অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-ছয়]

কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক

প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ২৫ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ১২:২২ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০২১ রোববার

ওমর, দ্য টেন্ট মেকার

ওমর, দ্য টেন্ট মেকার

[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ] [কিস্তি-৩ পাহাড়ি উদ্যান] [কিস্তি-৪. পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ] [কিস্তি-৫: হাসান বিন সাবাহর কাহিনী]

ছয়. প্রাচ্যের দ্বারমণ্ডপ

পরদিন সুলতান নিশাপুর গেলেন, যদিও মনের সুখে আরও শিকার করতেও তাঁর আপত্তি ছিল না। পাহাড়ি ছাগল আর অন্যান্য প্রাণী তাঁর শিকারের ইচ্ছেকে চাগিয়েও তুলেছিল। কিন্তু তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তাঁকে বললেন যে আগে শহরে চলে যাওয়াই ভালো, সুলতান চাইলে ফেরার পথে পুনরায় শিকারের আয়োজন করা হবে।

নিজ সাম্রাজ্যের পারস্য অঞ্চলের রাজধানীতে মালিক শাহের অভ্যর্থনার যে বিবিধ আয়োজন করা হল, তাদের প্রতিটিই সুলতানের সন্তুষ্টি অর্জন করার মত করে করা হয়েছিল। মনে হল যেন গোটা শহরটার সবাই তাঁকে দেখতে চলে এসেছে আর আকাশেবাতাসে তাঁর প্রশংসা ধ্বনিত হচ্ছে। একহাজার মামলুক সেনার একটা দল আগে আগে চলছিল, তারা যখন পাহারা দিয়ে মূল দলকে তোরণের কাছে নিয়ে গেল, শত শত কুমারী তাদের স্বাগত জানাল। তাদের প্রত্যেকের হাতেই ছিল উপহারের পসরা, আর তাঁরা যখন হাঁটছিল তখন তাঁদের গা থেকে ছড়িয়ে পড়া পারস্যের গোলাপ,কস্তুরি, ঘৃতকুমারী, কর্পূর আর তরল রাসায়নিক থেকে তৈরি করা সুগন্ধি আতরে চারপাশ মৌ মৌ করছিল। দৃশ্যটা ছিল দারুন, যেন দুনিয়াতেই বেহেশতি আমেজ নেমে এসেছে। সুলতান প্রাণ উজার করে উপহার সামগ্রী বিতরণ করলেন, যেন নিশাপুরের প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পায়। বলা হয়ে থাকে যে সে বছর সেখানে কোনো অভাব ছিল না। 

নগরীর জনসংখ্যা তিনলাখে পৌঁছুতে খুব বেশি বাকি নেই। সেই কবে খৃষ্ট জন্মেরও আগে শহরটির পত্তন ঘটেছিল, এরপর থেকে তা কখনোই এমন সমৃদ্ধির মুখ দেখেনি। আলেকজান্দার এটি ধ্বংস করেছিলেন, এবং ধ্বংসস্তুপ থেকে তা পুনরায় উঠে দাঁড়িয়েছিল। এরপরেও তা বারবার ধ্বংস হয়েছে এবং পুনর্জন্ম লাভ করেছে। কিন্তু বহুবছর ধরে সেরকম কিছু না ঘটায় শহরটির শ্রী বৃদ্ধি পাবার সুযোগ পেয়েছে। নগরীর শক্তিশালী দেওয়াল আর বিশাল বিশাল পাহারা-স্তম্ভ যেন স্থায়ী প্রতিরক্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ইরানের অন্য আর কোনো শহরে এর মত বড় দুর্গ ছিল না, ছিল না মালিকশাহের বাসস্থান হিসেবে নির্বাচিত প্রাসাদটির মত বিলাসবহুল প্রাসাদও। বাজারে প্রাচ্যের প্রায় সকল জিনিসই কিনতে পাওয়া যেত, এবং এগুলোর অনেকগুলো তৈরিও হত এ শহরেই।

শহরের একপাশে মৃৎশিল্পীদের বাসস্থান ছিল। ওমর এখানে অনেকক্ষণ ধরে তাদের পাত্র বানানোর কৌশল দেখতে ভালোবাসতেন। ঘূর্ণায়মান চাকায় কাঁদামাটির নীরব টুকরোয় তাঁদের দক্ষ হাতের সঞ্চালন দেখে তাঁর মনে ভাবনার উদয় হত। ভেজা কাঁদায় তাদের হাতের চাপড় দেখে কতবার তাঁর মনে হয়েছে এই বুঝি পাত্রগুলো চীৎকার করে উঠে-
“যাকে তুমি আঘাত করছো এ তোমার পূর্বপুরুষের দেহাবশেষ!”*
“কত দারুন মানুষদেরই না হিংসুক ভাগ্যধাতা মাটির সুরার পাত্রে পরিণত করেছে!”

