অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

হবে হবে প্রভাত হবে, আঁধার যাবে কেটে

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

প্রকাশিত: ০৯:৩৭ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ১১:২৩ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আঁকা: যারিন দিয়া

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আঁকা: যারিন দিয়া

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকথা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি পাঠ করলে ২৮৮ পৃষ্ঠার এই বইয়ের প্রতিটি ছত্র আমাদের অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহিত করে, উদ্দীপ্ত করে। পাকিস্তানের সেই ঔপনিবেশিক আমলের বাঙালি বিদ্বেষ ও বাঙালি জাতিকে পদাবনত করে রাখার সকল অপকৌশল ও ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু যে নৈপুণ্যের সাথে লিখে গেছেন তা পাঠ করলে চোখে পানি ধরে রাখা অসম্ভব। আবার একই সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী ও প্রাঞ্জল বর্ণনার কারণে পাঠক হয়ে উঠে সঞ্জীবিত ও দৃঢ়চিত্ত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১১০ বৎসর পূর্বে রচিত কবিতার পঙক্তি ‘হবে হবে প্রভাত হবে/আঁধার যাবে কেটে’ বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনের যথাযথ প্রতিফলন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে নয়া দিল্লিতে যাত্রা বিরতির সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে বাংলাদেশ আজ থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ স্মৃতিগ্রন্থ আমাদের নতুন প্রজন্মকে পরিণতমনস্ক ও আলোকিত প্রজন্মে রূপান্তর করবে বলে আমি মনে করি। গ্রন্থটি সকল পর্যাযের শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে।বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীকে আমি তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ কেন বলছি তার অনেকগুলো কারণ আছে। এই অনেকগুলো কারণকে প্রধান দুটি কারণের মধ্যেও আবার সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত করা সম্ভব। এর প্রথমটি হলো, এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার ইতিহাসটি যত প্রাণবন্ত ও সুস্পষ্ঠভাবে পাই তা আর কোনো বইয়ে পাই না। আর তা সম্ভবও নয়, কারণ স্বয়ং বঙ্গন্ধুর স্বহস্তে দিনলিপি এই গ্রন্থের উৎস। 

১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যোগদান থেকে ১৯৫৫ তে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া পর্যন্ত ১৭ বছরের একটি নিরবচ্ছিন্ন চিত্র এ গ্রন্থে আছে। গোপালগঞ্জের মতো একটি মহকুমা শহরে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ নেতা-কর্মী থেকে তিনি এ সময়পর্বে হয়ে উঠলেন এক জাতীয় নেতা এবং এর পরবর্তী ১৬ বছরে তিনি একটি জাতির মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতির অবিসংবাদিত নেতা পরিণামে জাতির জনক হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। কোন গুনে কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর এই উল্কাসম উথ্থান বা অধিষ্ঠান তার ব্যাখ্যা এবং চিত্র আমরা এই ১৭ বছরের ইতিহাসের মধ্যে পাই। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর এ বর্ণনা আমাদের ইতিহাসের স্বর্ণখনি।

দ্বিতীয় কারণটি সম্পর্কে যদি সংক্ষিপ্তভাবে বলি তা হলো, এ বইটি শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবন বা ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, ওই ১৭ বছরের কালপর্বের সমগ্র বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসেরও একটি তাৎপযপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ এই কালপর্বটি শুধু বাংলার নয়সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ভারতের একটি পশ্চাৎপদ অবহেলিত জনগোষ্ঠেীর জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি উথ্থাপন ও ৮ বছর ধরে সেই দাবি বান্তবায়নের জন্য সংগ্রাম আন্দোলন শেষে ১৯৪৭ সালে তা আদায়কৃত রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের অগণতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আরেক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে আরেক বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা হই। বঙ্গবন্ধু এই পুরো রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যমণি হয়ে এর কেন্দ্রে অবস্থান করায় তাঁর আত্মজীবনীসূ্ত্রে আমরা এ কালের রাজনীতির একটি প্রকৃত ব্যাখ্যাসংবলিত স্বচ্ছচিত্র এখানে পাই। এ দুই প্রধান কারণের বিস্তৃত বিশ্লেষণে অগ্রসর হলে আমরা এ গ্রন্থের তাৎপর্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারব।

