অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-৫]

কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক

প্রকাশিত: ১২:৪০ এএম, ১৩ মার্চ ২০২১ শনিবার   আপডেট: ১০:০৯ এএম, ২৫ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার

ওমর, দ্য টেন্ট মেকার

ওমর, দ্য টেন্ট মেকার

[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ] [কিস্তি-৩ পাহাড়ি উদ্যান] [কিস্তি-৪. পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ]

পাঁচ: হাসান বিন সাবাহর কাহিনী

“সে সব দিনের কথা তিনজনেরই মনে আছে,” হাসান বিন সাবাহ বলতে শুরু করল, “আমরা যখন ওলামাশ্রেষ্ঠ ইমাম মোবাফফাক উদ্দিনের কাছে পড়তাম। তোমাদের কি মনে পড়ে তাঁর সেই দুর্বল আর কাঁপা কাঁপা গলায়, পঁচাশি বছর বয়সেও কেমন করে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার তুলে ধরতেন, আইনের দুরুহ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতেন? আর আমরা কী রকম উচ্চাশা পোষণ করতাম! কারণ আমরা জানতাম যে এই ইমামের ছাত্রদের প্রায় সবাই খ্যাতির পাহাড়ে বহুদূর উঠত। আমাদের চুক্তিটাও নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। সবাই না হলেও, আমাদের কেউ না কেউ অবশ্যই সৌভাগ্যের চূড়ায় উঠবে। কাজেই আমি প্রস্তাব করেছিলাম, আমাদের যে-কারোরই ওরকম সুদিন আসলে আমরা তা সমানভাবে ভাগ করে নেব, আর সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে বলেই তার ওপর তার অগ্রাধিকার থাকবে না!”

“আমরা তখন ছেলেমানুষ আর অত্যুৎসাহী ছিলাম,” নিজাম-উল-মুলক বলল। “আমরা তখন জ্ঞানহীন ছিলাম। পরিণত বয়সে ছেলেবেলায় তাড়াহুড়া করে করা প্রতিজ্ঞার মূল্য নাও থাকতে পারে।”

তিনি এই কথা বললেন আসলে হাসান বিন সাবাহকে পরীক্ষা করার জন্য। ওমর অবাক হয়ে হাসানের দিকে তাকালেন। সে কেমন করে এ কথা বলতে পারল। একজন মহৎ উজিরকে বহুকাল পূর্বে করা চুক্তি মনে করিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা তিনি মোটেই পছন্দ করলেন না। হাসান কিছু বলল না। আবার নীরবতা নেমে এল। কিন্তু নিজাম-উল-মুলক হাসানের কথা শোনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে চাইলেন না।

“এটা কি সম্ভব,” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি সম্ভব যে তোমার মত একজন তুখোড় মেধাবি ওস্তাদের শিক্ষা থেকে কোনো ফলই পাওনি? আমাদের বিশ^াস ছিল তুমি অনেক দূর যাবে, অনেক উপরে উঠবে আর সৌভাগ্যশালী হবে। এরপর কি পৃথিবীর গতিপথ বদলে গেছে? গ্রহ-নক্ষত্ররা কি তোমার ভাগ্যের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে? ওমর কি তারাদের অবস্থান হিসাব করে বলেনি যে সৌভাগ্যের লক্ষণ নিয়ে তোমার জন্ম হয়েছে? তোমার স্বপ্ন কি পূরণ হয়নি? এ বছরগুলো তোমার কী করে কাটল আমাদেরকে সে খবর শোনাও।”

“নিশ্চয়ই শোনাবো,” হাসান বললো। “ওস্তাদ মোবাফফাকের কাছে চার বছর বিদ্যাশিক্ষা করে আমি রেই শহরে নিজের পিতার কাছে ফিরে যাই। বাবার অবস্থা তখন বেশ ভালো ছিল।”

ওমরের মনে পড়লো যে হাসানের পিতা আলীর নামডাক ছিল, কিন্তু লোকে তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত। সেই সুদূর আরক থেকে আসলেও সেই পরিচয় হাসানের পিছু ছাড়েনি।
 