হিংসুক ভাগ্যধাতা! গোলাপ সুরভিত সুরায় ভরপুর পেয়ালা বানানোর জন্য ওমর নিজেও তো তার দেহাবশেষের কাঁদা কুমোরদেরই দিতেন।

ওমরের কাছে পেয়ালা আর পাত্রগুলো সবই জীবন্ত। কেউ নীরব, কেউ বা কথা বলে, তবে একটা জায়গায় সবারই মিল, এদের প্রত্যেকেই অতীতের সুখের স্মৃতিতে পরিপূর্ণ, যখন তারা ভালোবেসেছিল এবং ভালোবাসা পেয়েছিল। সুদৃশ্য জগের হাতলটা হয়তো সেই হাত যা কোনো তরুণীর গলার চারপাশে আঙুল বুলিয়েছিল! নিশাপুরের মাটির পাত্র সারা প্রাচ্যে ছড়িয়ে যেত। কে জানে কুলির আওয়াজ শুনতে শুনতে তারা দূরের কোনো দৃশ্যের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো কি না!

এই শহরে কাঁসার কারিগররাও ছিল। তাঁদের কারখানা সবসময়ই আওয়াজে পূর্ণ থাকত। হাতুড়ির শব্দ চলত সারাদিন, আর দেওয়ালে ঝুলানো থাকত তামা আর কাঁসার তৈজসপত্র যেগুলো এশিয়ায় এমনকি ইউরোপেও বিক্রি হতো। আর জায়নামায ও কার্পেট বানানোর কারিগররা তো ছিলই, যারা পশমি সুতো, নরম উল আর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন রং দিয়ে সেগুলো বানাত। শত শত উটের কাফেলা আসত আর যেত, যারা গিলান থেকে পশম, ভারত থেকে সোনা-রুপা, বাটাভিয়া থেকে চিনি আর শ্রীলঙ্কা থেকে মসলা বয়ে আনত। সবচেয়ে বড় বাজারটি, এবং অন্য বাজারগুলোও শক্তপোক্তভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। উপরে বঙ্কিম ছাদ দেয়া হয়েছে আর ফুটপাতগুলো বানানো হয়েছে পাহাড় থেকে কেটে আনা পাথর দিয়ে। শহরের মাঝখান দিয়ে পূব-পশ্চিমে বিস্তৃত সবচেয়ে বড় সড়কটার দুধারে ছিল এমনসব প্রাসাদের সারি, যেগুলো যে-কোনো শহরে থাকলেই সকলের দৃষ্টি কাড়ত।

কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, আত্মিক দিক থেকেও নিশাপুর ছিল অনন্য। মানুষের ধর্মীয় এবং বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজন মেটানোর সকল আয়োজনই ছিল এখানে। ছিল মিনার শোভিত অনেক সুদৃশ্য মসজিদ। পিছিয়ে ছিল না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। তাদের গম্বুজের মনোহারী টাইলসগুলো সগৌরবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল। এখানে নামজাদা শিক্ষকেরা আইনের গুরুগম্ভীর বিষয় থেকে শুরু করে রক্ষণশীল মতবাদ, নবিদের শেখানো পথের তালিম দিতেন। আবার কখনোবা কোরআন ও হাদিসের সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয় নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠতেন। অনেক পাঠাগারও গড়ে উঠেছিল, যেগুলোর পাণ্ডুলিপির সংগ্রহে নিয়মিতই নতুন নতুন নাম যোগ হতো। দূর-দূরান্তের শহর থেকে শতশত ছাত্র সেসকল পুঁথির শুষ্ক পাতা নিংড়ে জ্ঞানের রস আস্বাদন করতে আসত।

ওমর নিজেও একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে তিনি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মানতে পারতেন না। অন্য শিক্ষকরা তাঁর সমালোচনা করত বলে তাদেরও তিনি সইতে পারতেন না। ফলে তিনি ঘনঘন ক্লাস নিতেন না। তবে যখনই তিনি ক্লাস নিয়েছেন, তখনই অনেক ছাত্র তা শুনতে এসেছে, কারণ তারা জানত যে তিনি প্রচুর ঠাট্টা-তামাশা করবেন, এমনকি ধর্মবেত্তাদের পছন্দ হবে না এমন কিছুও হয়ত বলবেন।

সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগের দিনই একটা ঘটনা ঘটেছিল। ওমর একটা পুরনো মাদ্রাসায় থামলেন। যত্নের অভাবে এটি পড়ে গিয়েছিল, তখন তাকে মেরামত করে পুনরায় আগের মত করার চেষ্টা চলছে। যে গাধাগুলোর পিঠে করে মালপত্র আনা হচ্ছিল ওমর কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পাশে অনেক ছাত্র দাঁড়ানো। একটা গাধা দরজায় আটকে গিয়েছিল, ভিতরে ঢুকতে পারছিল না। ওমর গাধাটির কাছে গেলেন, আর ওটাকে উদ্দেশ্য করে তাৎক্ষণিক একটা রুবাই রচনা করলেন:
“আমি তো তোমায় চিনেছি বন্ধু
ওস্তাদ ছিলে স্কুলে,
গর্দভ হয়ে জন্মেছো ফের
ভাগ্যধাতার ভুলে,
শ্মশ্রু ও গোঁফ লেজ হয়ে বুঝি
পশ্চাতে আছে ঝুলে।”**