বঙ্গবন্ধুর জীবনবৈশিষ্ট্যের যে দিকটা আমাদের প্রথমেই আকৃষ্ট করে তা হলো, দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা। স্কুলজীবনে একজন আদর্শ শিক্ষকের এমন সেবাকার্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রমশ তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন এবং একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। এই সূত্রেই তাঁর মনে যে দেশপ্রেম অঙ্কুরিত হয় তাঁর জীবনের সকল স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাসহ সমগ্র জীবনাদর্শেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে স্মরণীয় বঙ্গবন্ধুর দুটি উক্তি। এর একটি তিনি করেছেন ১৯৪৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ গঠনের পরপর; কারামুক্তির পরে বাড়ি গেলে তাঁর বাবা যখন জানতে পারেন তিনি আর আইনশাস্ত্র অধ্যয়নে আগ্রহী নন তখন তাঁকে বিলেতে গিয়ে বার এট ল’ করার বিকল্প প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এখন বিলেতে গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন আমি করতে পারব না।’ বঙ্গন্ধুর তখনকার উপলব্ধি: আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন দরকার। জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? (পৃ. ১২৫-২৬)। মানুষের অর্থাৎ দেশবাসীর দুঃখ-কষ্ট লাঘবের কথা ভেবেই তিনি ব্যক্তিগত সুখ-স্বার্থের বিষয়টি জলাঞ্জলি দেন। দ্বিতীয় উক্তিতে তারই প্রতিফলন। কয়েকদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিলেন, তখন পুত্র-কন্যার সান্নিধ্যে সংসারের প্রতি মায়া অনুভব করেছিলেন, তাই তা ছিন্ন করার যুক্তি: ‘ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ (পৃ. ১৬৪)।

শুরুতেই তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো, যত বাধাই আসুক যে কোনো মূল্যে ন্যায়ের পক্ষ্যে অবস্থান করা। প্রবল প্রতিপক্ষের সম্মুখ থেকেও ন্যায়সংগত লড়াইয়ে পিছু না-হটাই ছিল তাঁর একান্ত বৈশিষ্ট্য। সত্য উচ্চারণে তিনি সবসময়ই ছিলেন নির্দ্বিধ, অকুতোভয়। হোক তিনি দলের নেতা কিংবা দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রভূত ক্ষমতাবান ব্যক্তি-তার সামনে, মুখের ওপর ন্যায়সংগত কথা বলতে তিনি কখনো ভীত হননি, সংকোচবোধ করেননি। জেল-জুলুম-নির্যাতন কোনো কিছুকেই পরোয়া করেননি, এমনকি ভয় করেননি মৃত্যুকেও। ফলে তিনি দেশবাসীর কল্যাণের প্রশ্নে হতে পেরেছিলেন এমন আপসহীন। কলকাতায় সোহরাওয়ার্দীর অবজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তার বাড়ি থেকে চলে এসেছেন, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় মুসলিম-হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, কলকাতা ও পরবর্তী কালে ঢাকা উভয় স্থানে দাঙ্গার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, আদমজিতে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গারোধেও পালন করেছেন সাহসী ভূমিকা, শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী তিনজনকেই তিনি শ্রদ্ধা করেছেন আবার তাঁরা যখন ভুল করেছেন কিংবা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছেন তখন সরাসরি তার সমালোচনা করেছেন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্তী খাজা নাজিমউদ্দিন ও মোহাম্মদ আলীর মুখের উপর তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এতটুকু কুন্ঠাবোধ করেননি। এসবই তাঁর নির্ভীক সত্যনিষ্ঠ মানবকল্যাণমুখী জীবনাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রন্থে বিধৃত ঘটনাবলি থেকে আমরা তাঁর চরিত্রের এসব অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।

