অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নিউইয়র্ক টাইমসের কলাম

আমেরিকান শিশুদের দারিদ্র্যমুক্ত করতে বাংলাদেশ থেকে শেখার পরামর্শ

বিশেষ সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১১:০৪ এএম, ১১ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার  

বাংলাদেশের এক পল্লী শিশু, ছবি: রিডাক্স থেকে

বাংলাদেশের এক পল্লী শিশু, ছবি: রিডাক্স থেকে

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের মতামত কলামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনামটি এমন 'দারিদ্র্যের জন্য বাইডেন কি করতে পারেন? বাংলাদেশের দিকে তাকান'। শিরোনামের নিচেই একটি ছোট্ট টিজার। তাতে লেখা হয়েছে, দেশটি তার জন্মের ৫০ বছরে পড়েছে এবং তার বিষ্ময়কর সাফল্য আজ বিশ্বকে শেখাচ্ছে বিনিয়োগ করতে হবে সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য। লেখাটির সঙ্গে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। সেটি বাংলাদেশর এক এক গ্রাম্য স্কুলশিশুর। সাদা কামিজ পরা মেয়ে শিশুটি একটি বিস্তীর্ণ মাঠে তার বুক সমান উচু বুনো ঘাষের দঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছে। তার মুখে এক অমলিন হাসি। নিউইয়র্ক টাইমসের মতামত কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ নিবন্ধটি লিখেছেন। আর ছবিটি রিডাক্সের তাদেজ জিডারসিসের তোলা। 

ক্রিস্টফ লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় মর্মবেদনাগুলোর একটি হচ্ছে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনি ও সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটিকে আজ মেনে নিতে হচ্ছে একটি চরম বাস্তবতা- শিশু দারিদ্র্য। সবশেষ আইনি অনুমোদন পেয়ে বাইডেন প্রশাসন ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান (আমেরিকান উদ্ধার পরিকল্পনা) হাতে নিয়ে এই মর্মবেদনা ঘোচাতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই প্যাকেজের অধিকাংশ ব্যবস্থাই শিশুদের দারিদ্র্য কমিয়ে আনার জন্য। আর এই ব্যবস্থা যদি স্থায়ীভাবে নেওয়া যায় তাহলে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে- এতে শিশু দারিদ্র্য অর্ধেকে নেমে আসবে। কিন্তু অর্ধেকে নামিয়ে আনলে কি চলবে? এমন প্রশ্ন তুলে নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন, বাইডেনকে শিশুদের জন্য তেমনই কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমনটা সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট। এটা হলে তা আমেরিকান নীতির ক্ষেত্রে একটা অভ্যুত্থান ঘটবে, এবং গরীব শিশুদের জন্য বিনিয়োগে সমাজকে একটা ঝুঁকি নিতে হয় দেরিতে হলেও তার স্বীকৃতি মিলবে। 

এরপর ক্রিস্টফ যা বললেন, তা প্রনিধানযোগ্য। তিনি বললেন, এর মধ্য দিয়ে সুফল যে আসে সেটা বুঝতে হলে পৃথিবীর অপরপীঠ থেকে পাওয়া একটি শিক্ষার দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।  

আমেরিকার অপরপীঠের এই দেশটি বাংলাদেশ। 

নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন, এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, অবহেলা, বঞ্চনা আর ক্ষুধা-দারিদ্রের মধ্যে থেকে আজ থেকে ৫০ বছর আগে ঠিক এই মাসে বাংলদেশের জন্ম। হেনরি কিসিঞ্জার তখন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উল্লেখ করেছিলেন। দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা-পীড়িতের ছবিগুলো এই দেশকে নিয়ে স্রেফ হতাশার একটি প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরেছিলো। 

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভয়াবহ ঘূর্ণঝড়ে ১ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটলো। সে ঘূর্ণিঝড় কাভার করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন নিকোলাস ক্রিস্টফ। সেবার তার লেখা একটি নিবন্ধের কথা স্মরণ করেন তিনি। ক্রিস্টফ বলেন, সেবার আমি দেশটিকে "দুর্ভাগা" বলেই উল্লেখ করেছিলাম। তখন ঠিকই বলেছিলাম কারণ তখন বাংলাদেশ কেবল জলবায়ুর ঝুঁকিতেই নয়, আর নানা কারণে ঝুঁকিগ্রস্ত একটি দেশ ছিলো। কিন্তু সার্বিকভাবে সে সময়ে আমার সেই নিরাশাবাদীতা স্রেফ এক ভয়াবহ ভুলই ছিলো। তখন থেকে আজ তিনটি দশক বাংলাদেশ এক অনন্য সাধারন অগ্রগতির দেশ হিসেবেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অব্যহত গতিতে বেড়েছে, আর চলমান এই অতিমারির আগের টানা চার বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা বিশ্বব্যাংকের তথ্য। এবং সে গতি ছিলো চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতির চেয়েও বেশি। 

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। যা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চলের চেয়ে বেশি। হতে পারে এক সময় বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশা অনেক কিছু ছিলো, কিন্তু আজ কিভাবে অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে বিশ্বকে শেখানোর অনেক কিছু রয়েছে এই দেশের। 

