অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

জয়নাল-দীপালী-জাফরদের ভালোবাসার রক্তগোলাপ

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

প্রকাশিত: ০২:০৫ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার   আপডেট: ০৯:২৯ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার

১৪ ফেব্রুয়ারি; ভালোবাসা দিবস, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস, গণজাগরণ আন্দোলনের প্রথম শহীদ জাফর মুন্সির মৃত্যুতারিখ। ভালোবাসা দিবসের প্রথম পরিচিতি যতখানি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের পরিচিতি ততখানি নয়। প্রথমত চিরায়তভাবে আমরা ভালোবাসার কাঙাল, দিবসী ভালোবাসায় আরেকটু বেশি বিভোর, উদযাপন-দর্শনে বিশ্বাসী। এছাড়া দিবস উদযাপনের ব্যাপ্তিও এর বৈশ্বিক, আলোচনাও দেশে-বিদেশে। স্বভাবত এর বাণিজ্যিক মূল্যও আছে। আর বাণিজ্যমূল্যের যোগ যেখানে, সেখানে এর বাজারও ক্রমপ্রসারমান। ঠিক কত বছর হলো দেশে ভালোবাসা দিবসের উদযাপনের সে আলোচনা এখানে কিংবা সবখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় যখন এর সঙ্গে বাণিজ্যমূল্যের যোগ থাকে। ভালোবাসা আর আবেগে আবাহনে এই দিনটির মূল্যও তাই অনেক।

১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের যে আলোচনা আমরা করি সেখানে রয়েছে আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের দায়। ইতিহাসে এই দায়ে কোন মিথের সংশ্লেষ নেই, আছে নির্ভেজাল রক্তের ইতিহাস, আছে প্রতিরোধী বার্তা, আছে শিক্ষার সংযোগ। এই দিনের সঙ্গে যোগ আছে ১৯৮৩ সালের শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসের। আমাদের নিজস্ব ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। মজিদ খানের ওই শিক্ষানীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে—এই শঙ্কায় ছাত্ররা এর বিরোধিতা করে। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে ওই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষানীতি বাতিল, বন্দি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে। হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ মিছিল হাই কোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে পড়লে ছাত্রনেতারা সেখানে সমাবেশ শুরু করেন। ওই সময় পুলিশ ছাত্রজমায়েতে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙিন গরম পানি, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় গুলিবিদ্ধ হন কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। ছাত্ররা পুলিশ সদস্যদের হত্যা করেছে এমন অপপ্রচার চালিয়ে এরশাদ সরকার পুলিশকে উসকে দেয়। ওই দিন নিহত হয়েছিলেন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরও কয়েকজন। সরকারি হিসেবেই গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জন, বাস্তবে এই সংখ্যা ছিল আরও বেশি। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ চেতনার দিন। সেসময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা দিনটি পালন করছে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।

মিথসৃষ্ট ভ্যালেন্টাইন ডের আড়ালে আরও ইতিহাস আছে আমাদের রক্তের। যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তারুণ্যের আগুনমাখা গণজাগরণের সময়ে শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম শহীদ জাফর মুন্সির মৃত্যুর তারিখও এই ১৪ ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের পরিবর্তে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দেশ। ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলের অগ্রণী ব্যাংকের কর্মচারী জাফর মুন্সি অফিসের ফটকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে সাঁটানো ব্যানার এবং পোস্টার ছিঁড়তে আসা জামায়াত-শিবির কর্মীদের বাধা দিতে গেলে সংগঠনটির কর্মীদের বেধড়ক লাঠিপেটার শিকার হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি।  গণজাগরণ আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশের ইতিহাস কলঙ্কমুক্তির ধারাবাহিকতায় সুফল ভোগ করছে দেশ। জাতীয় পর্যায়ে অনালোচিত হলেও এই কলঙ্কমুক্তিতে আছে জাফর মুন্সিরও অবদান। তারিখটাও একই ১৪ ফেব্রুয়ারি।  

ভালোবাসা দিবস, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস, জাফর মুন্সির মৃত্যু; একদিনে একাধিক ঘটনার আলোচনায় দিবসটি তবে কী বলে উল্লেখ হবে এনিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। এই বিভক্তিতে কেউ কেউ আবার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতেও চান ঘটনার সঙ্গে ঘটনার। এই মুখোমুখি করে দেওয়া উচিত হবে না আমাদের। কারণ ভালোবাসা দিবস কিংবা স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলে আদতে লাভবান হয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রই। ভ্যালেন্টাইনস ডে’কে তিরাশি কিংবা দুই হাজার তেরোর বেদনাবিধূর দিনের স্মৃতি ‘ভুলিয়ে দেওয়ার’ উপলক্ষ ভাবারও কারণ নাই। দেশের প্রগতিশীল অংশের লোকজনের উচিত হবে না এখানে একটার মুখোমুখি অন্যটাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। কারণ ভালোবাসার উদযাপন যেমন প্রতিক্রিয়াশীলদের আপত্তির কারণ, একইভাবে তাদের আপত্তির জায়গাও স্বৈরাচারের বিরোধিতা।

ঘটনাবহুল জীবন আমাদের। জীবনের অনেক কিছু ইতিহাসের অংশ হয়। এক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অনেক ইতিহাস; এটাই প্রকৃতির স্বভাবধর্ম। অতীতকে অস্বীকারের উপায় নেই যেমন আমাদের, তেমনি এই অতীতের ঘটনাগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়াও উচিত নয় আমাদের। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস, ঐতিহাসিক গণজাগরণের প্রথম শহীদ জাফর মুন্সির মৃত্যুতারিখ—এই সব বিষয়সহ জানা-আপাত অজানা—যা কিছুই সামনে আসবে, সেগুলোকে আমাদের গ্রহণ করতেই হয়। এই দিনগুলো সুখ বা শোকের যাই হোক না কেন এখানে সুখের জন্যে শোক বাদ বা শোকের জন্যে সুখ বাদ—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না।

নারী-পুরুষের সম্পর্কে আপত্তি যাদের, ভালোবাসা শব্দেই সন্দেহ যাদের, তাদের কাছে ভালোবাসার বিবিধ প্রকাশের মূল্য নেই; ভ্যালেন্টাইন ডে শব্দদ্বয় আর এর উদযাপন তাদের গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাত করলে দিনশেষে উদারপন্থার জয় হয়। আমরা সবাইকে নিয়ে ভালোবাসার নানামুখী প্রকাশে বিজয়ী হতে চাই। একই সঙ্গে চাই একইদিনে স্বৈরাচারের প্রতিরোধের সেই বার্তা ভুলে না যেতে!

যারা ভালোবাসায় অবগাহন করতে চায় তারা করুক, যারা স্বৈরাচারপ্রতিরোধী দিবসের ডাকে সাড়া দিতে চায় দিক। এদের কেউ আমাদের বিরুদ্ধপক্ষ নয়; তারা আমাদেরই পক্ষ, আমরাও তাদের পক্ষ। আমরা সতত গোঁড়ামির বিরুদ্ধপক্ষ। এই দিনে আমরা তাই জয়নাল-জাফর-কাঞ্চন-দীপালী-জাফর মুন্সিদের গোলাপ দিতে চাই, ভালোবাসার রক্তগোলাপ!