গাধাটা সম্ভবত রুবাইটা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবে, সে একটা শেষ চেষ্টা করল আর জোরে ধাক্কা দিয়ে বোঝাসমেত ভিতরে ঢুকে গেল। ছাত্ররা আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকল কবিতার কি আসলেই এমন শক্তি আছে যে লম্বা-কানের জানোয়ারটিরও উপরও তা কাজ করে। ওমর তার স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা দিয়ে তাদের জিজ্ঞাসার জবাব দিলেন,

“এই গাধাটির আত্মা বহুকাল আগে এ মাদ্রাসার অনেক পুরনো এক শিক্ষকের দেহ আশ্রয় করে ছিল। এখন সে গাধাটির দেহে ভর করেছে। গাধায় পরিণত হওয়ায় সে অত্যন্ত লজ্জিত ছিল, তাই ভিতরে ঢুকতে চাইছিল না। কিন্তু যখন দেখল যে সহকর্মীরা তাকে চিনেই ফেলেছে তখন আর লজ্জার ব্যাপার থাকল না, জোরে ধাক্কা মেরে ঢুকার পথ করে নিল।”

ছাত্রদের কেউ কেউ রসিকতাটা ধরতে পেরেছিল, এবং বুঝতে পেরেছিল যে অধ্যাপকদের উদ্দেশ্য করেই ওমরের এই বাক্যবান। শীঘ্রই চাওর হয়ে গেল যে ওমর তাদের গাধা বলেছেন। এরকম ঘটনা সস্তা জনপ্রিয়তা নষ্ট করে। ওমর ছিলেন মুক্ত চিন্তার মানুষ, কেউ কেউ তাকে ধর্মদ্রোহীও ভাবত। কিন্তু ওমর এসব দুর্নামের থোড়াই পরোয়া করতেন।

সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব সেরে ওমর বাড়ি পৌঁছে দেখলেন যে কয়েকদিন আগে হাসান বিন সাবাহ একজন পর্দাঢাকা রমণী সঙ্গে নিয়ে সত্যি সত্যি এখানে এসেছিল এবং তাকে ওমরের মায়ের কাছে রাখতে চেয়েছিল। তার পরনে তখন পরিপাটি জামা ছিল। সে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও থেকে তীর্থযাত্রীর পোষাক সংগ্রহ করেছে আর ছদ্মবেশ ধারণ করে দেখতে চেয়েছে নিজাম-উল-মুলকের বন্ধুত্ব কতটা খাঁটি। কিন্তু সঙ্গের রমণী ওমরের বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে নি। সে হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে। তার কোনো ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে ভেবে ওমরের মা জেবা খাতুন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময় মনে হল। 

ওমর হাসানকে বলেছিলেন যে সে যতদিন নিশাপুর থাকবে ততদিন যেন তাঁর বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করে থাকে। নিজাম-উল-মুলকও তাকে তার প্রাসাদে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হাসান দ্বিতীয় আমন্ত্রণটাই গ্রহণ করল। এটা তাকে লক্ষ্য পূরণে বেশি সহায়তা করবে।

এর মধ্যে সুন্দর আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। পাহাড় থেকে ঝড় নেমে আসছিল আর রাস্তায় ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। ওমর প্রশান্তমনেই তা গ্রহণ করলেন। তার তো বাইরে যাবার কোনো কারণ নেই, আর তিনি তখন “স্থানসমূহের প্রয়োজনীয়তা” নামের একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখছিলেন। বিভিন্ন দেশে এবং একই দেশের বিভিন্ন অংশে চার ঋতুর বিশেষত্ব, জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য আর আবহাওয়ার বৈচিত্র ছিল এর বিষয়। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন দেখতে পেয়েছিল যে ঝড় ও খরা প্রাকৃতিক কিছু নিয়ম অনুসরণ করে। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে সঠিক সঙ্কেতপ্রণালী বের করতে পারলে আগে থেকেই খারাপ আবহাওয়ার শুরু বা বৃষ্টির শেষ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া যাবে।

বৃদ্ধ মাতাকে নিয়ে তিনি যে ঘরটাতে থাকতেন সেটা সে যুগের আর দশটা ইরানি ঘরের মতই ছিল। এটা ছিল চারকোণা বর্গাকৃতির, রোদে শুকানো ইটের তৈরি। ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সেলিম ইবনে ইবরাহিম নাম কুমারের তৈরি টাইলসের ছাদ দেয়া। মাঝখানের কক্ষটাতে গম্বুজ দেয়া, আর চারকোণায় আলাদা চারটি কক্ষ। বাইরে থেকে ভিতরে বসবাসকারীদের সম্পর্কে কিছু বোঝা যেত না, আর ভিতরের আসবাবপত্রও তেমন আহামরি কিছু নয়। কিন্তু সীমিত সাধ্য সত্ত্বেও, মেঝেতে বিছানো কার্পেটগুলো ছিল দেখার মত। যেমন তাদের রং তেমনি মনোহর নক্সা। আর কাঁসার কারিগরদের দোকান ঘুরে ঘুরে ওমর চমৎকার সব কারুকাজ সংগ্রহ করেছিলেন। ছাদটাও প্রচলিত নকসায় রং করা হয়েছিল। নিজের ঘর সাজানো সম্পর্কে তাঁর মায়ের গর্ব ছিল। এমনকি সুলতান নিজেও যদি হঠাৎ করে এ ঘরে ঢুকতেন, দেখতে পেতেন যে সবকিছুই চমৎকার শৃঙ্খলায় সাজানো রয়েছে, সরল কিন্তু রাজসিক কায়দায়।

