অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মাটিতে কান পাতলেই শোনা যেতো যুদ্ধ চলছে

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:২৮ পিএম, ২৫ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার  

মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

মাটিতে কান পাতলেও তখন যুদ্ধের শব্দ শোনা যেতো। সে শব্দ এমনই তীব্র ছিল যার আওয়াজ চলে যায় দেশের কোনায় কোনায়। এখনকার মতো মুহূর্তে মুহূর্তে সংবাদ পৌছানোর প্রযুক্তি তখন ছিলনা। তবে মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে যেতো। আর খবর জানার জন্য ছিল মানুষের তীব্র বাসনা। কথা হচ্ছিলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

একাত্তরের টগবগে তরুণ আবদুস সাত্তার তখন ১৮য়। হলে কি হবে তার বাসতো ছিলো অজপাড়াগাঁয়। চাপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর গ্রামে। সেখানেও পৌঁছে গিয়েছিলো যুদ্ধের খবর।

”কি হচ্ছে দেশে? এ খবর জানা খুব সহজ ছিলনা। তবুও সেসময়ে যুদ্ধের কোন খবর কারো অজানা থাকতো না,” বলেন আবদুস সাত্তার। গল্পে গল্পে জানালেন মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে তখন তারা ইউসুফ আলী কলেজের ছাত্র। তাদের কাছেও খবর আসলো বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণ দেবেন। কলেজ মাঠে সেই সময়ে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ১৮ বছরের তরুণ আবদুস সাত্তার বিশ্বাসই আড্ডায় বন্ধুদের খবরটা প্রথম দিয়েছিলেন। সে নিয়ে তার আজও গর্ব।

এখন তার পঁচাত্তর। অথচ কণ্ঠে যেনো সেদিনেরই উত্তেজনা। আবদুস সাত্তার বললেন, “আমি খবরটি দিতেই আড্ডার পরিবেশ বদলে গেল। তরুণ চোখগুলো চকচক করে উঠলো। দেশ স্বাধীনের স্বপ্নটা যেন আরো শাণিত হতে লাগলো তরুণ ছাত্রদের হৃদয়ে।”

গল্পের গভীরে যেতে শুরু করলেন তিনি। জানালেন, আড্ডাতে থাকা কয়েকজন তরুণ ছাত্র যোগাযোগ করলেন সিনিয়রদের সঙ্গে। সকলেরই একটা প্রত্যাশা- একটাই জিজ্ঞাসা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কিভাবে শোনা যায় ?

সিনিয়ররা বললেন- রহনপুরের বেগম কাঁচারি প্রাঙ্গনে চলে যাও।

তাই করলাম। কাঁচারি প্রাঙ্গনে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ জমেছে। বেতারে শোনা যাবে ভাষণ। রেডিও মাঝখানে রেখে মানুষের ভীড়, সবার আগ্রহ কখন শুরু হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ।

পুরো আয়োজনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাবেক মেম্বার অব কংগ্রেস খালেদ আলী মিয়া।  

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উপস্থিত সবার মনে দেশ স্বাধীনের একাগ্রতা যেন শাণিত হয়ে গেল। সেখানে উপস্থিত শত মানুষের মন আর চোখ যেন এক কথায় বলছিল, দেশ স্বাধীন করতে হবে। এরপর আর পেছনে তাকালেন না তারা, প্রস্তুতি নিতে থাকলেন মুক্তিযুদ্ধের।  

যেন তারা কাদা মাটি, ট্রেনিং ক্যাম্পে কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পন করলেন, কমান্ডার তাদের ভেঙ্গে- গড়ে যোদ্ধা বানিয়ে দিলেন। আবদুস সাত্তার বিশ্বাস বলেন, তারা মুজাহিদ কমান্ডারের নেতৃত্বে ট্রেনিং শুরু করেন ৭ মার্চের পর। ট্রেনিং হতো রহনপুর এবি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।

ট্রেনিংয়ের নির্দিষ্ট কোন সময় ছিলনা। কখনো সকালে, কখনো বিকালে আবার কখনোবা রাতেও চলতো প্রশিক্ষণ । নওশের আলম, আনোয়ার হোসেন, কচি খন্দকাররাও প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রশিক্ষণ নিতেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ঘন্টার পর ঘন্টা চলতো প্রশিক্ষণ তবুও কেউ ক্লান্ত হতেন না।