“পিতা আমাকে বললেন,” হাসান বলতে থাকল, “বাবা, ভ্রমণ মনকে চুড়ান্ত উৎকর্ষ দেয়। তুমি যে জ্ঞান অর্জন করেছ তাতে আমি সন্তুষ্ট। তুমি নিঃসন্দেহে একজন খতিব হবার যোগ্যতা অর্জন করেছ। চাইলে মাদ্রাসায় যোগ দিয়ে আরবি ভাষা আর সাহিত্যের সৌন্দর্য ছাত্রদের শেখাতে পার। তোমার লেখনি চমৎকার, হিসাব-কিতাবেও তুমি দক্ষ। কোনো প্রদেশের শাসনকর্তার ডানহাত হিসেবেও তোমাকে মানাবে। তুমি মুফতি হবার, এমনকি উজির হবারও উপযুক্ত। তুমি নিশ্চয়ই সফল হবে। তবে তুমি যা অর্জন করেছ তার ওপর পরিমার্জনের শেষ প্রলেপ বুলানোর জন্য দেশভ্রমণ করা প্রয়োজন। এই একতোড়া স্বর্ণমুদ্রা নাও, আর নিজ চোখে পৃথিবীটা দেখতে বেরিয়ে পড়।” আমিও যে অনিচ্ছুক ছিলাম তা নয়। তখন বয়স ছিল অল্প, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। একজন চাকর আর বাবার সবেচয়ে ভালো ঘোড়াটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ইরানের প্রদেশগুলোর মধ্যে আরক বেশ বড় আর উর্বর। সেটা ঘুরেফিরে দেখাটা খুব ভালো হত। কিন্তু আমার চোখকে টানল আরক নয়, বরং ইরাকের বাগদাদ নগরী, যাকে তখন দারুসসালাম বা শান্তির নিবাস বলা হত। কিন্তু নিজাম-উল-মুলকের কাছে এ নগরীর দুইশত টাওয়ারশোভিত অলঙ্কৃত দেয়ালের কথা বলার দরকার নেই। তিনি তো নিজেই দারুস সেদরেস্ত বা বৃক্ষের প্রাসাদ দেখেছেন, যার সোনা-রুপায় তৈরি থামগুলো এমনভাবে তৈরি যেন ফুল-ফলসমেত গাছের মত দেখায়, যেখানে পান্নাশোভিত পাতার ফাঁকে ফাঁকে মাণিক্য-খচিত পাখিরা আনন্দের গান করে। আর এখানে-ওখানে সৈনিকের মূর্তি, সুদৃশ্য কাপড় আর মণি-মুক্তোর সাজ পরে তারা যেন প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে। এসকল ঐশ^র্যের খবর ইস্পাহানে পৌছেনি কি? নিশ্চয়ই তারা তা জানে। বাবা তো আমাকে দুনিয়াটা দেখতেই পাঠিয়েছেন। কাজেই আমি বাগদাদে গেলাম। আমি সঙ্গে করে সুপারিশপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম, কাজেই সুলতানের কাছ থেকে বিরাট কিছু আশা করছিলাম। আমাকে বেশ সদয়ভাবে অভ্যর্থনা করা হল। আমার আরবি ভাষা আর আইনসংক্রান্ত জ্ঞানও আমার মর্যাদাপ্রাপ্তিতে সাহায্য করল। কিন্তু আমার এ যোগ্যতা ঈর্ষারও সৃষ্টি করল। আমার নামে নানান কথা বলে সুলতানের কান এমনভাবে বিষিয়ে তোলা হল যে নিজের পুরো দক্ষতা দেখাবার সেরকম কোনো সুযোগই পেলাম না। আমাকে সবসময়ই হুমকির মধ্যে থাকতে হবে সেটা জানার পরও সেরকম পদের জন্য লালায়িত থাকব আমি কখনোই এতটা উচ্চাশা-পীড়িত ছিলাম না। কাজেই আমি বাগদাদ থেকে পালালাম - তবে একেবারে খালি হাতে নয়। যে কয়টা সুযোগ এসেছিল সেগুলোই কাজে লাগিয়ে কিছু মণি-মুক্তো কিনতে পেরেছিলাম, আর শহরটিতে সেগুলো বেশ সুলভই ছিল। সেখান থেকে আমি মিশর গেলাম এবং আধ্যাত্মিকতার নানান দিক নিয়ে পড়াশুনা করলাম। যেসকল শিক্ষা মুসা নবিকে বিখ্যাত করে তুলেছিল সেগুলোর কিছু ভগ্নাংশ মিশরে তখনও অবশিষ্ট ছিল। আমি সেখানে এমন ধর্মবেত্তাদের সাক্ষাৎ পেলাম যারা আধ্যাত্মিকতার শিক্ষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। অতীতের মহান সাক্ষীস্বরূপ দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডগুলো দেখলাম। স্ফিংকসের ধাঁধাঁও আমাকে শেখানো হল। কায়রোতে আমাকে একটা গুপ্ত মতবাদের আস্তানায় ভর্তি করে নেয়া হল। মিশর থেকে যা যা পাবার ছিল আমি সবই পেলাম, এবং বিশ^াস করতে শুরু করলাম যে আমি অলৌকিক ঘটনাও ঘটাতে পারব!”

