অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

তারা জানেন না কিভাবে নিবন্ধন, কিভাবে পাবেন করোনার টিকা

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:৪৫ পিএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার   আপডেট: ১১:৫৪ পিএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার

গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে উৎসবমূখর পরিবেশে। সম্মুখসারির যোদ্ধাদের স্বঃতস্ফূর্তভাবে টিকা নিতে দেখা গেছে। আবার বয়স বিবেচনায় চল্লিশ বছরের উপরে মানুষেরাও টিকা নেয়ার সুযোগ থাকায়, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ টিকা নিচ্ছেন বা নেয়ার চেষ্টা করছেন।  
 
সার্বিক পরিস্থিতি দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে মানুষের টিকা নেয়ার চাপ দিন দিন বেড়ে চলছে। চাপ এতটাই বাড়তে থাকে যে, গত বৃহস্পতিবার স্পট রেজিস্ট্রেশন অর্থাৎ কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে রেজিস্ট্রেশন করে তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। কেন বন্ধ করা হচ্ছে তার কারণ হিসেবে তিনি জানান যারা অন-দ্য-স্পট রেজিস্ট্রেশন করছে, তাদের সংখ্যাই বেশি। আর ঘরে বসে যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন কষ্ট করে তারাই টিকার সিডিউল পাচ্ছেন না।

সম্মুখ সারির যোদ্ধা যারা অর্থাৎ পুলিশ, প্রশাসন, ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক ইত্যাদি পেশাজীবী মানুষেরা অনলাইনে সুরক্ষা এ্যাপে নিবন্ধন করেই টিকা নিচ্ছেন। এসব পেশাজীবী মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার করে কম্পিউটার বা মোবাইলে সুরক্ষা এ্যাপে নিবন্ধন করাটা তেমন কষ্টের কোন বিষয়না। বরং বিষয়টা খুব সহজবোধ্য মনে হওয়াটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু এসবের বাইরে সমাজের এখনো কিছু মানুষ আছে যারা, অ্যাপ-ইন্টারনেট-সাইবার ক্যাফে ইত্যাদি কি তা জানেননা। অনেকেই নিরক্ষর, অনেকেই করোনা সম্পর্কে এর টিকা সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার নন। খোদ রাজধানীতেই মিললো এমন মানুষের দেখা। টিকার ব্যাপারে তারা কিছুটা উদাসীনও। এসব মানুষকে তাহলে কিভাবে টিকার আওতায় আসবে বা আনা হবে ?

অপরাজেয় বাংলা বেশ কয়েকজন চল্লিশোর্দ্ধ বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা বলে রাজধানীর কয়েকটি স্থানে। যারা দিন আনেন দিন খান গোছের মানুষ। ঢাকা শহরে, কোনরকমে আয়-উপার্জন করে টিকে আছেন জীবন যুদ্ধে। কেউ থাকেন বস্তিতে, কেউ মেসে গাদাগাদি করে থাকেন, আর কেউবা থাকেন রাস্তায়ও। 

মো. মোল্লা বরিশালের গৌরনদী থেকে ঢাকায় এসেছেন ৩০ বছর আগে। শুরু থেকেই রিকশা চালান তিনি। নিজের বয়স জানালেন ৬৫। থাকেন ঢাকার নদীর ঘাট বস্তিতে। টিকা নিয়েছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি অপরাজেয় বাংলাকে জানান, নেননি তবে টিকা নিতে চান তিনি। এবার মো. মোল্লা জানতে চাইলেন, কোথায় গেলে টিকা পাবেন ? 

টিকা নেয়ার জন্য কোন হাসপাতালে নিতে চান তা উল্লেখ করে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে, তারপর ফোনে একটা এসএমএস পাবেন, আপনাকে কবে টিকা দেয়া হবে, কোথায় দেয়া হবে সেই এসএমএসে লেখা থাকবে, এসব বুঝিয়ে বললে মন দিয়ে শুনলেন কিন্তু উত্তরে যা জানালেন তার সমাধান কোন পথে তা বোঝা গেলো না। ।

মো. মোল্লা জানালেন, তার কাছে মোবাইল ফোন নেই। কেনার টাকাও নাই। আর অনলাইন কি তিনি বুঝেননা। মোল্লাকে জানানো হলো, মার্কেটে বিভিন্ন দোকানে কিছু টাকা দিলে আপনার হয়ে তারা অনলাইনে টিকার জন্য নিববন্ধন করে দেবে। 