বাড়ির পিছনে ছিল ফলের বাগান, যার জন্য খোরাসান প্রদেশ বিখ্যাত। আপেল আর অ্যাপ্রিকটের পাশাপাশি উঁচু একটা খেজুর গাছ এমনভাবে বাড়িটার দিকে ঝুঁকে রয়েছে যেন ভালোবেসে তাকে রক্ষা করতে চায়। গাছে গাছে লালপেয়ে পাখিদের বাসা। ওমর পছন্দ করতেন কবুতর, যারা ‘কু’ ‘কু’ করে। শব্দটা শুনলেই ওমরের মনে হতো ‘কুজায়’, ‘কুজায়’, মানে কোথায়, কোথায়। এটা যেন স্মরণ করিয়ে দেয় যে নিশাপুর আবার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে, অতীত স¤্রাটদের জোরালো স্মৃতি বহনকারী পার্সেপোলিসের মতই পরিত্যক্ত হয়ে যেতে পারে। কবুতররা যেন এ-ও জিজ্ঞেস করতে পারে, “একদা যারা আনন্দ আর প্রাচুর্যের মাঝে বসবাস করত তারা আজ কোথায়?”***

নিশাপুরে পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল। পাহাড়গুলো থেকে শীতল জলের অনেক ঝর্ণা নেমে এসেছিল। আর গোটা সমতলজুড়ে দশ হাজার সেচনালা খনন করা হয়েছিল। শহরেও এমন সঞ্চালন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যেন প্রত্যেক বাগান পানি পায়। ফুলের ফলন ছিল অবিশ্বাস্য রকমের বেশি, আর ওমরের বাগান ছিল নানারঙের ছোটবড় গোলাপে ভরপুর। তাদের সফেদ, গোলাপী আর বিশেষত লাল রং যেন খোরাসানের তরুণীদের ঠোঁটের কথা মনে করিয়ে দিত। ওমর পছন্দ করতেন একটা বিশেষ ঝোপ যাতে একটা বিশাল গোলাপ ছিল। ফুলটির রং হলুদ হলেও এর মাঝখানটা ছিল লাল। ওমরের কাছে এই প্রস্ফুটিত গোলাপের মূল্য ছিল অমর কবিতার মতই।

পাকা উঠোনে যখন সঙ্গীতের সুরের মত বৃষ্টি নামছিল, তৃষ্ণার্ত বাগানের প্রতিটি পাতা থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছিল আর মূল জলাধারটিকে কানায় কানায় ভরিয়ে দিচ্ছিল, ওমর তখন বৈজ্ঞানিক রচনার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। কিন্তু ভাগ্যের ইচ্ছে ভিন্নরূপ ছিল। প্রাসাদ থেকে একজন সংবাদবাহক এসে জানালেন যে সুলতান তাঁর সাথে দেখা করার জন্য খৈয়ামকে অনুরোধ করেছেন। “বিষণœ আর অন্ধকার দিনে রাজপ্রাসাদ কাব্যের সূর্য কামনা করে,” সুলতান লিখে পাঠিয়েছেন। ওমর ফিরতি বার্তা দিলেন যে তিনি সম্মানের গলায় আনুগত্যের মালা পরাবেন এবং দেখা করতে আসবেন।

তাঁর মনে এ ভাবনা ঢেউ খেলে গেল যে দৈবক্রমে তিনি হয়তো আবার সেই সুন্দরীর দেখা পেতে পারেন। হয়তো সে রাজনন্দিনী, হয়তো সে সামান্য পরিচারিকা, তাতে ওমরের কিছু যায় আসে না। ভাগ্য এবারও সহায় হল। কিংবা, কামনার আগুন আরও জ¦ালিয়ে দেয়ার কারণে, একথাও বোধহয় বলা যায় যে সদয় নয় ভাগ্য বুঝি নির্দয়ই হল। দর্শনার্থীদের অপেক্ষমান কক্ষ পার হয়ে যেতে যেতে তিনি পুনরায় সেই দুই রমণীর মুখোমুখী হলেন। এবারও ক্ষণিকের দৃষ্টিপাতমাত্র, কিন্তু এর মধ্যেই ওমর বুঝতে পারলেন যে কাঙ্খিত নারী দীঘল দেহের আর ফর্সা, মসৃণকৃত হাতির দাঁতের মত দেহবল্লরী, কস্তুরিগন্ধা ঘনকালো চুল, ডালিম ফুলের মত গালের লালিমা। চোখ নার্সিসাস ফুলের মত কোমল, কিন্তু আনন্দে ঝলমল। ভুরু যেন দুই ধনুক, আর মুখম-লে পৃথিবীর সমস্ত মধুরিমা জমা। সেই নারী মুখের একপাশ থেকে আরেকপাশে অবগুণ্ঠন টেনে দেয়ার ফাঁকেই ওমর দেখে নিলেন যে তার আঙুলগুলো সরু আর কমনীয়। নখে মেহেদির হালকা প্রলেপ, আর হাতটা যেন প্রজাপতির পাখার মত সুন্দর। তবে বিশেষভাবে মন কাড়ে চোখ দুটির আবেদনময়ী দৃষ্টি, যা মূহূর্তের জন্য তাদের হাসির ছটাকে ছাপিয়ে গেল। হায় রে ওমর! একবারের দেখাতেই তার চিন্তা বারবার তোমার আবহাওয়ার হিসেব গোলমাল করে দিচ্ছিল, তুমি কি জানো না যে এই মনভুলানো তরুণী আরও কয়েকবার তোমার সামনে দিয়ে গেলে দিনরাত তুমি শুধু তার কথাই ভাবতে থাকবে!