তাঁর জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সমান্তরালভাবেই অগ্রসর হয়েছে এদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক ঘটনাধারা। ১৯৩৯ সালে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন আর তার পরের বছরই পাশ হলো ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। তারপর ১৯৪৭ পর্যন্ত কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে অবস্থান করে সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাদের ঘনিষ্ট সংস্রবে একটানা ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে একালের ইতিহাসের ভাঙ্গাগড়ার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়ে রইলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, দেখেছেন তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গা আর সাতচল্লিশের ঐতিহাসিক পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য: 

১. ১৯৪১: ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষনভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাচাঁর উপায় নাই। খবরের কাগজ “আজাদ”যা লেখে তাই সত্য বলে মনে হয় ।’ (পৃ. ১৫)

২. ১৯৪৩: ‘এই সময থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল, আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই ।’(পৃ. ১৭)

এইযে একদিকে জমিদার, জোতদার আর খান বাহাদুর নবাবদের অভিজাত শ্রেণি, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত-দরিদ্রদের অনভিজাতগোষ্ঠী-এদের সকলেই তখন মুসলিম লীগের পতাকাতলে পারস্পারিক শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব নিয়েই ঐক্যবদ্ধ। ১৯৪৭ এ বাংলা ভাগের প্রশ্নে এই বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং ’৪৭ উত্তরকালে দ্বন্দ্বটি প্রকট আকার ধারণ করলে শেষোক্ত অংশ উচ্চবর্গকে প্রত্যাখ্যান করে দলকে জনগণের প্রকৃত দলে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয় এবং জনগণের (আওয়ামী) দল গঠন করে। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৪৩ সাল থেকে দলের এই শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই সচেতনতার পরিচয় আলোচ্য গ্রন্থে বর্তমান। আরেকটি কথা এখানে স্মরণীয় যে, এ গ্রন্থ পড়তে পড়তে ওই কালের রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে অনেক প্রচলিত ‘সত্য’ ধারণা বরবাদ হয়ে যায়। যেমন, ছেচল্লিশের দাঙ্গা সম্পর্কিত ধারণা। মুসলিম লীগকেই মূলত এজন্য দায়ী করা হয়। অথচ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যে বিবরণ আমরা পাই তা ভিন্নসত্য উদঘাটন করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য: ‘কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন। …ফরোয়ার্ড ব্লকের কিছু নেতা আমাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এলেন এবং এই দিনটা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দু মুসলমান এক হয়ে পালন করা যায় তার প্রস্তাব দিলেন। আমরা রাজি হলাম। কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রপাগান্ডার কাছে তারা টিকতে পারল না‘ (পৃ:.৬৩)। ’৪৬ এর ১৬-১৮ আগস্টের বিবরণ এ গ্রন্থে আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে যে সত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এ বিবরণ তা অনুমোদন করে না। অন্য বিবরণ বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর শুধু একটি বাক্য এখানে উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। যেমন: ‘মুসলমানরা মোটেই দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না, এ কথা আমি বলতে পারি’ (পৃ. ৬৫)।

’৪৭-পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ক্ষেত্রেও দেখা যায়, বঙ্গবন্ধূর ভাষ্য থেকেই আমরা যথার্থ ধরাণাটি লাভ করি। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী কিংবা ভাসানী সকলের সম্পর্কেই ইতিবাচক-নেতিবাচক মিলে একটি সামগ্রিক মূল্যায়ন তিনি করেন। যেমন, ভাসানী সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন: ‘এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই–এ বিশ্বাস আমার ছিল’ (পৃ. ১২৮)। নেতাদের যথার্থভাবে মূল্যায়নের মতো তিনি রাজনীতির বিষয়টিকেও যুক্তিসম্মতভাবে বিচার করতে সক্ষম ছিলেন। সেজন্য ’৪৭এ প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা জিন্নাহ যখন ’৪৮ এর মার্চে ঢাকায় এলেন এবং উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলেন তখন তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলায় তাঁকে এক মুহূর্ত চিন্তা করতে হয়নি। পরবর্তী ঘটনাধারা থেকেই তিনি যথার্থভাবে উপলব্ধি করলেন, শাসকশক্তি ও শাসকদল জনবিচ্ছিন্নতার পথেই এগোচ্ছে। সুতরাং তার সাথে সম্পর্কিত থাকা অসম্ভব। তাঁর দুটি অনুভবের কথা প্রণিধানযোগ্য :

১. টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের পরবর্তী মূল্যায়ন: ‘১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মত সমর্থন করেছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় বরণ করতে হল কি জন্য? কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে। ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে যে শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে তার উল্টা। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল। এদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই আমাদের শাসকগোষ্ঠীর ।’ (পৃ. ১১৯)      
২.  ১৯৪৯ এ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনকালে কারাগারে অবস্থানকালের ভাবনা: (ক) ‘আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিৎ হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না ‘ (পৃ. ১২০)। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে উঠল আওয়ামী মুসলিম লীগ, জেলে থেকেই এর জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হলেন। তাঁর ভাবনা: (খ) ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন’ (পৃ. ১২১)।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পরপর কারামুক্তি, গোপনে লাহোরে গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে নতুন রাজনীতির বিষয়ে পরামর্শ করে আসা, বারবার কারাগারে যাওয়ার মধ্যেই বিরোধী রাজনীতিকে বেগবান করার সর্বাত্মক চেষ্টা, বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করা, কারাগারে অনশন, চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, মন্ত্রিত্ব লাভ ও হারানো প্রভৃতির মধ্যেই জনকল্যাণমূলক রাজনীতিকে অগ্রসর করে নেওয়ার এক বিরামহীন প্রচেষ্টায় রত থাকেন তিনি। ’৪৭-পরবর্তী ৮ বছরের এই নতুন অসাম্প্রদায়িক চেতনার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রকৃত রূপের ইতিহাসটি বঙ্গবন্ধুর এ গ্রন্থেই উত্তমরূপে লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজমন্ত্রটিও যুক্তিসম্মতভাবে লুকিয়ে আছে ওই রাজনীতির মধ্যে। এসব কারণেই আমি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীটিকে এ কালের তরুণদের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ বলে মনে করি। 

ভারত ভাগের পর মাত্র আট মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবসে’ তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে প্রথম কারাবরণ করেন ও পরবর্তীতে ২৪ বৎসরের ঔপনিবেশিক আমলের অর্ধেক সময় কারাগারেই অন্তরীণ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই গ্রেফতারের (১১ মার্চ, ১৯৪৮) পটভূমি ও পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে জেল থেকে মুক্তির ঘটনা সবিস্তারে আছে গ্রন্থের ৯২-১০০ পৃষ্ঠায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরপ্রতিবাদী বঙ্গবন্ধুর ভাষায় আমি বলেছিলাম, কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন- হযরত ওমরকে (রা:) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষাশতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পয©ন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। 

ঢাকার তদানীন্তন কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের সাতই আগস্ট ঢাকার শেরে বাংলানগরে স্থাপিত সাব-জেলে বসে লিখছেন ‘যখন খাতাগুলোর পাতা উল্টাচ্ছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয় বাণী এসে পৌঁছাল আমার কাছে। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম।’

বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থত্রয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এবং বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য ভাষণ, অভিভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী ও নির্দেশনা আমাদেরকে প্রতিনিয়তই আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে নতুন প্রজন্মকে আলোতে অবগাহনের জন্য আমরা যখন ‘আলো, আমার আলো, ওগো আলো ভুবনভরা’ গেয়ে শুনাই তখন সত্যিই উপলব্ধি করি আমাদের বঙ্গবন্ধুভুবন সতত থাকে ঊষার আলোয় দেদীপ্যমান। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাও নিরন্তর ভালবাসা।

অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য