এসব কথা বলতে বলতে তার চোখে আবার সেই আগুন জ¦লে উঠল। এটা কি পাগলামির চিহ্ন, নাকি প্রতিভার? যেটাই হোক না কেন, এটা তার দুই শ্রোতাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। দুজনের কেউই পুরনো বন্ধুর সাথে সহজ হতে পারলেন না। হাসান বলে চলল- 
“আমি স্পেনে মুসলিম রাজত্বের কথা শুনেছিলাম। সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভূমধ্যসাগর জুড়ে সূর্যকে অনুসরণ করতে করতে আমি স্পেনে পৌছুলাম। জানি না আর কোনো মুসলিম আমার মত এতটা ভ্রমণ করেছে কি-না। আমার ব্যাপক অভিজ্ঞতার কারণে সেখানেও সমাদৃত হলাম। মেধাদীপ্ত ব্যক্তির প্রয়োজন সবখানেই আছে। খৃষ্টানরা তখন বিশ^াসীদের চেপে ধরেছে। আমি খলিফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আফ্রিকান মুসলিমদের শক্তিমত্তার কথা বললাম। ‘আমরা একই ধর্মে বিশ^াসী.’ আমি তাকে বললাম। ‘দ্যাখো, আমার বাড়ি ইরানে অবস্থিত আরকের রেই শহরে, কিন্তু আমিও তোমার মতই নবীর অনুসারী।’ খলিফা আমার কথা পছন্দ করলেন, কিন্তু  আবারও ঈর্ষা আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। আমাকে উচ্চাকাঙ্খী বলে অভিয্ক্তু করা হল, এমনকি এমনও রটনা করা হল যে আমি খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাই। কিন্তু একথা তেমনই অসত্য, যেমন যদি কেউ বলে যে তুমি, হাসান আল তুসি, তোমার সুলতান মালেকশাহকে সিংহাসনচ্যুত করতে চাও! সত্য হোক আর না হোক, এ অভিযোগের কারণে আমাকে চড়া মূল্য দিতে হল। আমাকে গ্রেফতার করে নোংরা কক্ষে রাখা হল, যেন ক্ষুধায় মরে যাই নয়ত ইঁদুরেরা আমাকে খেয়ে ফেলে। ভাগ্য ভালো যে আমি কতগুলো মণিমুক্তো বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। এগুলোর একটা কারাধ্যক্ষকে ঘুষ দিলাম যেন আমাকে পালাতে দেয়। জুতোর তলা থেকে স্পেনের ধুলো মুছে ফেলে দীর্ঘদিন এখানেওখানে ঘুরলাম, তারপর নিজ শহরে ফিরে এলাম। বাবা তখন মারা গেছেন। আর তার ভাই, মানে আমার কাকা আমাদের বাড়ি দখল করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে তার কাছে বাবার একটা ঋণের কারণে তিনি এর মালিক হয়েছেন। তবে উত্তরাধিকারের কিছু অংশ আমার জন্যও রেখেছেন। সেটা পরিমাণে খুব বেশি নয়, যদিও আমার বাবা ধনী ছিলেন। কাকা বলেছেন যে বাবা লোকসানে পড়েছিলেন, সেগুলো পরিশোধ করার পর যা অবশিষ্ট ছিল তা-ই তিনি আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কাকা সেগুলো ভোগ করতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে যখন ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল, তখন আমাদের এসব যুক্তিতর্ক অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল। কাকার বাড়ি যা বাবার ছিল এবং আমার মণি-মুক্তোর থলি সবই এমন লোকদের হাতে পড়ল যারা অন্যের বোনা বীজে ফসল তুলতে অভ্যস্ত। রেই শহরের উপর দিয়ে পাহাড়ি টর্নেডোর মত কুর্দিদের আক্রমণের ঝড় বয়ে গেল। বাজার লুট হল এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হল। গণ্যমান্য লোক এবং তাঁদের পরিবারবর্গ গ্রেফতার ও বন্দী হলেন। ছোট বাচ্চাদেরকে পাথরে আছড়ে ফেলা হল আর রাস্তায় তাদের রক্তের ধারা বয়ে গেল। প্রতিরোধের চেষ্টা ছিল বৃথা। আমার চাচা - আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুন - তার লুকানো ধন-সম্পদ দেখিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। প্রথমে তিনি মুখ খুলতে চাননি, কিন্তু অকুস্থলে হত্যার হুমকি দেয়া হল তখন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং জীবন ভিক্ষা চাইলেন। আমি একনজরে দেখলাম যে দামী অলঙ্কার এবং পাত্রসমূহ - যেগুলো বাবার অহঙ্কার ছিল- একে একে দস্যুদের থলেতে ঢুকল। তারা আমার স্বর্ণের থলিটিও ছিনিয়ে নিল। আমার চাচা এবং আমি, যার সম্পদ তিনি লুট করেছিলেন, আমরা উভয়ে সমান দুর্ভাগ্যে নিপতিত হলাম। আমাদেরকে এমন দ্রুত গতিতে পায়ে হাঁটিয়ে নেয়া হচ্ছিল যে আমারও কষ্ট হচ্ছিল। শীঘ্রই আমার চাচার শক্তি ফুরিয়ে গেল। তিনি কয়েকবার পড়ে গেলেন, কিন্তু তাকে কোনরুপ রেহাই দেয়া হল না । অবশেষে গোটাদল একস্থানে থামল।  এখানে লুটের মাল ভাগ করা হল।  দুষ্কৃতিকারীরা তিনটি আলাদা গোষ্ঠী থেকে এসেছিল। তারা পৃথক পথে চলে গেল। আমি আর কোনোদিন আমার চাচাকে দেখিনি। একদল তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, আমাকে অন্যদল। তার প্রতি যদি আমার কোনো বিরাগ থেকেও থাকে, আমার মনে হল তিনি এখন শাস্তি ভোগ করছেন। তার প্রতি কিছুটা কৃপাও জাগল, কেননা তিনি নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এবং সম্ভবত আর কোনোদিন তাদের দেখতে পাবেন না। কয়েক বছর বা কয়েক মাস, যে কদিনই বাঁচবেন বাকি জীবনটা তাকে কোনো কুর্দি গ্রামে দাস হয়েই কাটাতে হবে। 