সুলতান প্রাসাদেই ছিলেন, কিংবা বলা ভালো যে এইরকম ভরা বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়ার চেয়ে ঘরে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তিনি প্রাসাদেই বিনোদনের বিকল্প ব্যবস্থা করলেন। আসার পথে পাহাড়চূড়ায় তৈরি শিকার-আস্তানায় পরিবেশিত দুপুরের খাবারকে যদি তৃপ্তিদায়ক বলা হয়, সুলতান তার অতিথিদের জন্য আজকের দুপুরে খাবারের যে ব্যবস্থা করলেন তাকে বোধহয় ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায় যে সেই ঋতুতে যা যা পাওয়া সম্ভব সবই আয়োজনের তালিকায় ছিল। হরেক রকম ব্যঞ্জনে আহারপর্ব শেষ হলে সুলতান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে তিনি বেশ কয়েকটা ঘোষণা দেবেন। তাদের মধ্যে একটা এই যে, উজির নিজাম-উল-মুলকের পরামর্শে তিনি তার বন্ধু হাসান বিন সাবাহকে জৌলুস ও মর্যাদাপূর্ণ রাজদ- বাহকের পদে নিযুক্ত করছেন। আরেকটা হল, এখন থেকে ওমর-আল-খৈয়াম রাজকবির মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন, পাশাপাশি তিনি রাজদরবারে জ্যোতির্বিদের দায়িত্বও পালন করবেন। নিশাপুরের রাজকোষ থেকে তাঁকে বার্ষিক বারোশত স্বর্ণমুদ্রা সম্মানি দেয়া হবে।

প্রসন্নচিত্তে মালিক শাহ শাহনামার রচয়িতা মহাকবি ফিরদৌসির স্মৃতিচারণ করলেন। ওমরের মত, তিনিও খোরাসানের সন্তান, না, বলা ভালো যে খোরাসানের সূর্য ছিলেন। প্রতি পদের জন্য এক স্বর্ণমুদ্রার প্রতিশ্রুতিতে তিনি ষাটহাজার পদবিশিষ্ট মহাকাব্য রচনা করেন। কিন্তু সুলতান মাহমুদ তাঁকে স্বর্ণমুদ্রা না দিয়ে রৌপ্যমুদ্রা পাঠান। ক্ষুদ্ধ ফেরদৌসী তা গ্রহণ না করে চলে যান এবং দুঃখী ও দরিদ্র অবস্থায় নানাস্থানে কাল যাপন করেন। শেষ পর্যন্ত মাহমুদ তার ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করেন এবং ষাটহাজার স্বর্ণমুদ্রা ও নানা উপহারসামগ্রী প্রেরণ করেন। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। কবি তখন নিজের শহর তুসে বসবাস করছিলেন। উপহারসামগ্রী নিয়ে সুলতান মাহমুদের প্রেরিত দল যখন তুসের এক তোরণ দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করছিল, অন্য তোরণ দিয়ে তখন কবির মরদেহ নগর থেকে বের করা হচ্ছে, পাহাড়ের পাশে তাকে সমাহিত করার জন্য। তাঁর কন্যা সেই মুদ্রা গ্রহণ করে পিতার স্মৃতিতে স্থাপনা নির্মাণ করেন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে সুলতান মাহমুদের ভুল স্বীকারের সাক্ষ্য বহন করেছে। এরপর মালিকশাহ বললেন,

“কিন্তু, হে ওমর আল খৈয়াম, কবিতা ও বিজ্ঞানের নয়নমণি, আপনাকে সম্মান জানাতে আমরা আপনার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করব না। প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন সেরকম দিনকে বহু দূরে সরিয়ে দেন। ”

ওমর যদিও স্তুতিবাক্যগুলো শুনলেন, তাঁর চোখে তখনও সেই সজীব তরুণীর ছবি, যে ইতোমধ্যে দুবার তাঁর গমনপথে দেখা দিয়ে গেছে। তিনি স্বর্ণমুদ্রার ঘোষণাকে স্বাগত জানালেন, ভাবলেন এ অর্থ তাঁকে সুখের দরোজার সন্ধান দেবে।