১৯৭১ সালের জুনের শেষ দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রহনপুরে ঢোকে। রহনপুর স্টেশনের বিডিআর ক্যাম্পে তারা ক্যাম্প বসায়। চারদিকে থমথমে অবস্থা। প্রাণভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। আবদুস সাত্তার বিশ্বাস জানালেন, পাকিস্তানীরা এলাকায় ঢুকে পড়ার পর তাদের কাছে খবর আসে এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য। কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা চলে যান ভোলাহাটে। ভোলাহাটেই যে যেখান থেকে পেরেছেন একত্রিত হয়েছেন। এতকিছুর পরেও যুদ্ধের ট্রেনিং থেমে থাকেনি। ভোলাহাটসহ কয়েকটি স্থানে খালেদ আলী মিয়া, হাসনুসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।  

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে আমরা প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ করি বোয়ালিয়াতে। পরিখা থেকে তিনি আর রেজাউল করিম মন্টু যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানী সৈন্যর বিরুদ্ধে। বলেন, চারপাশে শুধু গুলির শব্দ শোনা যেত তখন। নদীর পাশ দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে চলে যেতেন ভোলাহাটে।

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনতার একাগ্রতা মনে জেঁকে বসেছিল. তাই কখনোই বিপদেও পিছপা হননি।

‍"একবার বোয়ালিয়াতে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানী বাহিনীরা আমাদের ঘিরে ফেলেছিলো। কিন্তু পিছুপা হয়নি। যুদ্ধ করে গেছি। ডানে বায়ে তাকাইনি।" 

পরে একজন খবর দেন আমরা দুইজন ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। চারপাশে পাকিস্তানীরা সেনারা। এখন সরে পড়ো।

তারপর তিনি আর তার সহযোদ্ধা সরে যান। আবদুস সাত্তার বলেন, "মুক্তিযোদ্ধারা নিজের প্রাণ নিয়ে ভাবতেননা। ভাবতেন দেশ নিয়ে। এজন্যই গুলিকে তুচ্ছ মনে হতো। মনে হতো আমি না ফিরলে কি আর হবে, দেশতো ফিরবে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।"

সেসময়ে নির্দিষ্ট একটা ক্যাম্পে তারা প্রশিক্ষণ নিতেননা। যোদ্ধারা বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতেন। যুদ্ধ করার জন্য তারা স্থান রেকি করে নিতেন। পর্যবেক্ষণের সময় অনেক বিপদে পড়তে হতো। দেশীয় রাজাকারেরা তাদের খবর দিয়ে দিতেন পাকিস্তানী ক্যাম্পে। এজন্য খুব সাবধানে কাজ করতে হতো। 

বললেন, "কিছু পাকিস্তানীর এদেশীয় দালাল এতটাই চালাকি করতেন, দেখে মনে হতো তারা আমাদের লোক , কিন্তু আসলে তারা দেশের শত্রু ছিল।"

আলীনগর, বাঙ্গাবাড়ি, বোয়ালিয়া, ভোলাহাটসহ বিভিন্ন প্রান্তে ৭ নম্বর সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেছেন আবদুস সাত্তার বিশ্বাস। বলেন, দেশ স্বাধীনের খবর তিনি পেয়েছিলেন ভোলাহাটে। 

"রক্তের বিনিময়ে দেশকে ফিরে পাবার অনুভূতি কেমন, যুদ্ধে যারা যায়নি তারা হয়তো ততটা বুঝতে পারবেনা," মন্তব্য করেন তিনি।

দেশ স্বাধীনের পর সরকারি চাকরি করেন আবদুস সাত্তার বিশ্বাস। রহনপুর এবি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ইনস্পেক্টর অব স্কুল ও ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করে এখন অবসরে আছেন।

যে স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন তা কতটুকু পূরণ হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ৭৫ বছর বয়সী আবদুস সাত্তার বিশ্বাস বলেন, "সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ চেয়েছিলাম, যেখানে অন্যায় আর অত্যাচার থাকবেনা। হয়েছে অনেক কিছুই, তবে সব যে সঠিক আর সুন্দর হয়েছে তাও বলা যাবেনা।"

কথা বলার সময় আসরের আযান শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন তিনি। অপলক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আযান শেষে বললেন, কি পেয়েছি আর না পেয়েছি, তা নিয়ে আর কিছু বলবোনা। 

আসরের আযান হচ্ছে, তিনি রোজা রেখেছেন। নামাজ পড়বেন। বিদায় জানিয়ে চলার সঙ্গী হাতের লাঠির উপর ভর দিয়ে চলে গেলেন মসজিদের উদ্দেশ্যে।