“আমার অবস্থাও যে খুব ভালো ছিল তা নয়, কিন্তু আমি বয়সে তরুণ এবং কিছুটা ধূর্তও। এর চেয়েও বাজে পরিস্থিতিতে আমি পড়েছি। আমি খোদার নাম জপতে লাগলাম আর ভাগ্যের মোকাবেলা করলাম।”

“কিন্তু তুমি পালালে কীভাবে?” নিজাম-উল-মুলক জিজ্ঞেস করলেন। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তার কাহিনী শুনছিলেন। যদিও তার সন্ধিগ্ধ মন হাসানের গল্পে ফাঁকফোকড় আছে কি না সে বিষয়েও সজাগ ছিল। 

“সেই পুরনো কাহিনী। নারীর কারণে পুরুষ পতিত হয়, আবার তারা আমাদের উদ্ধারও করে। পাহাড়ি গ্রামের শেখের ভাই আমাকে নিয়েছিল। প্রথম প্রথম আমাকে কঠিন পাহারাদারিতে রাখা হত; কাঠের একটা তক্তা আমার পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এমনকি এখনও সেই বাঁধার দাগ আমার পায়ে রয়েছে।”

হাসান কাপড় একটু তুলে তার পায়ের গোড়ালি দেখাল। দাগটা তখনও স্পষ্ট দেখা যায়। 

“কিন্তু আমি কোনো অভিযোগ জানালাম না। কারণ জানতাম যে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। বন্দীদের মধ্যে যারা তাদের ভাগ্যের শীতল বরফ কিছুটা গলাতে পেরেছিল সেটা তাদের চোখের জলে নয়, বরং কঠোর পরিশ্রম আর নিজ নিজ মালিকের সেবার মাধ্যমে অর্জন করেছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হাসিখুশি থাকব আর ভালো ব্যবহার করব, যদিও বিষণœতাই আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমি শিখেছিলাম যে কেউ চাইলে সম্পূর্ণভাবে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দ্রুত তাদের ভাষা শিখলাম। স্রষ্টা মহান। তিনি তার বান্দাদের অন্য অনেক জিনিসের উপর কর্তৃত্ব দিয়ে থাকেন। গ্রামপ্রধানের স্ত্রী আমার উপর সদয় হলেন। আমার নবী ইউসুফ আর জুলেইখার কথা মনে পড়ল। আমি ঠিক করলাম এমনকি ইউসুফের চেয়ে আরও বুদ্ধিমানের কাজ করব। তিনি ছিলেন ককেশিয়ান অঞ্চলের সুন্নী তরুণী। তার ভাইয়ের কাছ থেকে আমাকে তার নিজের কাছে নিয়ে আসার জন্য তিনি তিনি গ্রামপ্রধানকে রাজি করালেন। কিন্তু এই নারী অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিল। স্ত্রীর উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামপ্রধান কোনো সন্দেহ করেনি। কেবল সেই রমণী একাই জানত, আর আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা হত।  আমি মোটামুটি ধীরস্থির থাকলাম, এবং পালানোর কোনো চেষ্টা করলাম না। নানান বিদ্যা জানা থাকার কারণে আমি তাদের বিভিন্ন উপকার করতে পারলাম। আস্তে আস্তে আমার বাঁধন শিথিল করে দেয়া হল। আমি ঘোড়া ভালোবাসতাম, আর সেগুলোকে পোষ মানাতে পারতাম। এমনকি সবচেয়ে বুনো ঘোড়াকে বশীভূত করাও আমার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না। আমার মালিক এক ইরানি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটা স্ট্যালিয়ন দখল করেছিলেন। ঘোড়াটা ছিল তরুণ, এবং তখনও পর্যন্ত প্রশিক্ষণ পায়নি। প্রাণশক্তিতে ভরপুর কিন্তু দুষ্টু বুদ্ধিতে খোদ শয়তানের দোসর। আমি তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার প্রস্তাব দিলাম। আমাকে সেই সুযোগ দেয়া হল। আমি ঘোড়াটাকে বশ মানালাম আর ধাবা নাম দিলাম। জাহাজ যেরকম কাপ্তানের কথায় চলে ওটাকেও তেমনি আমার কথা বুঝতে ও মানতে শেখালাম। সে আমাকে তার প্রভু হিসেবে ধরে নিয়েছিল। হাতের একটুখানি চাপ পেলেই সে সংকেতমত ডানে বা বামে মোড় নিত, অথবা এমনভাবে স্থির দাঁড়িয়ে থাকত যেনবা গ্রানাইট পাথরে খোদাই মূর্তি।

“প্রাণপ্রিয় ভাইয়েরা আমার, তোমাদের কী করে বোঝাব ঘোড়াটাকে আমি কত ভালোবাসতাম! আর সেও আমাকে কম পছন্দ করত না। তখন বুঝলাম আমার সুযোগ এসেছে। আমি বশীকরণের কিছু কায়দাকানুন জানতাম। লায়লা, মানে আমার মালিকের স্ত্রীকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর মালিকের কিছু রতœ নিয়ে আমার একটা জায়গায় চলে আসতে বললাম। গোপন আস্তানাটার কথা সে জানত। আর আমার কথা শুনতেও সে অনিচ্ছুক ছিল না। আমি বরাবরই মেয়েদের মন জয়ে পারঙ্গম ছিলাম; তারা সম্ভবত আমার চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে পারত না, কিন্তু তবুও এর ইশারা মানত। আমি বাইরে গেলাম এবং সহজেই ধাবাকে ধরলাম। একজন কুর্দির দায়িত্ব ছিল আমার উপর চোখ রাখা। তার সন্দেহ হল যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। সে আমাকে থামাতে চেষ্টা করল। আমি তাকে একটা ঢিবির আড়ালে নিয়ে গেলাম, এবং সে চীৎকার করার আগেই একটা ছুরি হৃৎপিন্ডে ঢুকিয়ে দিলাম। লায়লাই ছুরিটা কিনে দিয়েছিল। তারপর তাকে এমনভাবে শুইয়ে দিলাম যেন সে রোদে ঘুমোচ্ছে। কেউই কোনো সন্দেহ করল না। 

