাউর রহমান: সেই সময়ে অত্যন্ত মেধাবী প্রযোজক, কর্মকর্তা ও কলা কুশলীরা অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছেন ও দেশবরেণ্য শিল্পীরা সেই সব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সেই সময়ের অনুষ্ঠানগুলোর নাম দর্শকরা এখনো মনে করতে পারে। তখনকার উপস্থাপকরা ছিল সত্যিকারের তারকা, তখন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাওয়া এক বিরাট ব্যাপার ছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সখ্যতার কারণে টেলিভিশনে চাকুরী পাওয়া বা শিল্পী হওয়ার বিষয়টি অচিন্তনীয় ছিল।  টেলিভিশন ভবনে ঢুকলেই একটা স্নিগ্ধ, পবিত্র ভাব অনুভব করা যেত, সবার সাথে একটা উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এখন হয়তো বহু  শিল্পী,  অনেক অনুষ্ঠান, অনেক টাকার জৌলুশ,  কিন্তু মেধার মাপকাঠিতে তাদের অনেকের অবস্থান  কোথায়? সত্যি কথা বলতে কি এই দুটো দশকের তুলনা করা চলে না কারণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী দুটি সত্তা।    

খ ম হারূন: আপনার দেশে ফিরে আসার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

রেজাউর রহমান: বহুবছর আমি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসার জন্য অস্থির ছিলাম।  বাংলাদেশের মাটি সাথে করে এনেছিলাম। মাঝে মাঝে সেই মাটি ছুঁয়ে অতীতের দিনগুলোতে চলে যেতাম। যে কাপড় পরে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম সেই কাপড় আজও রেখে দিয়েছি। বলে দিয়েছি আমি পৃথিবীতে না থাকলেও দেশের মাটি আর আমার কাপড়গুলো যেন ফেলে দেয়া না হয়। আমার হাতের মেহেদির রং তখনও শুকায়নি, তখনও আমার আইনজীবী হওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়নি যখন আমি ‘আইন আদালত’ অনুষ্ঠান শুরু করি। বয়স আমার তখন ২৫, কত অল্প বয়েসে একটি স্বপ্ন নিয়ে আমি আমার যাত্রা শুরু করে ছিলাম। কিন্তু আমি কি জানতাম বিশাল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমি দেশান্তরী হবো! যে মাকে নিয়ে একসাথে সারাটি জীবন থাকার স্বপ্ন ছিল, তার সাথেই তো থাকা হলো না।  তিনি বার বার বলতেন, "বাবা আমি চাই না তুই দেশে ফিরে আসিস, তুই দূরে থাকে তবু আমি শান্তি পাবো আমার ছেলে তো বেঁচে আছে"। মা চলে গেছেন ২০১৬ সালে, তার পরে আমি আর বাংলাদেশে যাইনি, মা আর আমার মাতৃভূমি, দুটোই আমার এতো ভালোবাসা সত্ত্বেও আমার কাছে থাকলো না। না ভাই, আমি আর দেশে ফিরবো না।

চলবে...

আগের পর্বগুলো পড়ুন

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১