অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সন্ত্রাসের জনক বিপর্যস্ত

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১২:০৮ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ১২:০৯ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

মিশরের প্যাপিরাসের পাতায় লেখা ফারাওদের অভিশাপ এখন আর অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায় না। কিংবদন্তী রয়েছে, রহস্যের সমাধিক্ষেত্রে ঢুকতে যারাই চেষ্টা করেছেন, তারাই মারা পড়েছেন অদ্ভুত অপঘাতে। এখন ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে উল্টো। সমাধিক্ষেত্রগুলো বরং এখন পরিবেশ দূষণ, বর্জ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়ে আপন মনে, নিজে নিজেই অপমৃত্যুর মুখোমুখি। কায়রো শহরের দূষিত বায়ূ পিরমিডগুলোকে সালফিউরিক আর নাইট্রিক অ্যাসিডে ধুয়ে দিচ্ছে রোজ। নর্দমার পানি আর ডিটারজেন্টের মতো মরু বালু উড়ে আসছে সব সময়। ধীরে ধীরে ক্ষয় করে বিপর্যস্ত করে ফেলছে স্ফিংকসকে। চার হাজার দু’শ বছর আগে প্রথম যখন মালভূমিতে পাহারা দিতে বসে স্ফিংকস, তখন তো অস্তিত্বই ছিলোনা কায়রো শহরের।

গুঁড়ি মেরে বসে থাকা এক সিংহের মতো ঐতিহাসিক ভাস্কর মুর্তির নাম স্ফিংকস্। মুখটা মানুষের। গ্রেট পিরামিডের কাছেই সামান্য নীচু এক জায়গায় সামনে থাবা মেরে বসে রয়েছে স্ফিংকস্। ভাঙ্গা চোরা মাথাটাতে দেখা যায় এক চিলতে হাসির রেখা। সম্ভবত; প্রথম দিকে স্ফিংকসের কাজ ছিলো আশপাশের সমাধিক্ষেত্রগুলোকে পাহারা দেয়া। পরবর্তীকালে এটা ‘হোরাস অব দ্য হরাইজন’ বা অর্থ দেবতার সঙ্গে সম্পৃত্ত হয়ে পড়ে। পাঁচ কোটি বছরের পুরনো চুনাপাথর কেটে কেটে স্ফিংকস্ তৈরি করেছিলো মিসরীয়রা। ভাবা যায়? এতো নরম ছিল এই ধরনের শিলা যে, পিরামিড তৈরির আগে ভাস্কর্য শিল্প নির্মাণ কাজে কেউই ব্যবহার করেনি এ জিনিস। হাজার হাজার বছর ধরে বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা বালি একটু একটু করে ঘাড় পর্যন্ত চাপা দিয়ে ফেলেছিলো স্ফিংকসকে। খ্রিষ্ট্রীয় নবম শতকে এক গোঁড়া ধর্মান্ধ জঙ্গি মুসলমান শাসক তরবারি দিয়ে এক কোপ মেরে এর নাকটা আলাদা করে ফেলেন। এরপর অবশ্য বালিচাপা পড়ে থাকায় আর কোন ক্ষতি হযনি এর। পরবর্তীতে খোঁড়াখুঁড়ি করে আবার তুলে আনা হয় স্ফিংকসকে।

আরবী ভাষায় স্ফিংকসকে বলা হয় আবুল হাত্তল অর্থাৎ সন্ত্রাসের জনক। কিন্তু সেই ফাদার অব টেরর বা সন্ত্রাসের জনক এখন নিজেই সন্ত্রাসের শিকার। স্ফিংকস এর কয়েক গজ দূরেই গড়ে উঠেছে গ্রাম। সেখান থেকে আসে বর্জ্য, পয়:প্রনালী আর নর্দমার পানি । এই পানি দূষিত করে চলেছে এর নীচের মরুভূমিকে। সিংহ ভাস্কর্র্যটির ভীষণ দূর্বল বক্ষদেশ রক্ষা করার প্রয়াসে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের এক মিশ্রন ব্যবহার করেছিলেন। লেই এর মতো সেই রাসায়নিক মিশ্রন একটি শক্ত আবরন তৈরি করে। সেটা পরবর্তীকালে স্ফিংকসের গা থেকে আসল চুনা পাথরের একটা স্তর সহ খসে পড়ে। পরে মিস্ত্রিরা এক হাজার সাতশো চুনাপাথরের ব্লক দিয়ে ভাস্কর্যটির কোমর আর থাবা দু’টো ঢেকে দিয়েছিলো। তখন অবশ্য অনেকে বলেন, চুনা পাথরের বøকগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বড় আকাড়ের ছিলো বলে বিকৃত হয়ে গেছে স্ফিংকসের আসল চেহারা, আদল বা প্রোফাইল। এছাড়া পানিও ক্ষতি করেছে এটির। চুনা পাথরের ব্লকগুলো জুড়বার জন্যে সিমেন্ট বালির যে মশলা ব্যবহার করা হয়েছে তার পানি ফোঁটায় ফোঁটায় ঢুকে পড়েছে চুনাপাথরের ভেতরে। সক্রিয় করে তুলেছে লবন অণুগুলোকে। পরিনামে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফটিকের। মিসরের বিখ্যাত প্রত্মতাত্তিক, রসায়নবিদ ওমর আল আরিনি বলেন, এতো নাজুক অবস্থা এটির যে, সামনে দাঁড়িয়ে একবার কেউ করোনার কাশি, হাঁচি দিলেও তুষার পাতের মতো এর গা থেকে ঝুর ঝুর করে পড়তে শুরু করে পাথর কণা।

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।