আহারের পর নাচের আয়োজন করা হল। ইরাকের মসুল শহরের স্বচ্ছ রেশমী কাপড় দিয়ে নর্তকীদেও বসন এমনভাবে বুনন করা হয়েছে যেন প্রতিটি ভাঁজের সৌকর্য ফুটে উঠে, যেন প্রতিটি সৌন্দর্যের কণা আরও বেশি প্রস্ফুটিত হয়। প্রাচ্যের দক্ষ বাদকদের বাঁশির কামনাদীপ্ত সুরলহরির সাথে তাল মিলিয়ে নগ্নপদের নর্তকীরা নাচছিল। দেহবল্লরীর দোলায় কখনো তারা আরবি প্রেমগাঁথা লাইলি-মজনুর কাহিনী তুলে ধরছিল, পরবর্তীতে ফার্সি কবি নিজামী যা তার কাব্যে অমর করে গিয়েছেন। আবার কখনো তারা ঘন সন্নিবেশিত হয়ে বেঁকে গিয়ে ফুলের আকৃতি ধারণ করছিল, বাতাসের মৃদু আদরে যা দুলে আর হাসে। কখনো তারা দর্শকদের দিকে এগিয়ে আসছিল, আবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। জামশিদের পেয়ালার মত গোল সুউচ্চ বক্ষ, মুখে শৈল্পিক সুষমার হাসি, আর সম্মানিত অতিথিদের প্রতি তাঁদের প্রসন্ন অভিবাদন নিয়ে তারা নাচ চালিয়ে গেল, যতক্ষণ না দর্শকদের চোখ পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করল। 

বেহেশতে যেরকম হুরিদের দেখা মিলবে, সেরকম সুন্দরীদের নৃত্যগীত শেষ হলে প্রধান গল্প-বলিয়ের ডাক পড়ল। শুরুতে সে আনওয়ারি সুহালির কয়েকটা গল্প বলল, তারপর ধরল হারুত-মারুত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী:

“হারুত আর মারুত খোদার দুজন ফেরেশতা ছিল। দুনিয়ার মানুষেরা কেন পাপ করে আর অবাধ্য হয়, সেটা নিয়ে খোদার সঙ্গে ফেরেশতাদের তর্ক লাগল। খোদা যেন মানুষদের পক্ষ নিলেন, বললেন যে প্রেমের প্রবল প্রেষণা আর কামনা মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হারুত আর মারুত মানুষের রুপ ধরে পৃথিবীতে নেমে এল। পৃথিবীতে আসার আগে খোদা তাদের কানে কানে এমন একটা বিদ্যা শিখিয়ে দিলেন যেটা সবচেয়ে বড় ফেরেশতারাও জানত না। তারা প্রথমে ব্যবিলনে এল। তারা সেখানে মানুষের গৌরবগাঁথা দেখল, দেখল তাদের পাপময় দিকটাও। সেবার রাণী বিলকিস যেমন সুলায়মানের নিকট এসেছিল, তেমনি প্রাচ্যের সবচেয়ে সুকণ্ঠী গায়িকা জোহরা হারুত মারুতের কাছে সেই গোপন বিদ্যা জানতে এল। সে তাদেরকে গান শোনাল, এমন গান যা তারা স্বর্গেও শুনেনি। তারা তার প্রেমে পড়ল, বিশেষত মর্ত্যরে নারীসৌন্দর্যে তারা দুর্বল হয়ে পড়ল। জোহরা তাদের সামনে মদ পরিবেশন করল, আর সুরার নেশা তাদের কামনা আরও বাড়িয়ে দিল। তারা পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য ভুলে গেল আর জোহরার স্বামীকে হত্যা করল। জোহরা ফেরেশতাদের কাছ থেকে গুপ্ত মন্ত্র শিখে নিয়েছিল। সেটা পড়ে সে আকাশে উড়ে গিয়ে জোহরা তারার সাথে মিশে গেল। আকাশে মেঘ না থাকলে পশ্চিম দিকের পাহাড়ের উপরে আজও আমরা দেখতে পাই যে সোনালী বাতির মত তারাটা জ¦লজ¦ল করছে। খোদা তো জানতেন যে হারুত আর মারুত ঘোরতর পাপ করেছে। তিনি তাদের স্বর্গে ডেকে নিলেন, আর সকল ফেরেশতাদের সামনে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা তুলে ধরলেন। তারা স্বীকার করল যে কামনা আর প্রেমের বশবর্তী হয়ে মানুষদের মত তারাও পাপ করেছে, খোদা আদেশ দিলেন যে তিনি মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত ব্যবিলনের কাছে ভূগর্ভে একটা গর্তে তারা উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকবে। তখন থেকে তারা সেখানে ঝুলছে আর দুর্ভাগ্যের জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করছে। সাহসী মানুষেরা সেখানে গেলে তাদের দেখা পায় আর তাদের কাছ থেকে যাদু শিখে আসতে পারে। মুজাহিদ নামের একজন যাদুকর তাদের কাছে গিয়েছিল, আমি তার কাছে গল্পটা শুনেছি। সে বলেছে যে শিকলে বন্দী অবস্থায় আজও তারা উল্টা হয়ে ঝুলছে আর বিচারদিনের অপেক্ষা করছে এই আশায় যে তখন হয়ত তারা শাস্তি থেকে রেহাই পাবে।”