তাহলে এই অগ্রগতির গোপণ রহস্যটি কি? তা হচ্ছে এদেশের মেয়েরা ও তাদের শিক্ষা। 

১৯৮০'র দশকে বাংলাদের এক-তৃতীয়াংশ মানুষও তাদের স্বাক্ষরজ্ঞানটুকু অর্জন করতে পারতো না। মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ ছিলো না বললেই চলে, এবং অর্থনীতিতেও তাদের ছিলো যৎসামান্যই অবদান। 

কিন্তু তখন থেকেই এদেশের সরকার ও সামাজিক- নাগরিক সংগঠনগুলো শিক্ষার ওপর জোর দেয়। মেয়েদের অন্তর্ভূক্ত করা হয় শিক্ষায়। আর তাতেই আজ দেশের ৯৮ শতাংশ শিশু তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারছে। আর লিঙ্গ বৈষম্যতো নেই ই, বরং অতি বিষ্ময়করভাবে এ দেশের ছেলে শিশুদের চেয়ে মেয়ে শিশুরা এখন শিক্ষায় বেশি এগিয়ে। 

নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর শিক্ষা বাংলাদেশকে এগিয়ে দিলো। তারাই হয়ে ঊঠলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত। দেশের তৈরি পোশাক খাত নারীদের কাজের বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করে দিলো। আমেরিকানদের উদ্দেশ্যে নিকোলাস ক্রিস্টফ বলেন, আপনি এখন যে শার্টটি পরে আছেন সেটি বাংলাদেশের ওই মেয়েদেরই কারো না কারো বানানো। চীনের পর বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। 

মেনে নিচ্ছি, বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় তার শ্রমিকদের কম মজুরি দেয়, সেখানে কিছু কিছু নিপীড়ন, হয়রাণি রয়েছে, অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে, কিন্তু নারী শ্রমিকদের নিজেদেরই কথা হচ্ছে, তাদের এই একটি কাজ ১৪ বছর বয়সে গ্রামের কোনো ধানকাটা শ্রমিকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার চেয়ে যথেষ্ঠ ভালো। তাছাড়া শ্রমিক ইউনিয়ন, নাগরিক সমাজের চাপে কর্ম-পরিবেশ এখন যথেষ্ঠই উন্নত, লিখেছেন ক্রিস্টফ।  

ব্র্যাক, গ্রামীণের মতো অলাভজনক বেসরকারি সংস্থার শিক্ষিত নারী কর্মীরা শিশুদের টিকাদান, নিরাপদ সৌচাগার ব্যবহার, বয়ষ্ক শিক্ষা, জন্মনিরোধক ব্যবহার, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে মানব পুঁজির এই বিনিয়োগ এক গতিশীলতা নিয়ে এসেছে, যা থেকে সকলেরই শেখার রয়েছে, মত এই বিশ্লেষকের। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচনের এক উৎসাহব্যাঞ্জক উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছে। গত ১৫ বছরে এই দেশের আড়াই কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের স্তর থেকে তুলে আনা সম্ভব হয়েছে। শিশুর পুষ্টিহীনতা ১৯৯১ সালের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এবং তা এখন পাশের দেশ ভারতের চেয়েও কম।

নিকোলাস ক্রিস্টফ পাঠকদের উদ্দেশে লিখেছেন, আপনারা যারা সংশয়বাদী পাঠক, তারা মাথা এদিক-ওদিক নেড়ে হয়তো বলবেন, জনসংখ্যার বাহুল্য এসব অগ্রগতিকে বিনাশ করে দেবে। তারা শুনুন- বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের মেয়েরা এখন গড়ে মোটে দুটি সন্তান প্রসব করে। যা আগে গড়ে সাতটি সন্তান ছিলো।

স্বল্প কথায়, বাংলাদেশ মূলত তার সবচেয়ে বেশি অব্যবহৃত সম্পদকেই বিনিয়োগ করতে পেরেছে- তা হচ্ছে এর দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যারা ছিলো সবচেয়ে প্রান্তিক, সবচেয়ে কম উৎপাদনক্ষম। আর সেখান থেকেই এসেছে সবচেয়ে বেশি সুফল। নিকোলাসের মত, এমনটাই এখন হতে পারে আমেরিকাতেও। তিনি লিখেছেন, আমরা আমাদের বিলিয়নিয়ারদের নিংড়ে আর খুব বেশি একটি উৎপাদনশীলতা বের করে আনতে পারবো না। কিন্তু আমরা সেইসব আমেরিকান শিশুদের তৈরি করতে পারি যারা তাদের হাই স্কুলের গন্ডি পার করতে পারেনি। আর সে সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। প্রতি সাতটি শিশুর মধ্যে একটি শিশুই পারেনি তাদের হাইস্কুল শেষ করতে। 

আর বাইডেনের শিশু দারিদ্র বিমোচন পরিকল্পনায় সেটাই গুরুত্ব পেতে পারে। প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনিয়োগ স্রেফ যে আবেগের একটি বিষয়, তা নয়, এর মাধ্যমে গোটা জাতিকেই সহায়তা করা হয়, বাংলাদেশই সে কথা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, মত এই মার্কিন কলামিস্টের।