“কথামতই লাইলা চলে এল। জানতাম যে নষ্ট করার মত সময় একদম নেই। তাঁকে আমার পেছনে বসালাম আর ধাবার কানে ফিসফিস করে কিছু বললাম। সে তৎক্ষণাৎ চলতে শুরু করল। যতদিন আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বইবে ততদিন সে বুনো যাত্রাটার কথা ভুলব না। পথঘাট কিছু চিনি না, কেবল সূর্যের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম কোনদিকে যাচ্ছি। যে-কোনো সময় আমরা গ্রামপ্রধানের লোকদের সামনাসামনি পড়ে যেতে পারতাম। তখন কী যে ঘটত ভাগ্যে! নিশ্চয়ই আঘাতে আঘাতে মৃত্যু। বিশ^াস ছিল যে ধাবা আমাদের দুজনকে নিয়ে নিরাপদে চলতে পারবে। এটাও জানতাম যে দুজনকে নিয়েও সে আমার মালিকের যে-কোনো ঘোড়ার চেয়ে দ্রুতবেগে দৌড়াতে পারবে। কিন্তু দৈবক্রমে যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে লায়লাকে নিয়ে কী করব সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার সৌভাগ্যের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে সে তার স্বামীকে ছেড়ে এসেছে, কিন্তু সে সৌভাগ্য কোথায় পাব? প্রথমেই মনে এল খোরাসানের রতœ নিশাপুরের কথা, যেখানে আমি পড়ালেখা করেছিলাম। মনে পড়ল সহপাঠী ওমর খৈয়ামের কথা, যে হয়ত আমাকে আরেক বন্ধু নিজাম-উল-মুলকের কথা আরও বেশি বলতে পারবে। তার খ্যাতির কথা অবশ্যি আমি এমনিতেও আমি নানান জায়গায় শুনতে পাচ্ছিলাম। দুয়েকদিন আগে আমি নিশাপুর এসে পৌছেছি, আর দেখতেই তো পাচ্ছ কী দরিদ্র অবস্থায়! আশঙ্কা হল এতবড় বিজ্ঞানীর কাছে এভাবে যাওয়া যায় না। তবু সাহস করে তাঁর বাড়ি গেলাম। বাড়িটা পেতে আমাকে অনেক খুঁজতে হল। সহজে পাবার কথাও নয়, নিশাপুরের লোকসংখ্যা ততদিনে তিনগুণ বেড়েছে। সেই মহীয়সী রমণী, ওমরের মাতা আমাকে চিনতে পারলেন, যদিও তাঁর চোখে আগের সেই দৃষ্টিশক্তি ছিল না। তিনি কণ্ঠ শুনে আমাকে চিনলেন। তিনি বললেন যে তার ছেলে মানে ওমর সুলতান মালিক শাহের উজিরের সঙ্গে দেখা করতে গেছে, ফিরতে হয়ত কয়েকদিন দেরি হবে। তিনি আমাকে বাড়িতে থাকতে বললেন। লায়লাকে সেখানে রেখে এসেছি। আমি তীর্থযাত্রীর পোষাক পরেছি, লোকের মনে যেন সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। আমি দেখতে চাই যে সুলতানের উযির তার কথা রাখেন কিনা। সেজন্যেই এখানে উপস্থিত!”

কোনো সন্দেহ নেই যে হাসানকে নানান পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিভিন্ন ভঙ্গিমা আর গলার স্বরের উঠানামা যোগ করে নিজের বন্দীত্বের গল্পকে সে যথেষ্ট নাটকীয় করে তুলেছে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা সংশয়ের জায়গা ছিল, যেন সে কাহিনী বলে গেছে মাত্র, নিজে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি। 

তিন বন্ধু সরাইয়ের সামনে রোদে কিন্তু ঠান্ডা বাতাস থেকে আড়ালে আরাম করে বসল। চাকরেরা গালিচা আর বালিশ বিছিয়ে দিয়েছিল। তারা ইরানিদের অবসর কাটানোর প্রিয় পদ্ধতি অতীতের গল্পে মশুগুল হয়ে গেল। তারা যেখানে বসেছিল সেখানকার দৃশ্যও পাহাড়ি খাদের উপত্যকার চেয়ে কম সুন্দর ছিল না। গোটা উপত্যকার উপর ঈষৎ বেগুনি কুয়াশার একটা স্বচ্ছ ঝিল্লী ঝুলছিল, যা পুরো নিসর্গটাকে কাব্যময় করে তুলেছিল। দূরের পাহাড়গুলোর প্রান্তরেখাগুলো আরও দূরের আর নিরীহ মনে হচ্ছিল। কেবল গাঢ়তর ছায়াগুলো দেখে তাদের পাশের গিরিখাতগুলো অনুমান করা যাচ্ছিল। কেউই কল্পনা করবে না যে আর মাত্র কয়েক মাইল দূরেই মরুভূমির অবস্থান। পশ্চিমে কয়েকখ- মেঘ জমেছে, তারা একটা রাজকীয় সূর্যাস্তের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল।

উমরের উৎকর্ণ কান মনে হল একটা হাসির ঝলক শুনতে পেল, যা চকিতেই মিলিয়ে গিয়েছিল। তিনি উপরের দিকে তাকালেন, কিউপিডের তীরের মত দেখতে, কৌতুকময় একজোড়া বড় চোখের অপরূপ একটা প্রাণী দেখতে পেলেন। তিনি যা ভাবলেন তাই কি ঠিক? - ওটা কি একটা পাহাড়ি জীব, যা ইরানি কবিদের কাব্য রচনায় প্রেরণা দিয়েছে, নাকি তাঁর চোখের ভুল? তিনি মূহূর্তমাত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারপর রহস্যের পর্দা উঠে গেল। তিন বন্ধু দেখতে পেল যে অন্দরমহল থেকে দুজন রমণী দ্রুতবেগে কোথাও যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে দুজন খোজাও ছিল, যারা দূর থেকে চীৎকার করে এই তিনজনকে সাবধান করে সাবধান করে দিল। কিš ‘তারা যখন নিজাম-উল-মুলককে চিনতে পারল তখন নিচু হল আর মাটিতে চুমু খেল। 

চোখের একটামাত্র তীরও কখনো কখনো হৃদয়কে বিদ্ধ করে। ওমর, আমাদের কবি ওমর খৈয়াম সেই স্বর্গীয় দৃষ্টি কখনো ভুলতে পারেননি। তিনি ভুলে গেলেন যে নিজাম-উল-মুলক যে খোজাটাকে আগা জালিম বলে সম্বোধন করলেন, সে রমণীদ্বয়ের একজন শাহযাদী বানুর সঙ্গে কথা বলেছিল। তিনি সূর্যাস্তের দিকে তাকাতে ভুলে গেলেন, যদিও তখনো মেঘমালা সোনালী রং ধারণ করছে, আর পাহাড়চুড়াগুলো রাজকীয় বেগুনি রঙ দেখাচ্ছে।
 
তিনি যেন নিজেকেই বললেন, “যে একবার দেখেছে সে তো দুবারও দেখতে পারে।” তিনি একজন পুরুষ এবং একজন কবি। তিনি জানেন যে ঝাউগাছের মত ঋজু হরিণ-নয়না সুন্দরী মূহূর্তের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়েছে। দৃষ্টির সেই বিদ্যুতরেখায় যেন ওমরের ভেতরের সবই প্রকাশ পেয়ে গেল; আশা, ভয়, আকাঙ্খা, আনন্দ - তিনি নিজেও জানতেন না যে তার মনের গহিনে তারা বাসা বেঁধে ছিল। বিগ্রহ স্থাপনের পূর্বেকার শূণ্য মন্দিরের মত তার হৃদয়ও এক আদর্শ মানবীর অপেক্ষায় ছিল। আজ বুঝি তার দেখা পেলেন।

ভালোবাসা অনেক দরোজা খুলে দেয়, কিন্তু অর্থ তার চেয়েও শক্তিশালী। পূর্বে যদিও ওমর উজিরের কাছে কিছু না চাওয়ার বা তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর সেই দ্বিধা মিলিয়ে গেল। তার হৃদয় ও মস্তিষ্কে মূহূর্তের মধ্যেই এই বিপ্লবটা ঘটে গেল, কিন্তু তিনি জানতেন যে তাঁকে অনেক সাবধানে অগ্রসর হতে হবে। ঠিক সেই সময়ে ডামাঢোলের শব্দে বোঝা গেল যে শিকার পর্ব শেষ হয়েছে, সুলতান ও সঙ্গীরা ফিরে আসছেন। কাজেই মালিকশাহের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিজাম-উল-মুলক ও হাসানের সঙ্গে তিনিও দ্রুতপদে রওনা দিলেন।

পরের কিস্তি: প্রাচ্যের দ্বারমণ্ডপ