গল্প সবসময়ই আরও গল্পের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এই কাহিনী শেষ হলে নিশাপুরের গল্পকার আবদুল্লাহ বিন ইউসুফের পালা এল। সে ইব্রাহিম আর তার স্ত্রী হাজেরার গল্প বলল, বলল তাদের ছেলে ইসমাইলের কথা। কিন্তু অন্য স্ত্রী সারা হিংসুক ছিল, যার ঈর্ষার আগুন থেকে বাঁচতে ইব্রাহিম শাম দেশে চলে গেল আর বিখ্যাত মক্কা নগরী গড়ে তুলল। কিন্তু সে হাজেরাকে বুনো অঞ্চলে রেখে যেতে বাধ্য হল। একসময় তার খাবার-দাবার ফুরিয়ে গেল, এমনকি তার স্তনের দুধও নিঃশেষ হয়ে গেল, ফলে শিশুপুত্রকে কিছু খাওয়াতে পারল না। সে খোদাকে ডাকতে লাগল। খোদা জিবরাইলকে পাঠালেন। তিনি হাজেরাকে বললেন যে সাফা পর্বতে গেলে খাবার পাওয়া যাবে। সে সাফা আর উল্টোদিকের পাহাড়ে সাতবার আসাযাওয়া করল। যখন একেবারে ক্লান্ত হয়ে শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে তখন সে আবেজমজম খুজে পেল, যা তার যন্ত্রণার উপশম করল আর নতুন আশার জন্ম দিল। জিবরাইল আবার এলেন আর খোদার আশ^াসে বিশ^াস রাখার জন্য হাজেরাকে ধন্যবাদ দিলেন, বললেন যে এর পুরস্কার হিসেবে তার পুত্র ইসমাইল একটা বড় জাতির জনক হবেন, আর তার উত্তরসূরীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পয়গম্বর জন্ম নিবেন, যে সকল মানুষকে কাবা এবং ইসমাইলের পিতা ইব্রাহিমের আদর্শের দিকে আহ্বান করবে। জার্ক নামক উটের পিঠে মূল্যবান উপহারসামগ্রী নিয়ে বছরে একবার ইব্রাহিম হাজেরাকে দেখতে আসতেন। সেই ঘটনার স্মরণে এখনও ধার্মিক হজ¦যাত্রীগণ সাফা ও মারওয়ান পাহাড়ের মধ্যে সাতবার যাওয়াআসা করে আর জমজম কূপের পানি পান করে, যার ধারা কোনোদিন নিঃশেষ হবে না।

নিশাপুরের কথকের মুখে মরুভূমির কথা শুনে সুলতানের গল্প-বলিয়েও একই মরুর গল্প ধরলেন। তিনি বললেন যে দাশত-এ-নাওমিদ বা হতাশার সমুদ্রে এক দৈত্য বাস করে। রিগ-এ-রাভান বা প্রবাহমান বালির শব্দ দিয়ে সে এক অদ্ভুত বাদ্য তুলে। এর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস এমন শব্দ তৈরি করে যেন দূরে কোথাও ঢোল ও বাঁশি বাজছে। এরপর চোখের সামনে সারাব বা মরীচিকা দেখা দেয়। মনে হয় যেন একটু দূরেই জল আছে। পথচারী আরও দেখতে পায় যে চমৎকার সব প্রাসাদ যেন তাকে ডাকছে। পুষ্পপল্লবিত বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে তাকে হাতছানি দেয়। কিন্তু এগুলির কোনোটাই সত্যি নয়। হঠাৎ বালিঝড় দেখা দেয়। এটা আসলে সেই দৈত্যের পাখা। অসহায় মরুচারী অন্ধ হয়ে যায়, তৃষ্ণা আর ক্ষুধায় সেই যে পড়ে যায় আর কখনো উঠতে পারে না।

এভাবে গল্পের পর গল্প চলতে লাগল এবং আবারও ওমরের কবিতার অনুরোধ এল। তিনি দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে বললেন, যেহেতু পৃথিবীর অতুলনীয় শাসক, বিশ্বাসীদের রক্ষাকর্তা মালিকশাহ বিখ্যাত কবি আবুল কাসিম ফিরদৌসির নাম করেছেন, তিনি শাহনামা থেকেই আবৃত্তি করতে চান। দরদভরা সাবলীল গলায় তিনি পড়লেন-
    “পারদে দারি মিকুনাদ দার কাসরে কেয়সার অনকাবুত
 জোগদ নোবাত মিজানাদ বার তারামে আফরাসিয়াব”****
    “বিগত দিনের রাজার প্রাসাদে মাকড়ের জাল বোনা
    আফরাসিয়াবের পাহারাস্তম্ভে প্যাঁচাদের আনাগোনা।”*****

যে অগ্নিময় প্রকাশভঙ্গী আর আবেগ দিয়ে, যে আভিজাত্যের সঙ্গে তিনি ইরানের জাতীয় কবির কবিতা আবৃত্তি করলেন, আর বিনয় নিয়ে তিনি নিজের বদলে ফিরদৌসীর রচনা বেছে নিলেন, তা সকলের মনে গভীর রেখাপাত করল। 

ওমর জানতেন না যে চিনে তৈরি বহুস্তরের পাতলা পর্দার পিছে রাজকীয় মহিলাদের অনেকে জমায়েত হয়েছিল। তিনি যদি জানতেন যে তাদের মধ্যে তাঁর মনে স্থায়ী দাগকাটা সেই তরুণীও ছিল, যে তাঁর অনুপম ঠোঁট থেকে ঝরে পড়া প্রতিটি শব্দ আগ্রহভরে শুনছিল, তাহলে তার মনে কোন ভাবের উদয় হতো কে জানে!