মো. মোল্লার তাৎক্ষণিক উক্তি, “আপনাগো পাগলে পাইসে নাকি, আপনের কি মনে হয়, আমার এই ময়লা জামা কাপড়ে অনলাইন-ফনলাইনের দোকানে ঢোকতে দেবে”। মো. মোল্লার ধারনা, তার মতো রিকশাওয়ালাদের জন্য এমন নিয়ম একটু কঠিন। তাদের জন্য আরেকটু নিয়ম সহজ করলে হয়তো টিকা নিতে পারতেন। 

রাজধানীর শাহবাগ বেশ কয়েকবছর ধরে পিঠা বিক্রি করেন ষাট বছরের বয়সের এক নারী। তিনি নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কথায় কথায় তিনি জানালেন, ১৫ বছর আগে রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছেন। রাস্তায় পিঠা বিক্রি করে সংসার চালান। পড়াশোনা জানেননা। টিকা নিতে চান কিনা এমন প্রশ্নে জানালেন, পিঠা খেতে খেতে অনেক মানুষ তার সামনে টিকা নেয়ার গল্প করে। তারো ইচ্ছা আছে টিকা নেওয়ার। 

টিকা কিভাবে নিতে পারবেন জানেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এই ষাটোর্ধ্ব নারী জানান, শুনেছেন কম্পিউটারে কিভাবে যেন কি করতে হয়। তিনি এসব কিছু  বুঝেননা, বুঝানোর মতো কোন আত্মীয়-স্বজনও নাই তার। একারণে হয়তো তার টিকা নেয়া হবেনা বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।   

সদরঘাটের এক মেসে থাকেন ৭০ বছরের বজলু মিয়া। মুন্সীগঞ্জ থেকে  তিনি ঢাকা এসেছেন ৩০ বছর আগে। এখন ফেরী করে সারা ঢাকা শহরে ছেলেদের প্যান্ট-শার্ট বিক্রি করেন। কাকরাইলে মোড়ে কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, টিকার কথা শুনেছেন। বাড়ি গিয়ে টিকা নেবেন। কিভাবে টিকা নিতে হয় তা জানেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বজলু মিয়া বলেন, “এত জ্ঞান থাকলে কি আর হকার হইতাম। বাড়ির লোক জানে কিভাবে করতে হয়। আমার ভাই কইরা দিবো”। 

অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে জানালে বজলু মিয়া বলেন, তিনি তা জানেন। কিন্তু তার মত, তার মতো হকারদের জন্য এসব জিনিস সুলভ না। বা তারা যাদের সঙ্গে চলাচল করেন, তারাও এসব বিষয় সম্পর্কে জানেননা। বজলু মিয়া নিজেও জানেননা, কোথায় গেলে টিকার নিবন্ধন ফর্ম পূরণ করা যাবে। 

ঢাকার নবাবগঞ্জের একটি ঝুপড়ি ঘরে ভাড়া থাকেন নূর ইসলাম। পেশায় সবজি বিক্রেতা। পড়াশোনা তেমন জানেননা। বয়স তার ৭০ বলে জানালেন। ২০ বছর ধরে ভ্যানে করে রাজধানিতে সবজি বিক্রি করেন নূর ইসলাম। টিকা নিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, নিবেন। নিবন্ধন করেছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, “কিসের আবার নিবন্ধন। হাসপাতালে যামু। টিকা নিমু”। 

টিকা নেয়ার পুরো প্রক্রিয়া তাকে জানানো হলে নূর ইসলামের পাল্টা প্রশ্ন, এত কিছু করা তার মতো সবজি ওয়ালার পক্ষে সম্ভব? 

একই ধরনের প্রশ্ন ছিলো, রাজধানীতে ফেরি করে প্যাটিস বিক্রেতার। নাম ও ছবি প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্যাটিস বিক্রেতা জানালেন, তারা ইন্টারনেট, কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, নিবন্ধন, এসএমএস ইত্যাদি এসব বুঝেননা। তাদের মতো মানুষের কাছে একটা কমদামি ফোনও থাকেনা। তাদের জন্য টিকা দেয়ার পদ্ধতিটা আরো সহজ করলে, তারমতো অবহেলিত মানুষরা টিকা নিতে পারতেন। 

রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে অনলাইনে টিকার নিববন্ধন করেন এমন বেশ কয়েকটি দোকানের কর্মীদের সঙ্গে কথা হয় অপরাজেয় বাংলার। বৈশাখী টেলিকম ফটোস্ট্যাট এন্ড কম্পিউটারের স্বত্তাধিকারী ডাবলু রহমান বলেন, তাদের কাছে যারা নিবন্ধন করতে এসেছেন সবাই মোটামুটি শিক্ষিত ও স্বচ্ছল মানুষ। অস্বচ্ছল বা অশিক্ষিত কোন মানুষ তাদের কাছে নিবন্ধন করতে আসেননি।