অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

রুখবে আমায় কে?

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:৩৮ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২১ রোববার   আপডেট: ১১:২২ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২১ রোববার

‘প্রাইমারী শেষ করেছি, এখন আমি ক্লাস সিক্সে, রুখবে আমায় কে?’ এমন একটি স্লোগানের পাশেই বই উঁচিয়ে দৌড়ের ভঙ্গিমায় এক কিশোরী। বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাকে যখন অবৈতনিক করে দেওয়া হলো তার পর নারী শিক্ষার বিস্তারে ইউনিসেফের এমন একটি ক্যাম্পেইন বেশ সাড়া ফেলে। ২০০০ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণের সময় অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিলো সবার জন্য শিক্ষা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণের সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন শেখ হাসিনা। তিনিই ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের জন্য শিক্ষাকে অবৈতনিক করে দেওয়ার।

মেয়েদের স্কুলে টেনে নিতে, সেটি ছিলো এক দুরদৃষ্টির সিদ্ধান্ত। তারই ফলে আজ দেশের ৬৭.৬ শতাংশ নারী শিক্ষিত। অতি গ্রামের একটি কন্যা সন্তান যখন তার মাধ্যমিকের পড়াশোনার নিশ্চয়তা পায় তখন এমন করে বলতেই পারে- রুখবে আমায় কে?

একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের বিনাবেতনে অধ্যায়নের সুযোগ দেশের জন্য শিক্ষাখাতে উন্নতি বয়ে এনেছে।

প্রায় তিন দশক আগে নেওয়া বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষার বাংলাদেশ মডেল এখন অনুসরন করছে পাকিস্তান, রুয়ান্ডা, ঘানা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মেয়েদের স্কুলে যাওয়াই শুধু বাড়েনি, কমেছে বাল্য বিয়েও। এছাড়া নারীর আত্ম-নির্ভরতা, কৃষিখামার বহির্ভূত কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে। তেমনি মেয়ের বিয়ে হচ্ছে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত চাকুরে পুরুষের সঙ্গে।

এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে মেয়েদের সচেতনতা বেড়েছে। এবং তাতে তারা জন্মনিরোধক ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সন্তান জন্মদানের মাত্রা কমেছে। আর কন্যা সন্তানে অনাগ্রহের পরিবর্তে সমাজে বরং কন্যা সন্তানের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছে।

গবেষণাটি দেখিয়েছে, একটি হিসাবে মতে মেয়েদের এই শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম দেশের জন্য ২০০ শতাংশ সুফল বয়ে এনেছে।

বিশ্বব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ গ্রুপের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট শাহিদুর রহমবন খন্দকার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কনসালট্যান্ট হুসেইন সামাদ, ইকনোমিস্ট রিওতার হায়াশি এবং জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নবুহিকো ফুওয়া এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন।  

উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু করে, এবং পরবর্তী সরকারগুলো এই কর্মসূচি  এগিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে বৃত্তির পাশাপাশি স্নাতক পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করে দেওয়া হয়। এবং এরই ফল হিসেবে, মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।

মেয়েদের শিক্ষায় এই বৃত্তি কর্মসূচি সাফল্য পাওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে এই মডেল নিয়েছে পাকিস্তান এবং রুয়ান্ডা ও ঘানাসহ আফ্রিকার কিছু দেশ।

দেশের গ্রামাঞ্চলে মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের এই শিক্ষাবৃত্তি পেতে কতগুলো শর্তারোপ করা হয়েছে:
- স্কুলে ৭৫% উপস্থিতি
- ক্লাস-পর্যায়ের পরীক্ষায় ৪৫% নম্বর নিশ্চিত করা এবং
- মাধ্যমিক পর্যায় শেষ না হওয়ার আগে স্কুল না ছাড়া

গবেষকরা দেখেছেন, বছরের পর বছর এই শিক্ষাসহায়তা কর্মসূচি সার্বিকভাবে নারীর জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। এর মধ্যে রয়েছে- নারীর কর্মসংস্থান, ভালো বর পছন্দ করার সুযোগ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা।

১৯৯১ সালে দেশে বয়ষ্ক নারীদের সাক্ষরতার হার ছিলো ২৬ শতাংশ, যেখানে পুরুষের সাক্ষরতা ছিলো ৪৪ শতাংশ। ২০০১ সাল নাগাদ তা হয়, ৪১ শতাংশ নারী ৫৪ শতাংশ পুরুষ। আর ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৭২ শতাংশ নারী ও ৬১ শতাংশ পুরুষ।  

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাধ্যমিক স্তরে লিঙ্গ বৈষম্য যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে। ১৯৯৮ সালে প্রাইমারী স্কুল থেকে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতো ৪৩ শতাংশ ছেলে ও ৪১ শতাংশ মেয়ে। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা হয় ৬১ শতাংশ ছেলে ও ৭২ শতাংশ মেয়ে। 

গবেষণায় বলা হয়েছে, মূলত বাল্যবিবাহ রোধ ও শিশুদের মধ্যে মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের কারণে মেয়েরা শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার চেয়ে মাধ্যমিক স্তরে এর ইতিবাচক প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে।  

প্রতিবছর উপবৃত্তি ও ভর্তুকী হিসেবে প্রতি মেয়ের জন্য বেসরকারী স্কুলে গড়ে ৯০৬ টাকা ও সরকারি স্কুলে গড়ে ৮৪৭ টাকা খরচ করছে সরকার। যার দুই তৃতীয়াংশই দেয়া হয় উপবৃত্তি হিসেবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ মেয়েকে সহায়তা করা হয়। 

গবেষনায় জানানো হয়, উপবৃত্তি দেয়ার পর থেকে মাধ্যমিক স্তরে স্কুলে ভর্তি ও ফলাফলে মেয়েরা ছেলেদের ছাপিয়ে গেছে। এছাড়া এফএসএসএপি প্রকল্প চালুর পর থেকে নারীদের প্রথম বিবাহের গড় বয়স পুরো একবছর বেড়েছে। 
 
এই গবেষণার ফলাফল এমন সময় এসেছে যখন ইউনেস্কোর ধারণা; করোনায় পুরো বা আংশিক বন্ধের কারণে বিশ্বের অর্ধেক শিশু শিক্ষা ক্ষেত্রে লড়াই করে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০২০-২১ সালে ১ কোটির উপর মেয়ে স্কুলে ফিরে আসতে পারবে না। কারণ স্কুল বন্ধ থাকলে মেয়েদের নানা ঝুঁকি বাড়ে। অন্যান্য মহামারি বিবেচনা করলে দেখা যায়, এসময় পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় গার্হস্থ্য কাজের জন্য মেয়েদের স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।