ওমর আবার পদগুলো পড়লেন, তার আবৃত্তি শেষ হতেই ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেল, মেঘ সরে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। পৃথিবীকে বিদায়ী কুর্ণিশ করে অস্তগামী সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের আড়ালে ঢলে পড়ছিল। তার সোনালী রশ্মি যেন অভিজাত-দর্শন কবির মাথায় জ্যোতির বলয়ের মুকুট পরিয়ে গেল। তাঁর মুখম-ল তখনও প্রেরণার উদ্দীপনায় দীপ্যমান। মনে হচ্ছিল পারস্যের রাজকীয় সূর্য যা দিনের দীর্ঘ সময় সমতল ও পাহাড়ে রাজত্ব করেছে, কবির কথা প্রমাণ করার জন্য এবং কবিকে সম্মান জানানোর জন্য যেন ইচ্ছে করেই অস্তাচলে যাওয়ার জন্য তাঁর আবৃত্তির এ সময়টাকে বেছে নিয়েছে।

ওমর মালিকশাহকে সালাম জানালেন এবং নিজাম-উল-মুলকের সঙ্গে কয়েকটা কথা বললেন। পরদিন তাঁর সঙ্গে কাটাবেন বলে কথা দিলেন। প্রাসাদ ত্যাগের আগ মূহূর্তে যেন দৈবক্রমেই জলিম নামের খোজা তার সামনে পড়ে গেল আর হাতে একটা ছোট কাগজ গুঁজে দিল। ওমর বুঝতে পারছিলেন যে এটা কোনো গোপন সংবাদ হবে, কাজেই সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা খুললেন না। সে চলে না যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরলেন।

তাঁর মন বলছিল এটা হয়ত সেই অচেনা তরুণীই পাঠিয়ে থাকবে। আগ্রহে যেন তিনি স্থির থাকতে পারছিলেন না। দ্রুতপদে পা চালালেন, এবং যখন নিশ্চিত হলেন যে কেউ তাকে দেখছে না, তিনি সেই মূল্যবান কাগজটি খুললেন।
    এটা ছিল গ্রিক ভাষায় লেখা!
- - - - - - - - - - - - - - - - -

*ওমর খৈয়ামের অনেকগুলো রুবাইতে মাটির পাত্র আর মৃৎশিল্পীদের কথা এসেছে। মৃতদেহ মাটিতে মিশে যায়। মাটি দিয়ে পাত্র বানানোর ফলে সেই পাত্রে ওমর মৃত মানুষদের রূপক উপস্থিতি দেখতে পান, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় একদিন যে মানুষেরা ছিল আজ তারা নেই, আজ যারা আছে একদিন তারাও থাকবে না।

** ভাবার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে মূল উপন্যাসে প্রদত্ত চারটি লাইনকে ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে অনুবাদ করা হয়েছে।

*** ঔপন্যাসিক এখানে খৈয়ামের একটি রুবাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন (যদিও তিনি রুবাইটি সরাসরি ব্যবহার করেননি) যার শেষ দুটি লাইন হলো- দিদিম কে বার কোনগেরেইয়াশ ফাখতেই/বেনশেসতেহ উ মিগুফত কে কু..কু কু..কু”। এর অর্থ - দুর্গের ছাদে বসে কোকিল গাইছে কু..কু কু..কু। সে যেন জিজ্ঞেস করছে একদিন যারা এখানে ছিল আজ তারা কোথায়, আজ তারা কোথায়।

****মূল উপন্যাসে ভুল উচ্চারণে কেবল প্রথম লাইনটি দেয়া আছে। অনুবাদক যথাসম্ভব ফার্সির সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা উচ্চারণ দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় লাইনটি যোগ করেছেন। 

***** আফরাসিয়াব - তুরানি বীর, ইরানিদের কাছে খলনায়ক, যেহেতু সে তাদেরকে পরাস্ত ও ধ্বংস করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইরানিরা বিজয় লাভ করে এবং আফরাসিয়াবকে করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। কারও মতে তিনি নিহত হয়েছিলেন, কারও মতে পালিয়ে পালিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি গুহায় ভাগ্যহত অবস্থায় মারা যান। লাইনদুটির মূল কথা হল প্রবল পরাক্রমশালীরাও একসময় ইতিহাসের আড়ালে হারিয়ে যায়। ভগ্ন রাজপ্রাসাদে মাকড়সা আর দুর্গ রক্ষার স্তম্ভে প্যাঁচার বসবাস সেই ইঙ্গিত তুলে ধরে।

পরের পর্ব: সাত. উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকারী